স্টার্লিং, দ্য স্ট্রাগলার

নিজে যে সংগ্রাম করে উঠে এসেছেন, সেই দু:সহ আর কারো হতে দিতে চান না। তাই প্রতিটি পরিশ্রম করেন, দৌড়ে চলেন মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। তিনি জানেন, তার একেকটা গোল যতটা না সাদা চামড়ার মানুষদের গায়ে জ্বালা ধরাবে, তার থেকে বেশি আনন্দধারা বইয়ে দিবে তার সন্তানের মনে, তার মতন সংগ্রাম করে বড় হওয়া আরো হাজার হাজার কালো চামড়ার মানুষদের মনে। যাদের এই সময়ে এসেও বৈষম্যের শিকার হতে হয় সব জায়গায়।

প্রতিটা ম্যাচের আগেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ কড়া কথা শুনতে হয় গ্যারেথ সাউথগেটকে। সাধারণত ম্যাচ শুরুর এক ঘন্টা আগে ঘোষণা করা হয় স্কোয়াড, আর সমালোচনার শুরু সেখান থেকেই।

বলতে ভুল নেই, গত কয়েক বছরের মধ্যে এই ইংল্যান্ড দলের মতন ট্যালেন্টেড দল আসেনি। এমনকি ইংল্যান্ডের স্বর্ণযুগেও তারকাভর্তি দল থাকলেও এত পরিমাণ ট্যালেন্টকে একসাথে দেখা যায়নি। আর এত ট্যালেন্ট নিয়েও কোচের হটসিটে বসে আছেন গ্যারেথ সাউথগেট। ট্যাক্টিক্যালি অতোটা সুপেরিয়র নন তিনি। যে কারণে বারবারই সমালোচনায় মুখর হতে হয় তাঁকে।

ম্যাচ শুরুর এক ঘন্টা আগে স্কোয়াড ঘোষণা হয়, আর পুরোটা সময় চলে সাউথগেটের মুণ্ডুপাত। এত ট্যালেন্টেড স্কোয়াড ম্যানেজ করাও সহজ কাজ নয়, কিন্তু বামপাশে প্রতি ম্যাচেই তার ভরসার পাত্র হয়ে থাকেন রহিম স্টার্লিং। গ্রিলিশ, ফোডেন কিংবা সাঞ্চোর মতন তারকাকে বেঞ্চে বসিয়ে প্রতি ম্যাচেই তাকে ভরসা করে যাচ্ছেন তিনি। সমর্থকদের ভরসা না থাকলেও দিনশেষে ইংল্যান্ডের ভরসার পাত্র হচ্ছেন ঠিকই।

জার্মানির বিপক্ষে হ্যারি কেইনের শেষ মিনিটের হেড বাদ দিলে পুরো ইংল্যান্ড ক্যাম্পেইন ছিল স্টার্লিংময়। চার ম্যাচে ইংল্যান্ডের করা তিন গোলই ছিল তার। কিন্তু তবুও কেন তাকে কথা শুনতে হয় প্রতি ম্যাচে। প্রতি ম্যাচে তার উপরেই, তার দলে থাকা না থাকা নিয়েই বারবার প্রশ্ন উঠে?

স্টার্লিংয়ের মৌসুমের শেষটা তেমন ভালো হয়নি। ম্যানচেস্টার সিটির প্রিমিয়ার লিগ জিততে তেমন কোনো ঝক্কিই পোহাতে হয়নি। বরং তাদের স্কোয়াডের উপর ভরসা করেই প্রিমিয়ার লিগ জিতে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু প্রিমিয়ার লিগের বাইরে গিয়ে যখন চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে তার প্রমাণ করার সময় এলো, তখনই ব্যর্থ হলেন স্টার্লিং। বড় ম্যাচে তার উপর ভরসা করা মানেই সিটি ফ্যানদের হতাশ হওয়া।

সেই সাথে তার দলটার দিকেও নজর দিতে হবে, ম্যানচেস্টার সিটি ইংলিশ লিগের কুলীন দলগুলোর মধ্যে এখনও ঢুকতে পারেনি। তাদের বদনাম এখনও লিগে ‘আরব মানি’ বলে। প্রতি মৌসুমেই বস্তা বস্তা টাকা খরচ করে শিরোপা জিততে থাকা দলের প্রতি সকলেই একটু নাখোশ। তাই সে দলের অফ-ফর্ম খেলোয়াড়কে প্রতি ম্যাচে মাঠে দেখাটা দর্শকদের জন্য একটু কষ্টকরই।

