মম ললাটে রুদ্র-ভগবান, জ্বলে রাজ-রাজটীকা, দীপ্ত জয়শ্রীর!
সাকিব আল হাসান ঠিক এই রাজটীকার মত। বাংলাদেশের ললাটে যা দীপ্তিমান শিখার মত জ্বলছে। সেই শিখা কখনও বাংলাদেশের সামনে থাকা কাউকে পুড়িয়ে দেয়, কখনও বা সেই শিখার তেজ নিজের কপালেই ফোস্কা ফেলে দেয়। কিন্তু সেই শিখা কখনও নিভে যায়না। তা জ্বলতে থাকে, যতটা সেই শিখার উত্তাপ তার সবটা নিয়ে।
সাধারণত কাউকে নিয়ে লিখতে গেলে তাঁর অর্জন নিয়ে লিখতে হয়, আর সে যদি ক্রিকেটার হয় তাহলে তো আর কথাই নেই। কখন অভিষেক, ক্রিকেটের সাথে বেড়ে ওঠা কিভাবে, কত সালে কত রান করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সাকিব আল হাসানকে নিয়ে এসব তো সবাই জানে।
আজকে তাই একটু বাড়াবাড়ি করা যাক, সাকিব আল হাসান একজন ভক্তের চোখে কেমন সেটা লেখা যাক। আরো বিশেষ করে বললে ২০০৭ এর আশেপাশে খেলা দেখা শুরু করা কারো কাছে সাকিব আল হাসান কেমন সেটা।
এই সময়টা কেন? কারণ এসময়টাতে যারা খেলা দেখা শুরু করেছে তাদের কাছে সাকিব আল হাসান নামটার একটা আলাদা আবেদন আছে। এই সময়টাতেই সাকিবের শুরু, এই সময়টাতেই সাকিবের উত্থান, তাই এই সময়টাতে খেলা দেখা ভক্তদের কাছে সাকিব এক অন্য নাম। যে নাম ঐ সময়ের কিশোরদের ক্রিকেটে টেনে নেয়, ক্রিকেটে মজে থাকতে শেখায়!
বলতে দ্বিধা নেই, আমিও ঐ সময়েরই একজন!
সাকিব আল হাসানের যখন উত্থান তখন বাংলাদেশের বিশ্বব্যাপী সুপারস্টার বলতে মোহাম্মদ আশরাফুল। সেই আশরাফুলেও আবার তখন অরুচি ধরতে শুরু করেছে। কারণটাও স্বাভাবিক। আশরাফুল নামেন, চোখ ধাঁধানো শট খেলেন, আর অল্প কিছু রানেই প্যাভিলিয়নে ফিরে যান। আশরাফুল ছাড়াও আমাদের ছিলেন একজন মাশরাফি, যিনি কিনা ঐ সময়টাতে ইনজুরির ছোবলে দলে থাকেন যাওয়া আসার মধ্যে। এমন ‘এই আছে এই নেই’ সুপারস্টার শূন্যতার মাঝে দলে আগমন ঘটে সাকিব আল হাসানের।
‘সাকিব আল হাসান কি’ এমন একটা প্রশ্ন তখন থেকেই ছিল। মানে বলতে চাইছি, আমরা তো জানি তিনি অলরাউন্ডার। কিন্তু তিনি কি আসলে ব্যাটিং অলরাউন্ডার নাকি বোলিং অলরাউন্ডার? এমন প্রশ্নে এখন আমরা জানি তিনি হলেন একজন পুরোদস্তুর অলরাউন্ডার। যিনি ব্যাটিং করেন নিখাদ ব্যাটসম্যানের মত। আর বোলিং করেন নিখাদ বোলারের মত। কিন্তু তখন চিত্রটা এত পরিষ্কার ছিল না। বিশেষত জ্যাক ক্যালিস, শেন ওয়াটসনের সময়ে এই জীবনানন্দের বাংলায়ও এমন অলরাউন্ডার আসবে? অলীক কল্পনা নয় তো?
