আপনি ঘৃণার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শেষপর্যন্ত ভালবাসার পক্ষে ছিলেন

ইনি সেই মোহাম্মদ শামি যাঁর ভাই মোহাম্মদ হাসিবকে ঠিক ৬ বছর আগে মধ্যপ্রদেশে পুলিশ গ্রেফতার করে। কারণ? তাঁদের মহল্লায় গো-হত্যার অভিযোগ এনে একঘর মানুষকে হেনস্থা করা হচ্ছিল।

শামির ভাই তা দেখতে এগিয়ে যান। এই তাঁর অপরাধ।

শামিকে আক্রমণ করে ধেয়ে আসে বাছা বাছা বিশেষণ। কোচিতে প্র‍্যাকটিস সেশনে শামিকে উদ্দেশ্য করে ছোঁড়া হয় কমিউনাল স্ল্যাং। পরে প্রমাণিত হয় গো-হত্যার সেই অভিযোগ ভিত্তিহীন। শামি ও তাঁর পরিবারকে টার্গেট করা হয়েছিল, কারণ?

তাঁর নাম- মোহাম্মদ শামি।

ইনি সেই মোহাম্মদ শামি, ঠিক দু’বছর আগে বাবর আজমের পাকিস্তানের কাছে দশ উইকেটে হারের পর যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে তিনি পাকিস্তানের থেকে টাকা খেয়ে বোলিং করেছেন। ভারতীয় দলে তখনও মোহাম্মদ সিরাজ নিয়মিত হননি।

সেই ম্যাচের একমাত্র সংখ্যালঘু খেলোয়াড় ছিলেন শামি। যাঁকে আগলাতে এগিয়ে আসতে হয়েছিল স্বয়ং বিরাট কোহলিকে।

ইনি সেই মোহাম্মদ শামি যাঁর স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলে বিচারবিভাগীয় তদন্তেরও আগে নীতিপুলিশেরা নিদান দিয়ে দেন যে তাঁর নাম ও পদবীর কারণে এমন কাজ তাঁর পক্ষে করা অস্বাভাবিক নয়।

মোহাম্মদ শামি এই বিশ্বকাপে তিন ম্যাচে ১৪ উইকেট নিয়েছেন। ভারতের হয়ে বিশ্বকাপে শামির উইকেট সংখ্যা ৪৫; ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী তিনিই ৷

জোড়া ফিফার, হ্যাটট্রিক- সহ বিশ্বক্রিকেটের বৃহত্তম মঞ্চে বোলিং বিভাগের প্রায় সব রেকর্ড তাঁর ঝুলিতে। ভারতের বিশ্বজয়ের স্বপ্ন যতখানি রোহিত-কোহলির ব্যাটে, ততখানিই মোহাম্মদ শামির কব্জিতে।

মজা হল, এই সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে মানুষ চেনা যায় না। আলোর ভেতর চোখ ঝলসে যায় সকলের। এই সময়ে কেবল অবজার্ভ করে যেতে হয়। নি:শব্দে। মোহাম্মদ শামিকে এখন ভারতের দরকার। হিংস্র শকুনেরা জানে সে কথা। ভিড়ের মাঝে মিশে থাকে, হাততালি দেয়। ক্যামোফ্লেজে নিজেদের লুকিয়ে রাখে।

মোহাম্মদ শামি, আপনার বুটমার্ক থেকে ক্রিজ অবধি রান আপের মাঝে দুটো ভারতবর্ষ আছে। আর আপনি, কেবল আপনিই দুটো ভারতবর্ষকেই হাতের তালুতে থাকা বলের সিমটার মতো চেনেন। আপনি নিশ্চিতভাবেই জানেন, আজকের এই হাততালির শব্দ, সবটুকু সৎ নয়।

একটা ব্যর্থতা আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে একটা অন্য ভারতবর্ষে। তবু, আপনি উইকেট নিয়ে আলবাট্রসের ডানার মতো দু-হাত মেলে ছুটে যান। ওভাবে আরও একজন মানুষ দু-হাত মেলে তিরিশ বছর ভালবাসা ফেরি করে চলেছেন। তাঁকেও ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে পাকিস্থানে চলে যাওয়ার নিদান শুনতে হয়।

আপনার বোলিং অ্যাকশনের শেষে ঐ ফলো আপ, উইকেট তুলে নিয়ে দু-হাত মেলে বৃদ্ধ জটায়ুর মতো অসম লড়াই লড়ে যাওয়া আসলে দ্বিতীয় ভারতবর্ষকে, হিংসার ভারতবর্ষকে, ঘৃণার ভারতবর্ষকে ভালবাসার চাদরে মুড়ে দিতে চাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। আপনি বিশ্বকাপের শ্রেষ্ঠ বোলার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় সফল হবেন, এ ভরসা আমাদের আছে, কিন্তু এই অসহিষ্ণু ভারতের মুখোমুখি লড়াই? সে যে অসম!

মোহাম্মদ শামি, আপনি জিতুন বা হারুন, আমরা জানব, বিশ্বাস করব, এতকিছুর পরেও আপনি ঘৃণার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শেষপর্যন্ত ভালবাসার পক্ষে ছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link