অনেকদিন পর বাসায় যাবো…

‘তুই পারবি, তুই আগেও অনেকবার করছোস দোস্ত’- অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তৃতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচে শেখ মেহেদী হাসানকে উইকেটের পিছন থেকে বলছেন নুরুল হাসান সোহান। এই কথা গুলোই কিছুদিন আগে সোহানের মনে কেউ গেঁথে দিয়েছিল। কিংবা আমরা যখন তাঁকে প্রায় হারিয়েই ফেলেছিলাম তখন বোধহয় নিজেই নিজেকে সোহান বলেছেন তিনি পারবেন আরেকবার প্রমাণ করতে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলার ক্রিকেটের ভক্তরাতো ইতিমধ্যেই রায় দিয়ে ফেলেছেন। সোহান নাকি ক্রিকেট মাঠের আস্ত এক মোটিভেশনাল স্পিকার। তবে শুধু মোটিভেশন দিয়ে তো বাংলাদেশ দলে জায়গা করে নেয়া যায় না। তিনি মাঝেমাঝে ক্রিকেটটাও খেলেন নিশ্চই। মাঝেমাঝে দলকে নিয়ে পৌছান জয়ের বন্দরে। বাংলার ক্রিকেটে একজন ফিনিশারের যে আক্ষেপ সেটা বুঝি সোহানই মিটাবেন।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সোহানের অভিষেক হয়েছিল আরো পাঁচ বছর আগে। বিশ্বাস না হলেও সত্যি যে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ২০১৬ সালে বেশ আশা জাগানিয়া এক শুরুই করেছিলেন। অভিষেক ওয়ানডে ম্যাচে তাঁকে ব্যাট করতে নামানো হয় আট নম্বর পজিশনে।

ক্রাইস্টচার্চের বিরুদ্ধ কন্ডিশনে দেশের সেরা ব্যাটসম্যানরাও যেখানে হিমসিম খাচ্ছিলেন সেখানে ২২ বছরের টগবগে এক তরুণ করে ভীষণ আত্মবিশ্বাসি মনে হচ্ছিল। ওই পজিশনে নেমে খুব বেশি কিছু করার ছিল না তবুও ২৪ রানের লড়াকু এক ইনিংস খেলেছিলেন। পরের ম্যাচে সোহান আরো অপ্রতিরোদ্ধ। শেষ দিকে তাঁর ৩৯ বলে ৪৪ রানের ইনিংসে ২৩৬ রান করতে পেরেছিল বাংলাদেশ।

নিজের প্রথম দুই ম্যাচেই ক্রাইস্টচার্চে এমন পারফর্মেন্স করার পরেও সোহানের আর কখনো দলে জায়গা হয়নি। মূলত সেই সিরিজে মুশফিকের প্রক্সি দেয়ার জন্যই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁকে। মুশফিক আবার ফিরে এলে আট নম্বরে নেমে অমন ইনিংস খেলা ছেলেটাকে আর কখনো মনেও করিনি আমরা। তবে সোহান এইসব নিয়ে হয়তো খুব বেশি চিন্তা করেন না। মাঠে তাঁকে এখন বলতে শোনা যায়, ‘আল্লাহ কপালে রাখলে এমনেই হইব, এতকিছু চিন্তা করা লাগবো না।’

সোহানকে নিয়ে নির্বাচক কিংবা ক্রিকেটবোদ্ধাদের সবচেয়ে আপত্তির জায়গা ছিল অফ সাইডে তাঁর দুর্বলতা। এটা অবশ্যই সত্যি যে এক সাইডে এতটা দুর্বলতা নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বড় দল গুলোর বিপক্ষে রান বের করা কঠিন হয়ে যায়। তবে সেটা সোহানের চেয়ে ভালো কেই বা বুঝতো। গত কয়েক বছরে অফ সাইডে প্রচুর কাজ করেছেন। মাঝেমাঝেই তাঁর প্রমাণ মিলতো ঘরোয়া ক্রিকেটে। তবে এবারের ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে যেন এক অন্য সোহান।

এবার তাঁর ব্যাটিং, তাঁর শরীরি ভাষায় বোঝাই যাচ্ছিল আগের যেকোন সময়ের চেয়ে অনেক বেশি প্রস্তুত তিনি। এবার জিম্বাবুয়ে সফরে যাওয়ার আগে খেলা ৭১ কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি এমন একটা জায়গায় ব্যাটিং করি, যেখানে আসলে ওয়ানডে বা টি-টোয়েন্টিতে গিয়েই স্লগ করতে হয়। ফলে পাওয়ার হিটিং এবিলিটিটা আমার বাড়াতে হত। গত লক ডাউনের সময় থেকে, মানে প্রায় দুই বছর ধরে আমি এগুলো নিয়ে বাবুল স্যারের (মিজানুর রহমান বাবুল) সাথে কাজ করছি।’

