বাসের ছাদে বসে ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিল ছেলেটা। খেলতে নেমে প্রথম বলেই উইকেট নিয়েছিল। সেই ছেলেই পরে বিশ্বের একনম্বর অলরাউন্ডার হয়। বাংলাদেশের প্রাণ, বাংলাদেশের সম্পদ তিনি।
সাকিব আল হাসান। বন্ধুমহলে যিনি ফয়সাল নামে জনপ্রিয়। বিশ্বকাপ কভার করতে বাংলাদেশে গিয়ে একবার কী বিড়ম্বনাতেই না পড়েছিলাম! আমার লেখায় সাকিব বানান শাকিব দেখে বাংলাদেশের এক অভিজ্ঞ সাংবাদিক জোর বকুনি দিয়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনারা ভুল বানান লেখেন।’
আমার বন্ধু সঞ্জয় সাহা পিয়াল দৈনিক সমকাল সংবাদপত্রের উচ্চপদে রয়েছেন। তিনিই সেই সময়ে বুঝিয়ে বলেছিলেন, ‘কৃশ, সাকিব ওর নিজের নামের বানানে স লেখে।’
বিশ্বকাপ কভার করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের কাছে যে হোটেলে উঠেছিলাম, তাঁর মালিক সুমনভাই একদিন সকালে ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন, ‘সাকিব খুব অ্যারোগ্যান্ট। গ্যালারিতে সবাই হায় হায় সাকিব করছে, আর সাকিব বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাচ্ছে। কেউ যাতে দেখতে না পায় তাই পিঠের কাছে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ নিয়ে গিয়ে ওরকম করছে।’
২০১১ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে যেদিন ৫৮ রানে অলআউট হয়েছিল বাংলাদেশ, সেদিন সাংবাদিক বৈঠকে উড়ে এসেছিল প্রশ্ন, ‘এটাই কি সব থেকে খারাপ দিন বাংলাদেশ ক্রিকেটের?’ সাকিব বলেছিলেন, ‘দেখুন, ক্রিকেটে এমনও দিন আসতে পারে যেদিনটা আজকের থেকেও খারাপ হতে পারে।’
সবাই খুব সমালোচনা করেছিলেন অধিনায়ক সাকিবের। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পরের ম্যাচ ছিল চট্টগ্রামে। ইংল্যান্ডকে সেই ম্যাচে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। সাকিব সেদিন কেঁদেছিলেন। যাঁরা আগে খুব সমালোচনা করেছিলেন, তাঁরাই বলছিলেন, ‘সাকিব কেন কাঁদছে? সাকিব তো বীর, সাকিব তো যোদ্ধা। বীরযোদ্ধা কখনও কাঁদে নাকি?’
মিরপুর স্টেডিয়ামের একটা মুহূর্ত খুব মনে পড়ছে। স্টেডিয়ামের একেবারে ছাদে দাঁড়িয়ে রয়েছি। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হচ্ছে। গোটা স্টেডিয়াম গান গাইছে উঠে দাঁড়িয়ে। বন্ধু পিয়াল বললেন, ‘সাকিব কাইন্দ্যা দিসে রে।’ সাকিবও আমার,আপনার মতোই আবেগী একজন মানুষ। তাঁর আবেগ হয়তো বুঝতে পারি না আমরা।
সাকিব আল হাসান আসলে অন্তর্মুখী স্বভাবের একজন মানুষ। সামনে থেকে দেখলে মনে হয় কী ভীষণ রাগী, কী ভীষণ অ্যাটিটিউড! ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত বিনয়ী একজন। বাংলাদেশের মানুষ সহজ-সরল। মাটির গন্ধ থাকে শরীরে। সাকিবও তেমন। খুব মন খারাপ হলে, তা ভুলতে বিশ্বের একনম্বর অলরাউন্ডার নাকি ঘুমিয়ে পড়েন। মনের দু:খ তাতে ভোলেন তিনি।
২০১৯ বিশ্বকাপের সময়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে প্রতিবেদন লিখেছিলাম। বাংলাদেশের নামী কাগজ ‘প্রথম আলো’য় সাহিত্যিক আনিসুল হক আমার প্রতিবেদন নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলেন ‘লেখোয়ারের ব্যাট’ এই শীর্ষকে।
বিখ্যাত মানুষটি সাকিব সম্পর্কে বলেন, ‘সাকিব আল হাসান একজন জেদি মানুষ। তাই খেলার মাঠে ব্যাটসম্যান তাঁকে ছক্কা মারলে, তিনি ব্যাটসম্যানকে পরের বলে আউট করেন। আবার ব্যাট হাতে বোলার তাঁকে পরাস্ত করলে, তিনি পরের বলে ছক্কা হাঁকান। এরকম একজন জেদি ক্রিকেটার যে দৃঢ়চেতা হবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাঁর দৃঢ়তাকে আমরা অনেক সময়েই ভুল বুঝি। মনে করি আমার, আপনার মতো তিনিও হাত জোড় করে থাকবেন।’
বাংলাদেশ জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার মুহূর্তে সাকিব নাকি শক্ড হয়েছিলেন। আবদুর রাজ্জাক সুযোগ পাননি। কিন্তু সুযোগ পেয়ে যান সাকিব। রাজ্জাকের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক ছিল তারকার। তিনিই প্রথমটায় মেনে নিতে পারেননি রাজ্জাকের বাদ পড়া।
সাকিব হাত জোড় করার ক্রিকেটারই নন। ভয়-ডড়হীন একজন ব্যক্তিত্ব। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের শেষ ওভার সবারই মনে আছে। কোমড়ের উপরে বলে ছক্কা হাঁকানোর পরে বিরাট কোহলি নো বলের জন্য আবেদন করেছিলেন আম্পায়ারের কাছে।
