এ সাকিব, কেমন সাকিব!

সাকিব আল হাসান মানুষটা কেমন?

যারা বাইরে থেকে দেখেন, তাদের মধ্যে দোলাচল থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু অনেককাল ধরে সাকিবকে দেখছেন, এমন লোকেরাও ঠিক এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না।

কেউ বলেন, সাকিব একটু মুডি। আবার কেউ বলেন, সাকিবের মতো মজার ছেলে আর হয় না। আরেকটু এগোলে শুনবেন, নাহ। ছেলেটা খুব অহংকারী।

সাকিব আসলে কেমন, সেটা জানার আমার খুব দরকার হয়েছিলো তাকে নিয়ে বই লেখার সময়। আমি সাকিব বিষয়ে প্রায় ২৫ জন মানুষের সাক্ষাতকার নিয়েছি, সাকিবের নিজের অন্তত তিন দফা শুধু বই উপলক্ষে সাক্ষাতকার নিয়েছে। সব মিলিয়ে এই অবধি সাকিবের অন্তত ২০টি সাক্ষাতকার নিয়েছি, অন্তত গোটা তিরিশেক সংবাদ সম্মেলন কাভার করেছি।

প্রতিটা দফায় এই প্রশ্নের উত্তর খোজার চেষ্টা করেছি-সাকিব আসলে মানুষটা কেমন?

আমি এই প্রশ্নের কোনো সরলরৈখিক এক বাক্যের উত্তর খুজে পাইনি। কেউ নিশ্চিত নন যেনো। ‘খুব ভালো’ বলেও চুপ করে কিছু একটা ‘কিন্তু’ ভাবেন কেউ কেউ। আবার ‘ছেলেটা বেয়াদব’ বলেও একটু থতোমতো খেয়ে ‘কিন্তু’ বলেন কেউ।

এ যেনো এক রহস্য। চোখের সামনেই আছে, কিন্তু বোঝা যায় না।

আমি বরং কয়েকটা টুকরো গল্প বলি

সাকিবকে বই করবো জানালাম।

এক কথায় বলে দিলেন, তার কোনো হেল্প পাবো না। কাউকে নিয়ে বই করতে তার হেল্প লাগবেই, আইনে এমন কথা নেই। বইয়ের কোনো লেখায় আপত্তি থাকলে প্রকাশের পর তিনি ব্যবস্থা নিতে পারেন। তবে প্রকাশের আগে আর কী করার আছে!

তারপরও আমার সাকিবকে দরকার ছিলো। তাই ধরলাম তার কোচ সালাউদ্দিন ভাইকে। সালাউদ্দিন ভাই বলে দিলেন। ব্যস ম্যাজিকের মতো কাজ হলো। সাকিব নিজে দফায় দফায় আমাকে সাক্ষাতকার দিলেন। মা-বোন তো বটেই, তার স্ত্রীকেও রাজী করিয়ে ফেললেও প্রবল আপত্তির পরও। নিজে দেশে ছিলেন না। মাকে সেই মাগুরা থেকে এনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে থাকার ব্যবস্থা করলেন।

বই উপলক্ষে সাকিবের বিশাল সাক্ষাতকার নেওয়া শেষে আমি আস্তে আস্তে তাকে বলেছিলাম, ‘সাকিব, আপনাকে নিয়ে লেখা বইটা তো আমি বানিজ্যিকভাবে বিক্রি করবো। এটা আপনাকে জানিয়ে রাখা উচিত।’

সাকিব কথাটা শেষ করতে দিলেন না। আমি জীবনে কখনো এতো লাজুক ভঙ্গির সাকিবকে দেখিনি। হাত নেড়ে বললেন, ‘দেখেন, সালাউদ্দিন স্যার আমাকে বলেছেন, আপনাকে বইয়ের ব্যাপারে সহযোগিতা করতে। এরপর বই নিয়ে আপনি কী করবেন, সেটা আমি আর ভাবিনি। স্যার কিছু করতে বললে আমি প্রশ্ন করি না।’

আমার কাছে সাকিব এমন এক গুরুভক্ত।

সাকিব আল হাসানের সঙ্গে কখনোই আমার দহরম মহরম ছিল না। প্রথম আলোতে সাকিব কলাম লিখতেন, আমি যতদিন ছিলাম প্রায়শ সে কলাম অনুলিখন করতে তার সঙ্গে বসতে হত; এটুকুই বিশেষ সম্পর্ক। তথাকথিত ঘনিষ্ঠদের সঙ্গেই আমার তখন যোগাযোগ নেই, সাকিবের সঙ্গে কীভাবে থাকবে? আরও প্রথম আলোর বাইরে এসেই বন্যার মতো কানে ঢুকতে লাগল-সাকিব কাউকে পাত্তা দেয় না! ফলে প্রথম আলো ছাড়ার পর আমি সে দিনের আগ পর্যন্ত সাকিবকে ফোন দেইনি।

সেদিন সকাল বেলায় উঠে অভ্যেসমতো বিভিন্ন নিউজ সাইটে ঢুকে খবরাখবর জানার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ ক্রিকইনফোর একটা সংবাদে চোখ আটকে গেল-সাকিব আল হাসান এখন টেস্টেরও এক নম্বর অলরাউন্ডার!