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও এই কঠিন পরিশ্রমের ফল মিললো। অফ সাইডে আগের চেয়ে অনেক বেশি সাবলীল। একেবারে নিখুঁত ব্যাটসম্যান হয়ে গেছেন বলছি না, তবে একটা গন্তব্যে তিনি অবশ্যই এসে পৌছেছেন। ফলে সাদা বলের ক্রিকেটে তিনি এবার খুব দ্রুত একটা আশা, একটা ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছেন।

সোহান বাংলাদেশের সেরা উইকেটরক্ষক এটা কেউ কোন তর্ক ছাড়াই মেনে নিবেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এই স্লো এবং লো পিচে উইকেটের পিছনের নিজের কেরামতির সেরাটা দেখিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়া দলের কিপার প্রায়ই পিচের বাউন্স, গতি না পড়তে পেরে বাংলাদেশকে অনেক গুলো বাই রান উপহার দিয়েছেন। তবে সোহান এই ভুল একবারো করেননি। বিশেষ করে মুস্তাফিজের বলগুলোকে তালুবন্দি করেছেন কৃতিত্বের সাথে। এছাড়া তাঁর স্ট্যাম্পিং চান্স তৈরি করা কিংবা ক্যাচিং এবিলিটি নিয়ে তো নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজনই নেই।

উইকেটের পিছন থেকে নানারকম কথাবার্তা বলে বোলারদের উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছেন। প্রতিবার ফিল্ডারদের শাসিয়ে যাচ্ছেন। সেই ফিল্ডার সোহানের বন্ধু মাহেদীই হোক কিংবা বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিবই হোক। একটা রানও বাড়তি দেয়া যাবেনা এটাই তাঁর একমাত্র কথা। ওদিকে ব্যাটসম্যানদের উইকেটের পিছন থেকে আনসেটেল করার কাজটায়ও তিনি পারদর্শী। অস্ট্রেলিয়ায় মত দলের বিপক্ষে খেলায় তিনি বলছেন, ‘ওরে জায়গায় কর, ও এমনিই কাঁপতেছে।’

সোহান এগিয়ে আরেকটি বিশেষ জায়গায়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যেটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো মানসিকভাবে অনেক শক্ত হওয়া, মাথা ঠাণ্ডা রাখা। এছাড় মাঠে তিনি যে একটা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খেলেন সেটি বাংলাদেশের খুব কম ক্রিকেটারের মধ্যেই দেখা যায়। তাঁর সহজাত নেতৃত্বগুণও তাঁকে আলাদা করে।

অনেক জায়গায়ই সোহান বলেছেন তিনি পাশের দেশের কিংবদন্তি উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান মহেন্দ্র সিং ধোনিকে খুব অনুসরণ করেন, তাঁর মতই ক্রিকেটটাকে বুঝতে চান। আমি বিশ্বাস করি সোহান এখনই ক্রিকেটটা বেশ ভালো বোঝেন। অবশ্য সোহান মহেন্দ্র সিং ধোনি হোক আমি চাইনা, সোহান একজন সোহানই হোক, আমাদের একান্ত সোহান।

এর আগে অবশ্য আরেকটু কথা আছে। বায়োবাবলে থাকা সোহানরা দেশে থেকেও একটু পরিবারের সাথে দেখা করতে পারেন না। তাইতো কাল সাকিবকে বলছিলেন, ‘তাড়াতাড়ি শেষ করেন ভাই, অনেকদিন পর বাসায় যাবো।’ কি! সামনে থাকা অস্ট্রেলিয়া দলকে এই কথাটা বলতে যতটা আবেগ দরকার হয়, তারচেয়ে বেশি দরকার সাহস।

অবশ্য সোহানের কাছে সামনে কে বা কোন দল এগুলো কিছু যায় আসেনা। সোহান শুধু বোঝেন একটা রানের মূল্য, একটা উইকেটের মূল্য। সোহান আসলে ক্রিকেটটা বোঝান। আর কথা পরে হবে। এখন সোহানরা আগে একটু বাসায় যাক। মা’র হাতে রান্না ভাত-ডাল খেয়ে আসুক।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link