কোহলির চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন আম্পায়ারও। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হাই টেনশনের ম্যাচেও কোহলি একটি ডেলিভারির উচ্চতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন আম্পায়ারের কাছে।
দূর থেকে ছুটে এসে সাকিব কোহলির মতো প্রভাবশালী এক জন ক্রিকেটারকে শান্ত করেছিলেন। বিরাটের মতো
একজন মেজাজী, আগ্রাসী ক্রিকেটারও শেষে সাকিবের কাঁধে হাত রেখে গল্প করছিলেন। সম্পর্ক খারাপ হয়নি দু’জনের।
এই আইপিএলে সাকিব কেকেআরে থেকেও নেই। এলেনই না শেষমেশ। অতীতেও তিনি ছিলেন শাহরুখ খানের ফ্র্যাঞ্চাইজিতে। কিং খানের কাছ থেকে সাকিব শিখেছেন, ‘যত ক্লান্তই হও না কেন, স্ত্রীর সামনে কখনও বলবে না যে তুমি টায়ার্ড।’ সাকিব মেনে চলেন শাহরুখের পরামর্শ।
সাকিবের বাঁ হাতের স্পিন খেলতে না পেরে বিপক্ষের ব্যাটসম্যান স্টাম্পড হচ্ছেন, সেই দৃশ্য দেখে জুহি চাওলা আনন্দে উদ্বেল হয়েছিলেন গ্যালারিতে।
গৌতম গম্ভীরের কলকাতা নাইট রাইডার্স প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয় ২০১২ সালে। মনোজ তিওয়ারি ও সাকিব ক্রিজে থেকেই নাইটদের চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন,তাই না!
রসিকতা করে এই সাকিবকেই বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘নাইট শিবিরে সব থেকে খারাপ নাচি আমি। আর সব চেয়ে ভাল নাচতে পারে রাসেল।’
সাকিবের বাবা ফুটবল খেলতেন। বাবাকে দেখে ছেলেও শুরুর দিকে ফুটবল নিয়ে পড়ে থাকতেন। পরে ক্রিকেটে এলেন কেন? সাকিব রসিকতা করেন, ‘উপমহাদেশে, এশিয়ায় ক্রিকেট খেললে টাকা পাওয়া যায়।’
সাকিবের স্ত্রী শিশির নাকি গঞ্জনা করেন, ‘অন্য বোলাররা কত জোরে বল করে। তুমি এত আস্তে বল কর কেন?’ অবুঝ স্ত্রীকে বোঝাতে পারেন না বাংলাদেশের নামী ক্রিকেটার। হাল ছেড়ে দিয়ে বলেন, ‘আমি ভাল বুঝতে পারি। কিন্তু বোঝাতে পারি না।’
বোলারের কঠিন বল আগেই পড়ে ফেলেন। কোন ব্যাটসম্যানকে কোন বলে ঘায়েল করতে হবে, সেটাও বিলক্ষণ জানেন। কিন্তু জানেন না সাংবাদিক বৈঠকে কোন প্রশ্ন বিমার হয়ে উড়ে আসবে আর কোন প্রশ্ন বাউন্সার হয়ে তাঁকে আঘাত করবে। মনের কথা স্বাভাবিক ভাবেই বলে ফেলেন। আসলে সবাই যা শুনতে চান, সাকিব সেটা বলতে পারেন না সাংবাদিক বৈঠকে।
বেপরোয়া পিচের সঙ্গে সন্ধি করতে দক্ষ সাকিব। অচেনা পরিবেশের সঙ্গেও বন্ধুত্ব স্থাপনে পটু বাংলাদেশের তারকা। সেই তিনি বিকেএসপিতে পড়ার সময়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলার ছাত্রের সঙ্গে মিশেছেন। তাঁদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন। এভাবেই মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা তাঁর মধ্যে গড়ে উঠেছিল সেই ছাত্রাবস্থা থেকেই।
কেকেআরে থাকার সময়ে কুলদীপ যাদবকে বাংলা শেখাতেন সাকিব। একদিন শেখাচ্ছিলেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।’ কুলদীপও বলছিলেন তা। এই গান নিশ্চয় সাকিবেরও মনের গান, প্রাণের গান।
বাংলাদেশের ক্রিকেট পাগল মানুষদের জন্য সাকিব গাইতেই পারেন, ‘দিনের পথিক মনে রেখো, আমি চলেছিলেম রাতে, সন্ধ্যাপ্রদীপ নিয়ে হাতে।’
বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের সব চেয়ে বড় বিজ্ঞাপনের নাম সাকিব আল হাসান। দেশের মুখ তিনি। এক নম্বর অলরাউন্ডার হওয়ার পরে তাঁকেই বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘আমার নামের পাশে যখন দেখি বিএন মানে বাংলাদেশ লেখা, তখন বড্ড ভাল লাগে।’
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় রয়েছে সবুজ রং। সাকিবেরও প্রিয় রং সবুজ। বাসের ছাদে বসে ক্রিকেট খেলতে গেলে, তবেই সাকিব হওয়া যায়। মনে দু:খরা ঝড় তুললেও তা প্রকাশ করা যাবে না, এই শর্ত পূরণ করতে পারেন কেবল সাকিব আল হাসানই।
কোনও অবস্থাতেই যার কাঁধ ঝুলে পড়ে না, তিনিই সাকিব। কঠিন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আরও কঠিন হয়ে উঠতে পারেন বলেই তাঁর নাম সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশের প্রাণ। বাংলাদেশের হৃদয়। বাংলাদেশের স্পন্দন।