আন্দ্রে শেভচেঙ্কো: ইউক্রেনের আসল নায়ক

জুন ১১, ২০১২; ২-১ গোলের সেই জয় ছিল ইউক্রেনের ইতিহাস কাঁপানো এক জয়। সুইডেনের বিপক্ষে সে জয় ছিল ইউরো ইতিহাসে তাঁদের প্রথম জয়!

২৯ জুন, ২০২১; প্রতিপক্ষ সেই সুইডেন, অতিরিক্ত সময়ের শেষ মিনিটে এসে তুলে নেয় জয়। ব্যবধান সেই ২-১, নিজেদের ইউরো ইতিহাসে প্রথমবারের মতন কোয়ার্টার ফাইনালে নাম লেখায় ইউক্রেন।

দুই গল্পের মধ্যে একটা মিল আছে, দুই গল্পেরই হটসিটে বসা লোকটার নাম আন্দ্রে শেভচেঙ্কো। ৯ বছর আগের সে রাতে উইনিং গোল করা লোকটা আর ৯ বছর পরে কোচের সিটে বসে থাকা লোকটা যে একজনই।

৯ বছরে ইউক্রেনের ইতিহাসে জিতেছেন, ব্যর্থ হয়েছেন, আবারও ঘুরে দাড়িয়েছেন। গত ৯ বছরে সফলতা, ব্যর্থতা, সবটাই দেখা হয়েছে তার। একসময় ডি-বক্সের ভেতরে ভয়ানক মানুষটা জীবনের সবটাই দেখে ফেলেছেন গত ৯ বছরে।

একসময় এসি মিলান, চেলসি কাঁপানো স্ট্রাইকার ২০১২ সালেই ফুটবলকে বিদায় বলে দিয়েছিলেন। ৩৬ বছর বয়সে যে তার ধার ফুরিয়ে গিয়েছিল তা কিন্তু নয়, বরং ডায়নামো কিয়েভের হয়ে ভালোই চলছিল তার ক্যারিয়ার, ইউরোতেও প্রথম জয় এনে দেওয়া স্ট্রাইকার পরের বিশ্বকাপের জন্য লড়বেন, এমনটাই আশা ছিল লোকেদের।

কিন্তু, তাদের হতাশ করে শেভচেঙ্কো ইউরো শেষ করেই বললেন, ফুটবল আর নয়। আমি বরং দেশের সেবা করতে চাই। এতদিন দেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছি খেলা দিয়ে, এখন হাসি ফুটাতে চাই কাজ করে। আর সেটা রাজনীতিতে যোগ দিয়ে।

তার রাজনীতিতে যোগ দেওয়াটা অবাক করার মতন কিছু ছিল না। নিজ চোখে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গতে দেখেছেন, চেরনোবিল ধ্বংস হতে দেখেছেন, দেশের সেবা করতে চাওয়াটা ভুল কিছু নয়। সে কারণে ফুটবল ছেড়ে যোগ দিলেন ‘ইউক্রেন, গো ফরোয়ার্ড!’ পার্টিতে।

কিন্তু ফুটবলের জনপ্রিয়তা টেনে এখানে আনতে পারেননি শেভা। পুরো নির্বাচনে তার দল ভোট পায় মাত্র ১.৫৮%। সে দেশের সংসদে কোনো সিটই নিতে পারেনি তারা। বলতে গেলে ফুটবল ক্যারিয়ারের পুরো উল্টো অবস্থা হয় রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে।

আরও কিছুদিন রাজনীতিতে লেগে থেকেছিলেন বটে, কিন্তু তাতে কোনো কিছুই হচ্ছিল না। অন্যদিকে ইউক্রেনের ফুটবলও খুব একটা সাফল্যের মুখ দেখছিল না। ফলে ঘুরে ফিরে শেভচেংকোর দিকেই হাত বাড়াতে চাইলো তারা। একে তো কোচের কন্ট্রাক্ট শেষের পথে, অন্যদিকে দলও ভালো করছে না।

সামনে ইউরো। সবমিলিয়ে দলের নতুন কোচ হিসেবে শেভাকেই নিতে চাইলেন অনেকে। অনেকে আবার কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়া একজনকে এনে বসিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন না। ফলে সবাই মিলে ঠিক হলো এক জায়গাতেই, কোচ হিসেবে আসছেন শেভচেঙ্কো, কিন্তু মূল নয় বরং আগের কোচ মিখাইলো ফোমেঙ্কোর সহকারী হিসেবে।

২০১৬ ইউরো যতটা বাজে যাওয়া সম্ভব, ততটাই বাজে গেল। গত ইউরোতে এক জয়ের পর লোকে ভেবেছিল এবার অন্তত গ্রুপ পার করতে পারবে, কিন্তু কীসের কী? পুরো টুর্নামেন্টে জয় দূরে থাক, গোলই করতে পারেনি ইউক্রেন। ব্যর্থ মনোরথে বাড়ি ফিরল ইউক্রনিয়ানরা। আর ফিরতে না ফিরতেই সবার হাতে বিদায়ী নোটিশ ধরিয়ে দিলো বোর্ড, শুধু মাত্র শেভা বাদে!