সেই সাথে বসিয়ে রাখা খেলোয়াড়েরাও কোন অংশে কম নয়। গত মৌসুমে অ্যাস্টন ভিলাকে একাই এতদূর টেনে এনেছেন জ্যাক গ্রিলিশ, মৌসুমে ১৬ গোল ২০ এসিস্ট করেছেন জ্যাডন সাঞ্চো। এক বছরের রিউমার শেষ করে গতকালই যোগ দিয়েছেন ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় ক্লাবে। তাদেরকে বসিয়ে যদি স্টার্লিংকে খেলানো হয় তাতে সমর্থকরা রেগে গেলে আপনি নিশ্চয় দোষ দিতে পারেন না।

আর এ বাদেও আর যদি কোনো কারণ থাকে তার বিপক্ষে কথা তোলার, সেটা শুধুমাত্র তার গায়ের রং। নাক উঁচু ব্রিটিশরা এখনও নিজেদের উঁচু করে রাখলেও তাদের মন থেকে কালোদের নিচু করে দেখার মনোভাবটা এখনও যায়নি। দিন দিন যেন সে কথা স্পষ্ট। সিটিতে থাকাকালীন সময়েও মাঠে বারবার কটু কথা শুনতে হয়েছে তাকে। তখন না হয় প্রতিপক্ষ ছিল, কিন্তু এখন এক দলের ছত্রছায়ায় এসেও এরকম কথা শুনতে পাওয়াটা কি স্বাভাবিক? যে দলকে নিজের বলে আপন করে নিয়েছেন, তাদের সমর্থকেরাই মুখ ফিরিয়ে নিলে কতটা কষ্ট হয় সেটা হয়তো স্টার্লিংয়ের থেকে ভালো আর কেউ বোঝেন না।

কিন্তু সাউথগেটের গুডবুকে সর্বদাই নাম ছিল স্টার্লিংয়ের। ২৬ বছর বয়সী তারকা জাতীয় দলের হয়ে সর্বদাই একটু বেশিই ভালো। শেষ ২০ ম্যাচে ১৫ গোল এসেছে তার পা থেকে। ইউরোতে তাই তাকে ভরসা না করার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক ফর্ম তাকে পিছিয়ে দিয়েছিল প্রথম একাদশে সুযোগ পাওয়ার অবস্থান থেকে।

কিন্তু রহিম স্টার্লিং সংগ্রাম করতে জানেন। তার জন্ম জ্যামাইকায়, ২ বছর বয়সে জ্যামাইকার রাস্তায় খুব হতে দেখেছেন নিজের বাবাকে। ৫ বছর বয়সে জ্যামাইকা ছেড়ে পাড়ি জমান লণ্ডনে, মা যখন মুখে খাবার জোটানোর জন্য কষ্ট করছেন, তখন তিনি নিজেকে খুঁজে পেয়ছেন ফুটবলে। তাই দিনশেষে যখন নিজের গায়ের রঙয়ের জন্য তাকে মাঠ থেকে দুটো শুনতে হয়, তখন আর গায়ে লাগান না তিনি। তিনি বরং ব্যস্ত থাকেন নিজের খেলা দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করানোতে। আর এখন পর্যন্ত, সেটুকুতে তিনি সফল।

৪ ম্যাচে ৩ গোল, যেখানে পুরো দলের গোলসংখ্যা ৪! ইংল্যান্ডের মূল তারকা হয়েছেন তিনি। গোলের জন্য যখন সকলের ভরসা ছিল হ্যারি কেইন, তখন সেই বাডন তুলে নিয়েছেন স্টার্লিং। ইংল্যান্ডকে এনে দিয়েছেন জার্মানির বিপক্ষে ৫৫ বছর পর এক জয়, সাউথগেটের জন্য এক ‘রিডেম্পশন’ অধ্যায়।

নিজে যে দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বড় হয়েছেন, সংগ্রাম করেছেন, সেই স্মৃতিটুকু উপহার দিতে চান না আর কাউকেই। তাই প্রতিটি মুহূর্তে নিজের জন্য, নিজে মানুষের জন্য পরিশ্রম করেন, দৌড়ে চলেন মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। তিনি জানেন, তার একেকটা গোল যতটা না সাদা চামড়ার মানুষদের গায়ে জ্বালা ধরাবে, তার থেকে বেশি আনন্দধারা বইয়ে দিবে তার সন্তানের মনে, তার মন সংগ্রাম করে বড় হওয়া আরো হাজার হাজার ইংলিশের মনে। যাদের এখনও কোনায়-কানায় শুধুমাত্র চামড়ার রংয়ের জন্য বৈষম্যের শিকার হতে হয়।

ফুটবল আবার বাড়ি ফিরবে কী না সে প্রশ্নের উত্তর এখন দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু স্টার্লিং ইতোমধ্যে হাসি ফুটিয়েছেন তার মতন সংগ্রাম করা প্রতিটি মানুষের মুখে। ইংল্যান্ডের ১০ নম্বর জার্সি গায়ে চড়িয়ে এর থেকে বড় অর্জন আর কোনো কিছুতেই নেই।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...