ষাটের দশক ও পাড়ার ক্রিকেট

১৯৬৭ সাল। আমার বয়স যখন নয় এবং দশ, আমরা তখন ঢাকার ইস্কাটন গার্ডেনে একটি কলোনিতে থাকতাম। এই কলোনিটি ছিল (এখনো আছে) লেডিজ ক্লাবের একদম মুখোমুখি অবস্থানে। কলোনিতে তিনতলা তিনটি বিল্ডিং, প্রতিটিতে ছ’টি করে মোট ফ্ল্যাটের সংখ্যা আঠারোটি। শীতকালে পেছনের মাঠে ছেলেরা ক্রিকেট খেলত।

খেলার সরঞ্জাম বলতে সাকুল্যে চারটি স্টাম্প, দুই জোড়া প্যাড, এক জোড়া কিপিং গ্লাভস, দুটো ব্যাটিং গ্লাভস, একটা ব্যাট আর গোটা দুয়েক কাঠের বল। কাঠের বল! সেটা কি জিনিস কেবল আমার সমবয়সীরাই জানবে। যারা জানে না তাদের জন্যে একটু ব্যাখ্যা দেই; লাল রঙের চামড়ায় মোড়ান যে বলগুলি ক্রিকেট খেলায় ব্যবহার হয় সেগুলোকে আমরা ওই বয়সে বলতাম কাঠের বল।

ইটের পাচিলে বা কনক্রিটে বাধানো রাস্তায় সেগুলো ছুড়ে মারলে একটা ঠক করে শব্দ হত। মনে হত একটা কাঠের টুকরো আছড়ে পড়লে যেমন শব্দ হয় ঠিক তেমনটি। হয়ত তাই একে ডাকা হত কাঠের বল। সে যাক, এই সামান্য জিনিসগুলোও বহু ব্যবহারে ভীষণ জীর্ণশীর্ণ। আঠারোটি ফ্ল্যাটের প্রতিটির দরজায় দরজায় ঘুরে কাতর নয়নে হাত পেতে যে চাঁদা জোগাড় করা হত, সেটা আসতো হয় সিকিতে নয় আধুলিতে।

সেগুলিকে এক করে এই বছর যদি কেনা হত একটি ব্যাট তো পরের বছরে গোটা দুয়েক স্টাম্প। যেগুলি কোনটার দাম পাঁচ-দশ টাকার উপরে ছিল না। অনেক বছরে এভাবেই গড়ে উঠতো খেলার পুরো সেটটি যার ফিরিস্তি আমি আগেই দিয়েছি। কলোনির ক্লাবঘরে সযত্নে জমা করে রাখা হত আমাদের এই মহামুল্যবান খেলার সরঞ্জাম।

কলোনির ক্লাবঘর? ফ্ল্যাটগুলির পেছনে একদম সীমানা ঘেঁষে দাঁড়ানো কলাপসিবল গেটের আঠারোটি সারিবদ্ধ গ্যারেজ, একপাশ দিয়ে ফুট দুয়েক প্রস্থের একটানা একটি খাড়া সিঁড়ি উঠে গেছে। তা ধরে উপরে উঠে গেলে, আঠারোটি ঘর আর একটি গণ শৌচাগার। এগুলো ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সার্ভেন্টস কোয়ার্টার। এরই মালিকানাহীন একটি ঘরের দরজায়, পুরোন কার্ডবোর্ডের বাক্স থেকে ছিড়ে নেয়া একটি টুকরোর উপরে হাতে লেখা ছোট একটা সাইনবোর্ড, ‘ইস্কাটন গার্ডেন বয়েজ ক্লাব’।

এই কলোনিতে আমার পুর্ব-বালকদের মধ্যে থেকে কেউ এই কাজটি করেছিল। এই ঘরটির ন্যায্য মালিকানা কোন ফ্ল্যাটের বাসিন্দার সেটা কেউ জানে না, অর্থাৎ আঠারোজন ফ্ল্যাট বাসিন্দাদের একজনের কোন সার্ভেন্ট কোয়ার্টার নেই। কে তিনি সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর বয়স তখনও আমাদের হয় নি।