নাহ, অলীক কল্পনা নয়। সত্যি। তিনি এসেছিলেন। শঙ্খচিল শালিকের বেশে আসেননি। এসেছিলেন সাকিব আল হাসান হয়েই। ২০০৭ এর আগের একটা সময়। তখন সাকিব নামের ছেলেটা বাংলাদেশ দলে নতুন এসেছে। দলে থাকা মাশরাফিকে সেদিনের কোচ প্রস্তাব দিয়ে বসলেন, তুমি তো সবাইকে পেটাও। এই ছেলেটাকে পেটাও তো দেখি।
মাশরাফি পেটাতে পারেননি। সেটা নিয়ে অবশ্য মাশরাফির মনে কোন ক্ষোভ নেই। অনুজকে নিয়ে সেটা মাশরাফির আর কবেই বা ছিল! সেই যে শুরু, সাকিব এরপর চলতে শুরু করলেন নিজের মত করে। নিজের মত করে কেন বললাম? ঐ যে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অভিষেকের একটা গৎবাঁধা প্রথা আছে না? তরুণ কেউ অভিষিক্ত হবে, এসেই বিশ্ব কাঁপানো পারফর্ম করবে- সাকিব আল হাসানের শুরুটা অমন ছিল না। পুরো বিশ্ব যার পায়ে বছর কয়েক পর নুয়ে পড়বে সেই সাকিব আল হাসানের শুরুটা ছিল বিশ্বকে কোনরকম জানান না দিয়েই!
সাকিব আল হাসানের ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে যায় কোথায়? মাশরাফির মতে শ্রীলঙ্কার সাথে যেদিন তিনি ৯১ রানের ইনিংস খেললেন, সেদিনই সাকিব আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের স্বত্ত্বা খুঁজে পেয়েছিলেন। এই মত সর্বাংশেই সত্য, সেই যে ৯১ রানের এক ইনিংস খেললেন তিনি- এরপর যেন সাকিবের ব্যাটিং আরো প্রাণবন্ত হয়ে উঠল । সেই ব্যাটিং অবশ্য চোখের আরাম দেয়না, কিন্তু সেই ব্যাটিং শিরায় শিরায় গড়ে তোলে রোমাঞ্চ আর শিহরণের স্ফুরণ!
শ্রীলঙ্কার সাথে ৯১ রানের ইনিংস খেলে তিনি নিজের ব্যাটিং স্বত্ত্বার পরিচয় তো দিয়ে দিলেন, কিন্তু বোলিংটা? বোলার সাকিবকে আলোয় নিয়ে আসেন সাকিবের প্রিয় গুরু জেমি সিডন্স!
নিউজিল্যান্ডের সাথে চট্টগ্রাম টেস্টের আগের ঘটনা।বাংলাদেশ দলে কোন বিশেষজ্ঞ স্পিনার ছিল না। সাগরিকার ধুলার পাড়ে বাংলাদেশ খেলতে নামছে কোন স্পিনার ছাড়াই সেটা আবার হয় নাকি? চারিদিকে আলোচনার পর সেটা নিয়েই যখন জেমি সিডন্সকে জিজ্ঞেস করা হল, সিডন্সের সাফ উত্তর- ‘কেন সাকিব আছে না?’
সিডন্সের ‘সাকিব আছে না?’ র উপলব্ধি প্রমাণের দায় ছিল সাকিবের ওপর। এত বছর পর আমরা জানি, সাকিব সেই দায় সুদে আসলে শোধ করেছেন। দক্ষিন আফ্রিকার মত স্পিনারদের জন্যে অপয়া উইকেটেও তিনি পাঁচ উইকেট নিয়েছেন, দেশে বিদেশে যেখানেই খেলেছেন মুড়ি-মুড়কির মত আর্মার ছুঁড়েছেন। বিশ্বজুড়ে চলা রমরমা ফ্রাঞ্চাইজি লিগের কোন পিচই সাকিবের বোলিংয়ের সামনে বাঁধা হতে পারেনি। পারবেই বা কিভাবে? সাকিব বলগুলো যে শুধু হাত দিয়ে না, মাথা খাটিয়েও করেন!
