একটু মজা করেই কথাটা বলেছিলেন। অবসাদ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছিলো। বারবার মন বদলাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত যখন দক্ষিণ আফ্রিকা যেতে রাজী হলেন, তখন প্রশ্ন উঠলো, মানসিক এই অবস্থাটা কী দক্ষিণ আফ্রিকা গেলে বদলাবে?
তিনি একগাল হেসে বললেন, ‘নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ; কে জানে, ভালোও লেগে যেতে পারে।’
তাই হলো। সাকিব আল হাসানের মনের অবস্থা তো আমরা ঠিক জানি না। তবে ব্যাটের অবস্থা দেখে বুঝতে পারি যে, দক্ষিণ আফ্রিকা তার ভালো লাগতে শুরু করেছে। প্যাসেঞ্জার থেকে প্রথম ম্যাচেই ড্রাইভার হয়ে গেছেন দলের।
কী অনায়াস ভঙ্গিতে ছক্কাগুলো হাকালেন। বিশেষ করে লং অফকে যেনো বেছে নিয়েছিলেন আজ নিজের পছন্দের জায়গা হিসেবে। হাসতে হাসতে ব্যাট চালাচ্ছিলেন। এই সাকিবকে দেখে কে বলবে যে, তিনি প্রচণ্ড এক ঝঞ্ঝা পেছনে ফেলে এই দক্ষিণ আফ্রিকায় এসেছেন।
সে কী একটা অবস্থা!
সাকিব এখন আছেন এক ভয়াবহ সময়ের টানাটানি ও ছোটাছুটির মধ্যে। কেবল ক্রিকেট আর বিজ্ঞাপনকে সময় দিলেই তো তার চলছে না। সাকিব আজ ব্যাংক করছেন, কাল রেস্টুরেন্ট করছেন, শেয়ার বাজারে নামছেন, সোনার ব্যবসা করছেন, মোনার্ক মার্ট করছেন। সম্প্রতি সাকিব আর তার অংশীদারেরা মিলে বাজারে এনেছেন নতুন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান মোনার্ক মার্ট। এই প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে বিপিএলে বরিশাল বুলস আর আফগানিস্তান-বাংলাদেশ সিরিজে আফগানিস্তানের জার্সি স্পন্সর করেছে।
ক্রিকেট, বিজ্ঞাপন, ব্যবসা; এই তিনটেও হয়তো শিডিউল মেলানো সম্ভব ছিলো। কিন্তু এর সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে, সাকিবের প্রায় প্রবাসী হয়ে ওঠা।
সাকিবের পরিবার প্রায় স্থায়ীভাবেই যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করে। স্ত্রী, সন্তানরা সেখানে থাকেন। ফলে তাকে নিয়ম করে যুক্তরাষ্ট্রে ছুটতে হয়। সেখানে একটু হলেও থাকতে হয়। নিজেই বলেছেন, আমেরিকাতে যাতায়াতই তার বড় একটা সময় নিয়ে নেয়।
আর এই ছোটাছুটি করতে গিয়ে এবং আইপিএলে দল না পাওয়া মিলিয়ে সম্ভবত একটা অবসাদের মধ্যে চলে গিয়েছিলেন। ক্রিকেটারদের এরকম অবসাদগ্রস্থ হওয়ার ঘটনা নতুন কিছু নয়। সাকিব এর আগেও এরকম চূড়ান্ত সীমায় চলে গেছেন বলেও জানা গেছে। ফলে মানসিক স্বাস্থ্যকে হেলাফেলা করার উপায় নেই। আর এই মানসিক কারণেই তিনি চাচ্ছিলেন খেলা থেকে একটু দূরে থাকতে।
প্রথমে বোর্ডের কাছে লম্বা সময় টেস্ট থেকে বিরতি চাইলেন। বোর্ড ছুটি দিলো। এরপর আবার বললেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় যাবেন। আবার ক দিন পর দুবাই যাত্রার সময় বিমানবন্দরে একেবারে ভেঙে পড়লেন। বললেন, এভাবে আর পারছেন না। তিনি মনে করছেন, একেবারে নিজের বিরুদ্ধে খেলছেন দলের হয়ে।
সে সময় বলেছিলেন আফগানিস্তান সিরিজে নিজেকে দলের সাথে ‘প্যাসেঞ্জার’ বলে মনে হয়েছে। সাকিব বলছিলেন, এভাবে তিনি খেলতে চান না। এভাবে খেলাটা নিজের সাথে, দলের সাথে প্রতারণা বলে মনে হয়। আর সে জন্য আদৌ দক্ষিণ আফ্রিকায় যাবেন না বলে জানালেন।
এর মধ্যে দেশে সোরগোল শুরু হয়ে গেলো। সাকিব এ অবস্থায় দেশে ফিরে বোর্ড সভাপতি ও বোর্ডের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করলেন। অবশেষে বোর্ড সভাপতির সাথে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে জানালেন, তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা যাচ্ছেন। আর যাওয়ার আগে বললেন, তিনি এবার ড্রাইভার হতে চান।
একেবারে চাওয়া পূরণ করেই শুরু করলেন সফরটা। নিজের প্রথম ইনিংসেই তুলোধুনো করে দিলেন এনগিডি, রাবাদা, ফেলুকাওদের। হ্যা, অল্পের জন্য সেঞ্চুরিটা মিস করেছেন। যেটা একেবারেই দেখা যাচ্ছিলো। সে সেঞ্চুরি মিস করলেও সাকিবের এই ছন্দটা অনেক বড় পাওয়া হলো।
কেবল অবসাদের এই সময়টায় নয়। গত ২০১৯ বিশ্বকাপের পর থেকেই ব্যাটে সাকিব নিজেকে খুজে পাচ্ছিলেন না। একটু রিফ্লেক্সের অভাব মনে হচ্ছিলো। সেই সাকিব দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে বিশ্বসেরা সব ফাস্ট বোলারদের বিপক্ষে অবলীলায় এমন ব্যাটিং করলে সেটা দেশের জন্য বিরাট একটা খবর হয়ে ওঠে। এই ইনিংস থেকে বাংলাদেশের বড় প্রাপ্তি সেই খবরটাই।
এই ড্রাইভার সাকিবকেই চায় বাংলাদেশ।