নামে ক্লাব ঘর। ব্যবহারে এটা আমাদের খেলার সরঞ্জাম রাখার স্টোররুম ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ, ওখানে বসে আড্ডা দেয়ার মতো কোন আসবাবপত্র সেখানে ছিল না। আর থাকলেও কোন লাভ হত না। ওই ঘরে ঢোকা তো দুরের কথা, সিঁড়ি বেয়ে দোতালাতে ওঠার পার্মিশনই আমাদের কারোর ছিল না। কলোনির উত্তর পশ্চিম কোনায় টিনশেডের আরো একটি ঘর ছিল।

এই ঘরে থাকতেন আমাদের মিস্ত্রী চাচা। তিনি একজন সরকারী কর্মচারী, কলোনির সার্বক্ষনিক রক্ষণাবেক্ষণের দ্বায়িত্বে নিয়োজিত। তাঁর ছেলে মেয়ে অনেকগুলো। সম্রাট (নামটা বদলে দিলাম কারণ তাঁর গল্প ভবিষ্যতে বলার ইচ্ছে আছে) তাঁর বড় ছেলে, আমার চাইতে বছর দুয়েকের বড়। সেই ছিল আমাদের ক্লাবঘরের স্থায়ী কাস্টডিয়ান, দরজার চাবি তাঁর কাছেই থাকত।

শীতকাল এলে, রবিবার সকাল দশটায় আর অন্যদিন বিকেল চারটায় চাবি হাতে সম্রাট দোতালায় উঠে যেত। ক্লাবঘরের তালা খুলে খেলার সরঞ্জামগুলো বের করে হাতে করে বার তিনেক ওঠানামা করতে হত তাঁকে, নীচে অপেক্ষারত আমাদের হাতে তুলে দেয়ার জন্যে। আমরা সবাই মিলে সেগুলো বয়ে এনে মাঠে ঝটপট খেলা শুরু করে দিতাম। শীতে বেলা অল্পক্ষণের, নষ্ট করার সময় নেই। আমাদের বাইরে থাকার অনুমতি কেবল মাগরিবের আজান পড়া পর্যন্ত।

কলোনিতে সব মিলিয়ে আমার বয়সী বালকদের সংখ্যা এগারো। ‘ফাইভ এ সাইড’ খেলা হত। যেদিন শুধু দশজন আসতো, সেদিন কোন সমস্যা হত না। সমস্যা হত পুরো এগারোজন উপস্থিত হলে। সেদিন কাগজের ছোট ছোট ফালিতে সবার নাম লিখে দুটো কিপিং গ্লাভসের ভেতরে রেখে খুব করে ঝাকিয়ে একটা নাম তোলা হত। যার নাম উঠত সেই দুর্ভাগার সেদিন খেলার সুযোগ হত না, সে হত সেদিনের ম্যাচের আম্পায়ার। ভাগ্যবান দশের মাঝে দুজন পেত দুই দলের ক্যাপ্টেন্সির দায়িত্ব।

তাঁদের বাদ দিয়ে বাকি আটজন জোড়ায় জোড়ায় একটু দূরে সরে গিয়ে নিজেদের জন্যে দুটো পাতানো নাম ঠিক করত। নামগুলো একটু অদ্ভুত ধরনের হত, যেমন একজনের নাম টিয়া আর আরেকজনের ময়না। নাম ঠিক করার পর একজন আরেকজনের কাধে হাত রেখে দুই ক্যাপ্টেনের সামনে এসে সমস্বরে বলত, ‘ডাক ডাক কিসকি ডাক?’ উত্তরে দুজন ক্যাপ্টেনের একজন হেকে উঠত, ‘হামকো মেরি তুমকো ডাক!’

