টেস্ট ক্রিকেট, ক্রিকেটের সবচেয়ে কঠিনতম পরীক্ষা, কঠিনতম ফরম্যাট। অনেকে বলেন এখনকার সময়ে “ক্রিকেটার” আর “টেস্ট ক্রিকেটার” এই দুইটা শব্দের পার্থক্য অনেক। ফলে ক্রিকেটের এই ফরম্যাটটাতে রাতারাতি পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব নয়। টেস্ট ক্রিকেটে সাফল্য পেতে হলে ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে হয়, একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠতে হয়ে। ফলে মাত্র এক টেস্ট আগেই নেতৃত্ব পাওয়া সাকিব আল হাসান রাতারাতি সব বদলে দিবেন সেটা ভাবাও ভুল। তবুও এই অল্প সময়ে তাঁর অধিনায়কত্বের একটা আলাদা দর্শন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।
টেস্ট ক্রিকেটে আমাদের পারফর্মেন্স কখনোই সুখকর ছিল না। খুব নির্দিষ্ট করে বললে এই ফরম্যাটে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্যটা এসেছে এইবছর নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। ব্যাস এটুকুই। টেস্ট ক্রিকেটে আমাদের গর্বের জায়গা এটুকুই। এইতো কদিন আগেই শ্রীলঙ্কা আমাদের ঘরের মাঠে এসে হারিয়ে দিয়ে গেল একেবারে হেসে খেলে। এই ফরম্যাটটা যে আমরা পারিনা সেটা আরেকবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো হলো।
কিন্তু বাংলাদেশ এবার সাদা পোশাকের ক্রিকেটেও ঘুরে দাঁড়াতে চায়। ক্রিকেটের অভিজাত এই ফরম্যাটটায় নিজেদের একটা সংস্কৃতি গড়ে তুলতে চায়। সেজন্যই তর্ক সাপেক্ষে সবচেয়ে যোগ্য লোকটাকেই অধিনায়ক করে নিয়ে আসা হলো। এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর দিয়েই এই দফায় তাঁর অধিনায়কত্বের যাত্রা শুরু হলো।
এখনই সাকিবের অধিনায়কত্ব নিয়ে আলোচনা বা সমালোচনা করার সময় আসেনি। তবুও তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে কিছু ছোট ছোট জিনিস নজরে এসেছে। অধিনায়ক সাকিবের সেই দর্শনগুলোই একটু তুলে ধরতে চাই।
শুরুতেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টের একাদশে নজর দেয়া যাক। একাদশ থেকে মুমিনুল হক বাদ পড়েছেন এটাই ছিল সবার আলোচনার বিষয়। তবে আরেকটা পরিবর্তন খানিকটা আড়ালেই থেকে গিয়েছে। সেটা হচ্ছে লম্বা সময় পর লাল বলের ক্রিকেটে ফেরা মুস্তাফিজুর রহমান মাত্র এক ম্যাচ খেলেই বাদ পড়েছেন।
প্রেক্ষাপটটা একটু বলা যাক। বাংলাদেশের দলে মুস্তাফিজ আছেন। তারপরও বাইরে থেকে আরেকজ পেসারকে নিয়ে যাওয়াটা বিস্ময় জাগায়। প্রথম টেস্টের পর হঠাত করেই শরিফুলকে রীতিমত উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং দ্বিতীয় টেস্টে মাঠেও নামানো হলো। এই সিদ্ধান্তটা আসলে সাকিব ছাড়া অন্য কারো থেকে আসা কঠিন। কেননা মুস্তাফিজকে এক ম্যাচ খেলিয়েই বাদ দিয়ে দেয়ার ব্যাপারে ভাবাও সহজ না।
মুস্তাফিজকে বাদ দেয়ার ব্যাপারে খুব সম্ভবত সাকিবের মাথায় দুইটা জিনিস কাজ করেছে। প্রথমত লাল বলের ক্রিকেটে মুস্তাফিজ মানিয়ে নিতে পারেননি। প্রথম টেস্টে অন্য দুই পেসারের তুলনায় তিনি খুব একটা কার্যকর ছিলেন না। আরো বড় ব্যাপার হচ্ছে লম্বা মেয়াদে সাকিব মুস্তাফিজকে টেস্ট দলে পাবেন না। ফলে মুস্তাফিজের পিছনে ইনভেস্ট করতে তিনি রাজি নন। তিনি তাই শরিফুলে দিকে ঝুঁকেছেন। যিনি কিনা লম্বা মেয়াদে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের বড় সম্পদ হতে পারেন।
এছাড়া মুমিনুল হককে বাদ দেয়ার ব্যাপারটাতো সবারই নজরে এসেছে। এর আগে সংবাদ সম্মেলনেই তিনি এমন বার্তা দিয়ে রেখেছিলেন। আর বিকল্প থাকলে যে তিনি নাজমুল হোসেন শান্তকেও একাদশে রাখতেন না সেটা ধারণা করাও খুব সহজ। তবে ইয়াসির আলি রাব্বি ইনজুরিতে পড়ে যাওয়ায় সাকিবের সামনে সেই সুযোগ ছিল না।
এছাড়া সংবাদ সম্মেলনে এসে তাঁর কথাবার্তাতেও একটা পরিবর্তনের সুর খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর দলে থাকতে হলে যে পারফর্মার হতে হবে সেটাও স্পষ্টই জানিয়েছেন। তবে দ্বিতীয় টেস্টের আগেরদিন সংবাদ সম্মেলনে এসে সাকিবের একটা কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। তিনি জানিয়েছিলেন ম্যাচ শুরুর আগেরদিনই তিনি তাঁর একাদশ ঠিক করে ফেলতে চান এবং দলের সবাইকে সেটা জানিয়ে দিতে চান।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা খুব নতুন একটা স্টেটমেন্ট। কেননা বিদেশের মাটিতে তো দূরে থাক দেশের মাটিতেও বাংলাদেশ ম্যাচ শুরুর আগে একাদশ ঠিক করে। এর আগে সব অধিনায়কেরই সুর অনেকটা এমন ছিল যে সকালে উইকেট দেখে তারপর সিদ্ধান্ত নিব। কিন্তু সাকিব সেই ধারাটা থেকে সরে আসতে চাইছেন।
এছাড়া সাকিবের স্বভাবজাত কিছু গুন তো আছেই। মাঠে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন, তাঁর ক্রিকেট মেধা এগুলো মোটামুটি সবারই জানা। তবে স্বপ্ন দেখাচ্ছে টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে তাঁর ছোট ছোট এই পরিবর্তন গুলো। একদিন এই সবগুলো মিলেই হয়তো বড় কোন পরিবর্তন আসবে, একটা সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। সাফল্যটাও তো তখনই আসবে। আপাতত সাকিবের দর্শন ক্লাসে মনোযোগ দেয়া যাক।