মনটা আনচান করে উঠলো-আহা, আজ সাকিবের দুটো কথা পেরে একটা ভালো স্টোরি হত! কি ভেবে সাকিবকে ফোন করে বসলাম। আমাকে মোটামুটি হকচকিয়ে দিয়ে সাকিব ফোন ধরলেন এবং আরও বিস্মিত করে দিয়ে বললেন, ‘কোনো খবর জানাবেন?’

আমি তার প্রশ্ন শুনে অবাক, ‘খবর জানাবো বুঝলেন কী করে?’

সাকিব নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলেন, ‘সকাল বেলায় তো সাংবাদিকরা খবর জানতে ফোন দেয় না, জানাতে ফোন দেয়।’

আমি থতোমতো ভাবটা কাটিয়ে উঠে বললাম, ‘ভালো খবর। আপনি এখন টেস্টেও এক নম্বর’।

আমি জানি, সাকিব এই খবরটার জন্য বেশ কিছুদিন ধরে অপেক্ষা করছিলেন। তাই জীবনে প্রথম তার উৎফুল্ল প্রতিক্রিয়া পেলাম। দু দফা জিজ্ঞেস করলেন, ঠিক দেখেছি কি না! নিশ্চিত করার পর দফায় দফায় ধন্যবাদ দিলেন। আমার মনে হল, এটাই সুযোগ। কথাটা পেড়ে ফেললাম, ‘সাকিব, সকাল বেলায় একটা সুখবর দিলাম। একটা প্রতিদান চাই।’

‘বলেন কী? পারলে দিব।’

‘একটা এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ নেব। শর্ত একটাই, আজ দিনে আর কাউকে এক্সক্লুসিভ দিতে পারবেন না।’

সাকিব একটু চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘আমাকে একটু সময় দেন। আমি জানাচ্ছি।’

ফোন কেটে যাওয়ার পর নিজের ওপর রাগ হল-ব্যাটা পেয়েছিলে, দু লাইন কোট নিয়ে নিলেই হত! এখন কোটও হবে না, ইন্টারভিউও হবে না।

আমার জীবনটা যে ঢের ঢের ভুলে ভরা তা প্রমাণ করতে সাকিবের ফোন এলো দু মিনিট পার না হতেই। বললেন, ‘বলেন। কী কী প্রশ্ন করবেন, করেন?’

লম্বা একটা ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম। ইন্টারভিউ শেষে দুটো প্রশ্ন করেছিলাম সাকিবকে-অফ দ্য রেকর্ড। প্রথম জানতে চেয়েছিলাম, ইন্টারভিউ দেওয়ার আগে সময়টা নিলেন কেন? সাকিব হেসে বললেন, একটা জায়গায় কমিটমেন্ট আছে, সেখানে ইন্টারভিউ দেব না জানিয়ে দিলাম। দ্বিতীয়টা প্রশ্ন ছিল না, ছিল বিস্ময়-আপনি আবার কলব্যাক করবেন আশা করিনি। সাকিব উল্টো অবাক হয়ে বললেন, ‘কেন! আমি কমিট করেছি না। আমি যা কমিটমেন্ট করি, সেটা পূরনও করি।’

এই কমিটমেন্টই আসলে সাকিব।

আমি একটা ব্যাপার বুঝি, সাকিব আসলে দুই জন; বাইরের সাকিব, ভেতরের সাকিব।

প্রথমে আমাকে কথাটা বলেছিলেন তামিম ইকবাল, ‘সাকিবের সঙ্গে একবার মিশতে পারলে দেখবেন, ঘনিষ্ঠ মহলে একেবারে অন্য এক সাকিব বসবাস করে।’

যে সাকিবকে আমরা নিতান্ত পেশাদার, নির্মম বোলার হন্তারক কিংবা নির্দয় উইকেট শিকারী হিসেবে দেখি; এর বাইরে নিতান্ত অকেজো চিন্তার এক সাকিব আছেন। যে সাকিব সব জায়গায় সংক্ষেপে কথা বলে কাজ সারতে চান, কাটা কাটা কথাই যার বহিঃপ্রকাশ; সেই সাকিবকে দেখেছি অফুরান গল্পের ঝুলি খুলে বসতে।