বিজাতীয় ভাষায় ভাবের এই আদানপ্রদান এই কাজের জন্যে যদিও বহুপ্রচলিত ছিল, কিন্তু কে এটা কখন কীভাবে আবিস্কার করেছিল সেটা আমরা জানতামও না তা নিয়ে মাথাও ঘামাতাম না। এই কথাগুলোর সঠিক অর্থটাই যে কি তাও আজ পর্যন্ত জানলাম না। এটা কাজ করত যে ভাবে তা হচ্ছে, ক্যাপ্টেন টিয়া এবং ময়না এই দুই ছদ্মনামের আড়ালে থাকা দুজনের মাঝে একজনকে সেই নামের ভিত্তিতে তার দলের জন্যে বেছে নেবে, এইভাবে একজন একজন করে টানতে টানতে দুই দল গড়ে উঠত।

তারপর হত টস! কারো একজনের পকেট থেকে বেরিয়ে আসতো একটি পাঁচ পয়সার মুদ্রা। চৌকাকৃতি এই মুদ্রাটির কোন পিঠে চাঁদ আর তারার কোন ইংগিত থাকত না, তবু ক্যাপ্টেনদের ‘চান’ ও তারার মধ্যে একটি বেছে নিতে হত। মুদ্রাটির একপাশে থাকত জিন্নাহর ছবি অর্থাৎ সেটা হচ্ছে হেড- আমাদের জন্যে সেটাই ‘চান,’ আর অন্য পাশে উর্দুতে পাকিস্তান সরকারে নাম আর মুদ্রামান লেখা, সেটা তারা। টসে জেতা যে দল ব্যাট করতে নামতো, তাদের ভাগে পড়ত দুটি প্যাড।

দুই প্রান্তের দুই ব্যাটসম্যান নিজেদের কোন একটি পায়ে সেটা বেঁধে নিত। ডানহাতি ব্যাটসম্যান হলে সেটা যেত বা পায়ে। উল্টোটি হলে ডান পায়ে। ব্যাটিং গ্লাভস দুটোরও ভাগাভাগি ঠিক একই ভাবে হত। প্যাডের বাকি দুটো জুটত বিরুদ্ধ পক্ষের উইকেট রক্ষকের কপালে, মানে পায়ে! পায়ের স্যান্ডেল খুলে সেই পয়াড পরে, ছালচামড়া ওঠা, রংজ্বলা, জীবন মরনের সন্ধিক্ষণে পৌছে যাওয়া কিপিং গ্লাভস পরে আমাদের কিপার একটু নিচু হয়ে স্ট্যাম্পের পেছনে যখন দাড়াত, তাকে যে কি স্মার্ট লাগত সেটা আমি লিখে প্রকাশ করতে পারব না।

স্ট্যাম্প ছিল মোটে চারটি সেটা তো আগেই বলেছি। ছ’টির জায়গায় চারটে স্ট্যাম্প, তা কিভাবে সাজানো হত? বোলিং এন্ড থাকত একটি উইকেট, ব্যাটিং এন্ডে তিনটি, এদের উপরে বসত বেল; এই হল চারটি। ব্যাটিং এন্ড আর বোলিং এন্ড ফিক্সড; কাজেই, ওভার শেষে ব্যাটসম্যানদেরই প্রান্ত বদল করতে হত। পায়ের স্যান্ডেল খুলে বোলিং এন্ডের স্ট্যাম্পের পেছনে জমিয়ে রেখে আমরা খালি পায়ে খেলতাম।

খালি পায়ে খেলার কারণ বহুবিধ – এক, আমাদের অনেকেরই সাদা ক্যানভাসের জুতো থাকলেও সেটা প্রতিদিন পায়ে দিয়ে ময়লা করার বিলাসিতা আমাদের সাধ্যের মধ্যে ছিল না। যে কারণে, খেলতে প্রতিদিন আমরা স্যান্ডেল পরেই যেতাম। দুই, স্যান্ডেল পরে মাঠে দৌড়ালে খেলোয়াড়ি দক্ষতা অনেক কমে যেত। তিন এবং এটাই মুল কারণ, স্যান্ডেল পরে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করলে স্যান্ডেলের ফিতা ছিড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

