নেতা চেনা যায় সংকটে

বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটে কখনওই প্রথম সারির দল নয়। বাংলাদেশ দলের টেস্ট অধিনায়ক যিনিই হন, তাঁকে নিয়ে সব সময়ই সমালোচনা বেশি হয়। কারণ দল হারলে অধিনায়ককেই তো সফলতা-ব্যর্থতার ভার নিতে হয়। দলীয় পারফরমেন্সের পাশাপাশি কেবল টেস্ট ক্রিকেটের নেতৃত্বে থাকা মুমিনুল হক সৌরভের ব্যাটিং ফর্মের হতশ্রী দশা তাঁর নেতৃত্বকে যেন আঁতশকাচের নিচে এনে ফেলেছে। বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের সুবাদে আগের চেয়ে বেশি টেস্ট ম্যাচ পাওয়ায় টেস্ট ক্রিকেট আলোচনায় আগের থেকে বেশি আসছে – দলের বারংবার ব্যর্থতায় অধিনায়কের সমালোচনা হওয়াটাই তাই আরও বেশি স্বাভাবিক, হচ্ছেও সেটাই।

এই জায়গাটায় অধিনায়ক হিসেবে আসা উচিৎ কার? এই উত্তর দিতে খুব বড় ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না। উত্তরটা সহজ – তিনি সাকিব আল হাসান। টেস্ট অধিনায়কত্বটা তিনি চাইলে তাঁর হাতেই দেওয়া উচিৎ। কথাটা আসলে সব ফরম্যাটের ক্ষেত্রেই সত্যি। সাকিব সম্ভবত লম্বা সময় অধিনায়কত্ব না করেও বাংলাদেশের সেরা অধিনায়ক।

আচ্ছা,  টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের নেতৃত্ব নিয়ে কি আমরা খুব সন্তোষজনক অবস্থানে আছি? মনে করুন তো,আমাদের বিশ্বকাপ পারফরম্যান্স এর কথা। বিশ্বকাপের অব্যবহিত পরই পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজের স্মৃতি হাতড়ে আসুন তো। প্রত্যেকটি ম্যাচেই নেতৃত্বে ছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।

আমাদের টি-টোয়েন্টি ও টেস্ট অধিনায়ক – উভয়েই একই সাথে নেতৃত্ব পেয়েছিলেন ভারতের অ্যাওয়ে সিরিজের আগে সাকিব আল হাসানের সিদ্ধান্ত আসার পর পর। অথচ টি-টোয়েন্টি পারফরম্যান্স নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা থাকলেও অধিনায়ক হিসেবে রিয়াদ কি মুমিনুলের মতোন এতোটাও সমালোচিত হয়েছেন? আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিতে তা একদমই মনে হয় না।

রিয়াদের টি-টোয়েন্টি অধিনায়কত্বের সূচনাটা সুন্দর হয়েছিল ভারতের বিপক্ষে সবশেষ টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচ জয়ী হওয়ার মাধ্যমে। কিন্তু যতো দিন গেছে, সময়ের সমানুপাতে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের অধিনায়কত্বের দুর্বল জায়গাগুলো দিনের আলোর মতোন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

মাঠের অধিনায়ক হিসেবে তার দুর্বলতার জায়গা প্রথম বড় আকারে খেয়াল করি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে চতুর্থ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে। যে ম্যাচে ১০৫ রান চেইজ করতে যাওয়া অস্ট্রেলিয়া সাকিবের বলে ড্যান ক্রিশ্চিয়ানের পাঁচ ছক্কায় দুর্দান্ত শুরুর পরও এক সময় ৬৫ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলে। হাতে প্রায় ১০ ওভার বাকি তখনও।

এমতাবস্থায় ম্যাচ জিততে উইকেট তোলার বিকল্প নেই। অথচ রিয়াদ দু:সাধ্য ব্যাটিং উইকেটে তাঁর স্ট্রাইক বোলারকে ব্যবহার করলেনই না, আনলেন আরও পরে, সম্ভবত ১৬ তম ওভারে। ততক্ষণে ম্যাচ প্রায় শেষ! একই উদাহরণ দেখতে পাই, বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে, যেখানে বাংলাদেশ রান ডিফেন্ড করতে গিয়ে শ্রীলঙ্কাকে চাপে ফেলে দেয়। কিন্তু রিয়াদের শেষ ওভারের জন্য মূল বোলারদের রেখে দেওয়ার নীতি আর অন্যান্য বোলারদের, ইভেন পার্টটাইমার হিসেবে নিজেকে ব্যবহার করার ফলে বাড়তি চাপ রিলিজ হয়ে যায়।