সাকিব হলেন সেই লোক, যে কিনা স্ত্রীর অপমানের জ্বালায় ইভটিজারকে ধরে নির্মমভাবে পেটান; দশ মিনিটের ভেতর মাঠে নেমে নির্মল হাসিতে ফেটে পড়েন উইকেট পাওয়ার উল্লাসে। সাকিব সেই ক্রিকেটার, যিনি কথায়-আচরণে কাউকে পাত্তা দেন না। সাকিব সেই মানুষ, যিনি নিয়মের তোয়াক্কা করতে পছন্দ করেন না।

এই সাকিবকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

এখানে চিন্তাটা সহজ হয়ে যাবে বাইরের পেশাদার সাকিবের পাশে আপনি ভেতরের আবেগে ভরা মানুষটাকে একবার দেখতে চাইলে। আপনার চোখে যে পেশাদার ক্রিকেটার, ভেতরে ভেতরে সে একজন দায়িত্বশীল স্বামী। আপনার চোখে যে যন্ত্রের মতো পারফমার, ভেতরে ভেতরে সে ক্রোধ-ভালোবাসা লালন করা একজন মানুষ।

আরেকটা ছোক মনস্তাত্ত্বিক চিন্তা আমার আছে।

কাগজে কলমে সাকিব এখন ৩০ বছরে পা দিলেন। সাকিবের আর্ন্তজাতিক ক্যারিয়ারের বয়স দশ পার হয়ে গেছে, সাকিব বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন। কিন্তু এই যেসব আচরণ নিয়ে আমরা কথা বলছি, সে এই সাকিব নন।

আমার ধারণা, এই তারকা-ম্যাচিউরড সাকিবের ভেতর আরেকজন সাকিব বাস করে সদ্যই কৈশোরে পা দেওয়া ১২-১৩ বছর বয়সী এক সাকিব। মাগুরা থেকে এক ঝটকায় যে সাকিবকে বিকেএসপিতে নিয়ে আসা হয়েছিল। এই আমাদের রুদ্রমূর্তির সাকিবের মধ্যে এখন আটকে আছে সেই কিশোর, দুষ্টু, রাগী, কৌতুহলী সাকিব।

ওই ভেতরে বাস করতে থাকা সাকিব অল্পেই রেগে ওঠে, ওই সাকিব স্বজনের অপমান সইতে পারে না, ওই সাকিব মনে যা আসে না ভেবেই বলে ফেলে, ওই সাকিব নিয়ম মানতে শেখেনি, ওই সাকিব বিজ্ঞানের ছোটখাটো আবিষ্কার দেখে বিস্মিত হয়, ওই সাকিব কবিদের দেখে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।

এই সাকিব আর ওই সাকিব! এই দুই সাকিব মিলে আমরা মাঠে এবং টেলিভিশন পর্দায় কিছুতেই মেলাতে না পারা এক সাকিবকে দেখি আর অবাক হই।

আরেকজন সাকিব আর হাসানের কথা না বলরেই নয়।

এই সাকিব আল হাসানকে দেখলাম ২০২০ সালে। বাংলাদেশে একটা ধারণা প্রচলিত আছে, সাকিব নিজেরটা ছাড়া কারোরটা নিয়ে ভাবেন না। দেশ, দেশের ক্রিকেট, দল; এসব নিয়ে তার কোনো ভাবনা নেই। তিনি কেবলই নিজের খেলা, আইপিএল, সিপিএল, বিজ্ঞাপন; এসব নিয়ে বোধহয় ব্যস্ত।

কিন্তু আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সামগ্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলেন সাকিব আল হাসান। দেশের সব শীর্ষ ক্রিকেটারকে নিয়ে রীতিমতো অসহযোগ আন্দোলন শুরু করলেন। তাদের দাবি না মানলে তারা ক্রিকেট খেলবেন না।

কী সেই দাবি?

সেই দাবির দফার দফা পড়েও সাকিবের কোনো ব্যক্তিস্বার্থ খুজে পাওয়া গেলো না। দেশের অবহেলিত ক্রিকেটার, প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট কাঠামো, উইকেট, ঘরোয়া আম্পায়ার, গ্রাউন্ডসম্যান, পাতানো খেলা, নারীদের পাওনা; সব কিছুর জন্য এই আন্দোলন করলেন সাকিব।

এই আন্দোলনের ফল কী হয়েছে, এটা জানি না। তবে এটা বেশ বুঝতে পেরেছি যে, নতুন এক চেহারার সাকিব আল হাসান আবিষ্কার হলেন এর ফলে।

এই যে এবার লাইভে বক্তব্য দিলেন, একটা সাক্ষাতকার দিলেন বড় করে; এর ভেতর থেকেও আবার বেরিয়ে এলেন সেই সাকিব। বোর্ড কাঠামো নিয়ে কথা বললেন, পাইপ লাইন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করলেন। বেশ বোঝা গেলো, এই সাকিব কেবল নিজেকে নিয়ে পড়ে থাকার সাকিব নন। এ সাকিব ক্রিকেটের সাকিব। এ সাকিব সকলের সাকিব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link