সেটা করার মতো সাহস আমাদের কারো ছিল না। কারণ, একজোড়া কালো অক্সফোর্ড জুতা আর একজোড়া কেডসের বাইরে সার্বক্ষনিক পরিধানের জন্যে এই স্যান্ডেলই একমাত্র সম্বল। অপব্যবহারে ছিড়ে গেলে সময়ের আগে নুতন একজোড়া কিনে দেয়াটা আমাদের পরিবারগুলোর বাজেটে কুলাতো না।

খালি পায়ে, ছেড়া খোড়া যৎকিঞ্চিত সরঞ্জামে খেললেও আমরা খেলাটাকে কখনো হালকা ভাবে নিতাম না। আমাদের এইসব খেলার পার্ফরমেন্সের উপর ভিত্তি করে পাড়ার বড় ভাইয়েরা তাদের টিমে কখনো কখনো আমাদের কাউকে দ্বাদশ খেলোয়াড় হিসেবে তাঁদের দলে জায়গা দিতেন।

আশপাশের কলোনিগুলোর সাথে ম্যাচে আমাদের সেই সৌভাগ্যবান টিমমেটটি সাদা সার্ট, সাদা প্যান্ট আর সাদা কেডস পরে মাঠের পাশে দলের সাথে বসতে পারত। আর, পানির জগ আর গ্লাস নিয়ে মাঠের মাঝ অবধি যেতেও পারত, এখানেই শেষ নয়, লাঞ্চের সময় আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে মগবাজারের সাইনু পালোয়ানের দোকান থেকে আনা কাগজের বাক্সে ভরা মোরগ পোলাও আর বোতলে ফান্টা খেত; আমরা বাকিরা সেই সময় কেবল হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরতাম।

মোরগ পোলাওয়ের ভাগ না পেলেও একটা কাজ আমরা সবাই মিলেই করতাম। আমাদের বোলার যদি কোন মতে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানের পায়ে একটি বল ছোঁয়াতে পারত, আমরা সমস্বরে চেচিয়ে উঠতাম, ‘হাউস দ্যাট!’ কথাটির মানে কি সেটা অবশ্য তখন জানতাম না। ইংরেজীতে অমন জাদরেল দুটি শব্দ উচ্চারণ করে শরীরে একটা শিহরণ খেলে যেত। নিজেকে সেই সময় দারুণ স্মার্ট মনে হত।

মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে এমনিভাবে ‘হাউস দ্যাট’ বলে চিৎকার দিতে দিতে আমাদের একজন সহখেলোয়াড় কিন্তু পরবর্তীকালে বাংলাদেশ জাতীয় দলের ব্যাটসম্যান হয়ে খেলেছিল। ফেলে আসা ছেলেবেলার এই গল্পের আরো একটি পাদটীকা আছে। ঠিক পাদটীকা নয়, বরং বলা যেতে পারে ক্ল্যারিফিকেশন; আমাদের শৈশবের এই গল্প শুনে এটি একটি হতদরিদ্র কলোনিবাসীদের গল্প ভেবে তাদের করুণা করতে যাবেন না যেন।

যে সময়ের গল্প করলাম সেই সময়ে এই কলোনির বাসিন্দারা কেউ ছিলেন ঢাকার জেলা জজ, কেউবা প্রাদেশিক ল্যান্ড রেজিস্ট্রার নাহয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রিন্সিপাল। পুর্ব পাকিস্তান সরকারের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার নিচে ওই কলোনিতে কেউ থাকতেন না। দৈনতার কারণ একটাই, শুধু সরকারের দেয়া বেতনের টাকায়ই এই বোকা মানুষগুলোর সংসার চলতো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link