কয়েকমাস আগেই যাকে কোচিংয়ের দায়িত্ব দেওয়া ঠিক হবে কীনা এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল, তার হাতেই এসে পড়ল জাতীয় দলের দায়িত্ব। খেলোয়াড়ের পর কোচ হিসেবে দলকে এগিয়ে নেওয়ার গুরুদায়িত্ব এখন তার উপরে। আর সে দায়িত্বই তুলে নিলেন কাঁধে।

একজন কোচের নিজের দায়িত্ব পালন করতে যেমন প্রয়োজন ট্যাক্টিক্যাল জ্ঞান, তার থেকেও বেশি দরকার তার ম্যান-ম্যানেজমেন্ট। ইউক্রেনের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই শায়নামো কিয়েভ কিংবা শাখতার দোনেস্কের খেলোয়াড়। দুই দলের মধ্যে যে রাইভালরি সারাবছর চলে তা থামে না জাতীয় দলে এলেও।

শেভচেঙ্কো এসেই দূর করলেন সেটা। খেলতেহলে এক পতাকাতলে খেলতে হবে, এখানে কোনো ক্লাব নেই, নেই কোনো নিজেদের মধ্যে মারামারি, এখানে আছে শুধু এক পতাকা। না পারলে জাতীয় দল তোমার জন্য নয়।

তাই বলে তার উপর দিয়ে কম ঝড় যায়নি। কোন কোচিং অভিজ্ঞতা ছাড়াই জাতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়া শেভার জন্য পথটা সোজাও ছিল না। মাল্টার মতন দলের কাছে হেরেছেন, একটুর জন্য মিস করেছেন বিশ্বকাপ। কিন্তু তার উপর ভরসা রেখেছে বোর্ড।

নিজেদের কিংবদন্তিকে পত্রপাঠে বিদায় বলে দেওয়ার দু:সাহস হয়নি তাঁদের। আর সেদিন সেই দুঃসাহস দেখাননি বলেই আজ এই আনন্দ উদযাপন করতে পারছেন সকলে। বিশ্বকাপ থেকে বিদায় হওয়ার পরেই উঠেপরে লাগেন পরবর্তী ইউরো আর ন্যাশন কাপের জন্য।

যার ফলাফল মিলে কয়েক মাসের মধ্যেই, ন্যাশন কাপের গ্রুপ পর্ব শেষ করেছেন সবার উপরে থেকে। শুধু তাই নয়, ইউরো কোয়ালিফায়ারেও বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি। ছিলেন পর্তুগালের সাথে এক গ্রুপে, সবাই ভেবেছিল ইউরো খেলতে হলে কম ঝক্কি পোহাতে হবে না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে রোনালদোর দলের কাছ থেকেই নিয়ে এসেছে চার পয়েন্ট। গ্রুপ লিডার হয়ে সরাসরি নিশ্চিত করেছেন ইউরো।

এক বছর দেরি করে শুরু করা ইউরো যাত্রাও তাদের মনমতো হয়নি। নেদারল্যান্ড, অস্ট্রিয়ার কাছে হেরে, কোনোমতে নর্থ মেসিডোনিয়ার সাথে জিতে নিশ্চিত করেছেন রাউন্ড অফ সিক্সটিন। সেখানেও সুইডেনের কাছে হারতে হারতে জিতেছেন, অতিরিক্ত সময়ের শেষ মিনিটে তার দল তুলে এনেছে জয়।

চাইলে বলতেই পারেন, ভাগ্যের উপর দিয়েই এতদূর এসেছে ইউক্রেন। কিন্তু ভুলে যাবেন না, ভাগ্য সর্বদা সাহসীদের পক্ষেই থাকে। শেভচেঙ্কো সেই সাহসীদের মধ্যেই একজন।

ইউক্রেন কতদূর যাবে তা আজকেই জানা যাবে। শেভচেঙ্কো ইতোমধ্যে তার খেলোয়াড়ি জীবনকে ছুঁয়ে ফেলেছেন স্যুট-টাই পরে। ইংল্যান্ডের শিরোপা বাড়ি ফেরানোর মিশন থামাতে পারলে নিজেকেই নিজে ছাড়িয়ে যাবেন। সেটা কি পারবেন ইউক্রেনের প্রিয় ‘শেভা’?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link