বলা হয়ে থাকে, সৌরভ গাঙ্গুলি দলে আসার আগ অবধি বাঙালি ক্রিকেটাররা ভারতীয় ক্রিকেটে ছিল উপেক্ষিত। তাঁদেরকে ভাবা হতো দূর্বল এবং টেম্পারমেন্টের দিক থেকে বেশ পিছিয়ে। খুব কম সুযোগই মিলতো বাঙালি ক্রিকেটারদের। অবশ্য অনেকের মতে, রাজনৈতিক দ্বন্দ্বটাও ছিল অন্যতম কারণ! যার কারণে বছরের পর বছর উপেক্ষিত ছিলেন বহু বাঙালি ক্রিকেটার। যার মধ্যে একজন ছিলেন শুঁটে ব্যানার্জি।
টানা ঘন্টাখানেক একই গতিতে বল ছুঁড়তে পারতেন তিনি। ৫.১১ ইঞ্চির দীর্ঘদেহীর শুঁটে বাউন্সারে নিয়মিত মাত দিতেন ব্যাটসম্যানদের। বলে খুব বেশি গতি ছিল এমনটাও নয়; নিজের শক্তি কাজে লাগিয়ে বল করতে পারতেন লম্বা সময় ধরে। ব্যাট হাতেও কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম ছিলেন তিনি! মূলত একজন বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবেই খেলতেন তিনি।
১৪ মে, ১৯৪৬। সকাল বেলা খবরের কাগজে শুঁটে ব্যানার্জি! আগের দিন যে রেকর্ড জুটি গড়েছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে! ওভালে সারের বিপক্ষে ‘আন অফিসিয়াল’ টেস্টে দশম উইকেট জুটিতে ২৪৯ রান করেন ব্যানার্জি ও সারওয়াতে।
প্রথম ইনিংসে ২০৫ রানে ৯ উইকেট হারিয়ে বিপাকে ইন্ডিয়ান্স দল। সেখান থেকে দশম উইকেটে ২৪৯ রান যোগ করেন ব্যানার্জি ও সারওয়াতে। ইতিহাসে প্রথমবার দশ ও এগারোতম ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েন! সারওয়াতে ১২৪ ও ব্যানার্জি করেন ১২১ রান। দশম উইকেট জুটিতে এটি প্রথম শ্রেণির ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের জুটি।
জন্ম ক্যালকাটায় (বর্তমান কলকাতা)। ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল আরিয়ান্স ক্লাবের হয়ে। এরপর সেখান থেকে পাতিয়ালা একাদশের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। বল হাতে ৩ উইকেট এবং ব্যাট হাতে করেছিলেন দুই ইনিংসে মিলিয়ে ৪১ রান। এরপর সেখান থেকে ‘হিন্দুজ’-এর হয়ে খেলার সুযোগ পান তিনি।
এরপর অস্ট্রেলিয়া যখন ভারত সফরে আসে বেঙ্গলসের হয়ে প্রস্তুতি ম্যাচে ৫৩ রানে ৫ উইকেট শিকার করেন ব্যানার্জি। মেইডেন ফাইফর শিকারের পরই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে লাহোরে আনঅফিসিয়াল টেস্টের জন্য ডাক পান তিনি। বোলিংয়ে তেমন সুযোগ না পেলেও ব্যাট হাতে দ্বিতীয় ইনিংসেই করেছিলেন ৭০ রান।
মাত্র এক টেস্টেই সীমাবদ্ধ ছিল ব্যানার্জির ক্যারিয়ার। তাও কিনা ক্যারিয়ারের শেষ সময়ে! ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ইস্ট জোনের হয়ে ভালো পারফর্ম করে ১৯৪৯ সালে সুযোগ পেলেন জাতীয় দলে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে চতুর্থ টেস্টে অভিষিক্ত হলেন ব্যানার্জি। ৩৭ বছর বয়স! ক্যারিয়ারের একদম শেষ অবস্থায়! খুব বেশি লক্ষ্য হয়তো ছিল না। তবু, কিছু একটা করে যেতে চেয়েছিলেন!
দুই ইনিংসেই প্রায়র জোনসের বোলিং তোপে পরাস্থ হয়ে ব্যাট হাতে করেন মাত্র ৫ ও ৮ রান! আর বল হাতে দুই ইনিংস মিলিয়ে শিকার করেন ১২৭ রানে ৫ উইকেট। এরপর আর সুযোগ পাননি তিনি! আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরু এবং শেষটা ছিল সেই এক ম্যাচেই। এক ইনিংসেই শিকার করেছিলেন ৪ উইকেট!
ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিতই পারফর্ম করতেন। এর আগে একবার ডাকও পেয়েছিলেন জাতীয় দলে। ১৯৩৬ সালে তখন মাত্র ২৫ বছর বয়স ব্যানার্জির। ডাক পেলেন জাতীয় দলের স্কোয়াডে। অবশ্য এর আগে রঞ্জি ট্রফিতে মাদ্রাজে এক ম্যাচে ৭৯ রানে ৬ উইকেট শিকার করেন তিনি! এরপরই ডাক পেয়েছিলেন জাতীয় দলে। ব্যানার্জির কাছের একজন পরবর্তীতে বলেছিলেন, ‘ব্যাটিং নয় বোলিংয়ের কারণেই জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিল ব্যানার্জি।’
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওই সফরে মাঠে এবং মাঠের বাইরে দলের ভেতরের অবস্থাও ভালো ছিল না। সতীর্থ ক্রিকেটারদের মধ্যেই চলছিল ঝামেলা। এমন কি সফরের মাঝ পথে সে সময়ে ভারতের অন্যতম সেরা লালা অমরনাথ দেশে ফেরত যান।
ওয়ার্ম আপ ম্যাচ গুলোতে বেশ ভালো পারফর্ম করেছিলেন ব্যানার্জি। শিকার করেছিলেন ৪০ উইকেট! ওভালে শেষ টেস্টে অভিষেকের অপেক্ষায় তখন শুঁটে ব্যানার্জি। কিন্তু অন্তিম মুহূর্তে বাকা জিলানিকে অভিষেক করিয়ে ১২তম খেলোয়াড় হিসেবে রাখা হয় ব্যানার্জিকে। এরপর দীর্ঘসময় জাতীয় দলে সুযোগ পাননি তিনি। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করলেও স্রেফ বাঙালি হওয়া সত্ত্বেই হয়তো জাতীয় দলে সুযোগ পাননি তিনি।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১৩৮ ম্যাচে ব্যাট হাতে ২১ গড়ে করেছেন প্রায় ৩৭০০ রান। ৫ সেঞ্চুরির পাশাপাশি করেছেন ১১ ফিফটি! অপরদিকে, বল হাতে শিকার করেছেন ৩৮৫ উইকেট। ১৫ বার ৫ উইকেট ছাড়াও ২ বার পেয়েছেন ১০ উইকেট!
ত্রিশ-চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি ওই সময় অনুযায়ী ব্যানার্জির ক্যারিয়ার কিভাবে দেখছেন? প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এমন অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের পরেও তিনি উপেক্ষিত থেকেছেন বছরের পর বছর!