সাকিব আক্রমণাত্মক খেলতে পছন্দ করেন। ক্যারিয়ারের ঊষালগ্ন থেকেই নিজের আচরণে সেই ভাব তিনি প্রকাশ করে এসেছেন। ঘরের মাঠে তিনি অবাধ্য দর্শকের দিকে তেড়ে গেছেন, সাইডস্ক্রিন থেকে সরে যেতে বলেছেন। ক্রিকেটের ভাষায় এটা ‘কোড অফ কন্ডাক্ট’ ভঙ্গ করা, কিন্তু সাকিবের ভাষায়? খুব সম্ভবত আসছে বছরগুলোতে অনেকগুলো বিতর্কের শুরু!
সাকিব আল হাসান একটা সময় অধিনায়কত্বও পেয়েছেন। মাঠে আর মাঠের বাইরে দুই জায়গাতেই তিনি ঐ অতটুকু বয়সে ছিলেন নেতৃত্বের আলোয় ভাস্বর। সেসময়ের সাকিবের সাথে এসময়ের সাকিবের অবশ্য বেশ কিছু পার্থক্য আছে। তবে ঐ সময়ের সাকিবও জাত নেতা হিসেবে কম আলোয় আসেননি। মাঠের ক্রিকেটে তো তিনি সামনে থেকে পারফর্ম করেছেনই, মাঠের বাইরেও তিনি দলকে আগলে রেখেছেন সামনে থাকা নেতার মতই। ঐ যে সেই ঘটনাটা মনে আছে? বিসিবির সেসময়কার সভাপতি যখন ক্রিকেটারদের নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তুললেন, সাকিব সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে বললেন, ‘কোনো ক্রিকেটারই হারতে মাঠে নামে না।’
সেই ঘটনা নিয়ে সেসময় তো কম জল ঘোলা হয়নি। অবশ্য সাকিবকে নিয়ে জল ঘোলা কখন হয়না? তিনি যেটাই করেন সেটাই যেন শিরোনাম হয়ে যায়। তিনি আচরণবিধি ভাঙ্গেন, আমরা সাকিবের সমালোচনা করি, সাকিবের ওপর বিরক্ত হই কিন্তু মজার ব্যাপার হল, আমরা কখনও সাকিবের চিন্তা থেকে নিজেদের সরাতে পারিনা। সাকিব আমাদের চিন্তার অনেকটা অংশ জুড়ে থাকেন। সেই চিন্তা কখনও উনিশ বিশ্বকাপে অমানবিক পারফরম্যান্সের সূত্র ধরে হয়, কখনও বা হয় আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে নিষেধাজ্ঞা থেকে।
অনুপম রয় গেয়েছিলেন, ‘শহরতলী জুড়ে গলির মোড়ে মোড়ে, তোমায় নিয়ে গল্প হোক।’ তিনি সাকিবকে ভেবে গান গাননি, কিন্তু সাকিবকে নিয়ে গল্প যেন এই শহরের প্রতিটা ধূলিকণাতে মিশে থাকে!
সাকিবকে মাঝেমধ্যে আমার মনে হয় ক্রিকেটদেবীর খামখেয়ালি রাজপুত্র। ইংল্যান্ডের সাথে টেস্ট ম্যাচটার কথাই ধরুন না, সেদিন সকালে সাকিব থাকায় তো আমরা সবাই ভেবেছিলাম এই টেস্টটা বুঝি জিতেই যাব। কিন্তু সাকিব কি করলেন? দিনের শুরুতে মঈন আলীকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে দলকে ডুবিয়ে প্যাভিলিয়ন ফিরে এলেন।
আর সেই সাকিবই কয়েক বছর পর গোটা একটা বিশ্বকাপই নিজের রঙে রাঙিয়ে নিলেন। সেই বিশ্বকাপে তিনি এমন পারফর্ম করলেন যেটা কোন চোখ কোনদিন দেখেনি, কোন কান কোনদিন শোনেনি। সেই বিশ্বকাপে সাকিবের পারফরম্যান্স এতটাই অমানবিক ছিল যে আফগানিস্তানের সাথে এক ম্যাচে সাকিব ফিল্ডিং মিস করলে ইয়ান স্মিথ ধারাভাষ্যকক্ষ থেকে বলে ওঠেন, ‘হি ইজ আ হিউম্যান! সাকিব আল হাসান ইজ অফিশিয়ালি আ হিউম্যান।’
আসলেই তাই। ফুটবলে কেউ অতিমানবীয় কিছু করলে তাকে ভিনগ্রহের ফুটবলার বলা হয়, ক্রিকেটে এসবের চল নেই। থাকলে হয়তো সাকিবকে আমরা ভিনগ্রহের ক্রিকেটার বলতে পারতাম। তা না থাকুক, কিন্তু ‘অফিশিয়ালি হিউম্যান’ সাকিবও যা করে চলেছেন তাতেও মাঝে মাঝে ভ্রম হয়- আসলেই মানুষ তো!