এবং সম্ভাবনাময় জয়ের সম্ভাবনা বস্তুত এই রক্ষণাত্মক অধিনায়কত্বতেই শেষ হয়ে যায়। এরপর পাকিস্তান সিরিজেও দল নির্বাচন ইস্যুতে সিরিজের আগে তার অভিমানী বক্তব্য, মূল ম্যাচে বিপ্লবকে স্পেশালিস্ট বোলার হিসেবে খেলিয়ে বল না করানো, সিরিজের শেষ বলের নাটকীয়তায় তার অবস্থান, দলীয় পারফরম্যান্স-কোনোটিই একজন অধিনায়ক সম্পর্কে ইতিবাচক বার্তা দেয় না।

বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে সৌম্য-লিটনকে ওপেন করানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে পরের ম্যাচেই সৌম্যকে ড্রপ করে নাইমকে খেলানো,ফলশ্রুতিতে একাদশে খেলোয়াড়দের জায়গা নিয়ে নিশ্চয়তা প্রদান করতে না পারা, পাকিস্তান সিরিজে মুশফিককে ব্যক্তিগতভাবে দলে চাইলেও সেটা আদায় না করতে পেরে মিডিয়ায় আবেগী বক্তব্য দেওয়া, পেশাদার ক্রিকেটে ব্যাথানাশক ওষুধ খাওয়ার মতোন অজুহাত দেওয়া, বিপ্লবের উপর রিয়াদের দৃশ্যমান আস্থা না থাকা সত্ত্বেও তাকে দলে রাখা-এসব ই ইঙ্গিত করে দল গঠনে ও পরিকল্পনায় রিয়াদের সাহস ও আধিপত্যের জায়গাটাও যথেষ্ট প্রশ্নের অবকাশ রাখে।

অধিনায়ক রিয়াদ পারফর্মার হিসেবে কেমন?

মিরপুরের স্লো, লো স্পিন উইকেটে রিয়াদের ম্যাচজয়ী ১০০ স্ট্রাইকরেটের টি-টোয়েন্টি ইনিংস থাকলেও ব্যাটিং উইকেটে তার স্ট্রাইক রেট ও অ্যাবিলিটি যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। ফিনিশার হিসেবে খেললেও তার রিফ্লেক্স আগের মতোন নেই। ছয় হাঁকাতে ডাউন দ্য উইকেটে আসলেও বেশিরভাগ সময়ই ব্যাটে বলে কানেকশন হয় না, ব্যাটে-বলে হলেও বল অধিকাংশ সময়ই বাউন্ডারি পার হবার আগেই ফিল্ডারের হাতের তালু খুঁজে পায়।

বিপিএলে হাই প্রোফাইল টিম নিয়েও অধিনায়ক ও পারফর্মার হিসেবে ছিলেন ব্যর্থদের মিছিলেই। সম্প্রতি বিভিন্ন ম্যাচে রিয়াদের নিয়মিত ক্যাচ মিস আর মাঠে ভঙ্গুর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ-এই ধরনের দৃষ্টিকটু ব্যাপারগুলো পেশাদার ক্রিকেটের জায়গায় কোনো যুক্তিতেই ধোপে টেকে না।

মুমিনুলের রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে সাকিব আল হাসানকে নিয়ে মিডিয়া আলোচনা করলেও নিয়মিত টেস্ট খেলতে অনাগ্রহী ও বিপিএলে একক নেতৃত্বগুণে দলকে ফাইনালে তোলা সাকিব কি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের নেতৃত্বের জন্যই সবার আগে বিবেচিত হওয়া ডিজার্ভ করেন না? টি-টোয়েন্টির মতোন হাই ইন্টেন্সিটি ম্যাচে একজন প্রো-অ্যাক্টিভ, আক্রমণাত্মক, ট্যাক্টিক্যালি সেরা অধিনায়ক সাকিবের সার্ভিস মিস করা বাংলাদেশের একজন ভক্ত হিসেবে আমার জন্য কষ্টের।

মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, যার টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অ্যাবিলিটি, স্ট্রাইক রেট,ব্যাটিং এপ্রোচ, বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, অধিনায়ক হিসেবে দল নির্বাচনে ভূমিকা, একাদশে নির্ভরতার জায়গা তৈরিতে ব্যর্থ হওয়া, ট্যাকটিক্যাল দুর্বলতা – এতসব ত্রুটি নিয়েও বলতে গেলে সিনিয়র ইমেজ নিয়ে সমালোচনার বাইরে আছেন।

আমি বিশ্বাস করি, টেস্ট ক্রিকেটে দীর্ঘমেয়াদী প্রসেসের বাইরে ভাল করা কঠিন হলেও উপযুক্ত ইতিবাচক নেতৃত্বে আমাদের অ্যাভেইলেবল রিসোর্স দিয়েই টি-টোয়েন্টির পারফরমেন্সে তুলনামূলক দ্রুত উন্নতি করা সম্ভব। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বর্তমান কাপ্তানের ধারাবাহিক শোচনীয় ব্যর্থতার পরও সাকিবের মতোন খেলোয়াড়ের অধিনায়কত্ব মিস করা সাকিবের জন্য নয়, বরং বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্যই আসলে আফসোসের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link