উনিশ বিশ্বকাপের সময়টার কথা তো বললাম। বিশ্বকাপ পরবর্তী ঘটনাটাও বলা যাক। ওটাও তো সাকিবেরই অংশ। জুয়াড়ির প্রস্তাব গোপন করেছিলেন। শাস্তিও পেয়েছিলেন। তবে এটুকুর মধ্যেও সবচাইতে বড় যে ব্যাপার, এতবড় একটা পাপ করেও সাকিব আল হাসান সবসময়ই আকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েছেন তাঁর সমর্থকদের কাছ থেকে। এই সমর্থন পাওয়া ভাল হল না খারাপ হল সে বিতর্কে যাব না, কিন্তু এই যে অপরাধ করে শাস্তি মাথায় নিয়েও এতবড় সমর্থন পাওয়া এটা মনে হয় সাকিব না হলে সম্ভব না।
সাকিব ব্যাক্তিগত জীবনে সমর্থন করেন লিওনেল মেসিকে, কিন্তু সাকিবের কাজ, সাকিবের কথা প্রতিটা পদক্ষেপই মনে করিয়ে দেয় লিওনেল মেসিরই চিরপ্রতিদ্বন্দী ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকেও। রোনালদোর মতই অমানসিক মনের জোরে সাকিব খেলে যাচ্ছেন আপন গতিতে, সেই মনের জোর এতটাই প্রগাঢ় যে ইনজুরি থেকে ফিরে মাত্র কয়েক সেশন নেটে কাটিয়েই তিনি উড়াল দেন নিদাহাস ট্রফির ম্যাচ খেলতে! সাকিব আল হাসান- আপনি পারেন কিভাবে?
আগেই বলেছি, সাকিবও মানুষ। সাকিবেরও ভুল হয়। সাকিবও বিতর্কিত কাজ করেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, সাকিবকে আমরা বাদ দিতে পারিনা। শাহরুখ খানের ঐ যে একটা কথা আছে না? ‘আপনি আমাকে ভালবাসতে পারেন কিংবা ঘৃণা করতে পারেন, কিন্তু আপনি আমাকে ইগনোর করতে পারবেন না।’
ঠিক তাই! সাকিবকে আমরা আমাদের চিন্তা থেকে কোনদিনই বাদ দিতে পারিনি। তিনি হয় আমাদের সুখ হয়ে ডোপামিন নিঃসরণের কারণ হয়েছেন, নতুবা আমাদের মাথাযন্ত্রণার উপলক্ষ্য হয়েছেন কিন্তু আমরা কখনওই আমাদের মাথা থেকে সাকিবকে সরাতে পারিনি। মনে হয়না আর কখনও পারব। শেষ বিতর্কে তিনি বলেছিলেন তিনি দেশের ম্যাচ চলাকালীন আইপিএল খেলবেন, আমরা অনেকেই সমালোচনা করেছি কিন্তু আমরা নিশ্চিত জানি আইপিএলের ম্যাচ চলাকালীন এই আমরাই আবার সাকিব স্কোয়াডে আছেন কিনা খোঁজ নিতে শুরু করব। ভিনদেশে একটা লিগে সাকিব কি করছেন সেটা নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলব।
শুরু করেছিলাম কাজী নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা দিয়ে, এই কবিতাতেই সাকিবের সাথে মানানসই আরেকটা লাইন দিয়েই শেষ করব এই লেখা-
আমি নৃত্যপাগল ছন্দ/ আমি আপনার তালে নেচে যাই/ আমি মুক্ত জীবনানন্দ