মিরপুর স্টেডিয়ামের সেই সকালটা আমি কখনোই ভুলবো না।
নতুন নতুন রিপোর্টিং জীবন শুরু করেছি তখন। বয়সও কম, রক্তে অনেক তেজ। সকাল সকাল মাঠে যাই। দুপুরে ফিরি, নতুন এক জীবন। উপভোগ করছিলাম বেশ।
একদিন কি একটা কারণে খুব সকালে গেলাম। মাঠে একটা কাকপক্ষীও নাই। গ্র্যান্ড স্ট্যান্ডের উপর দাঁড়িয়ে আছি। এত সকালে আসার জন্য মনে মনে নিজেকে গালিও দিচ্ছি।
শীতকাল তখন। বিশেষ করে সেই দিনটায় রোদের দেখা ছিল না। দেখলাম কুয়াশা ভেদ করে ছোটখাটো গড়নের কেউ একজন আসছেন। ব্যাট দিয়ে একা একাই শ্যাডো করছেন। একটু কাছে আসলে বুঝলাম লোকটা কে!
জাতীয় দলের কোনো খেলা ছিল না সেই সময়। তারপরও এই শীতের সকালে তিনি চলে এসেছেন। আমি মনকে বললাম, যাক আমার মত পাগল আরো একজন আছেন!
আমার সেই পাগলামি আর নাই। এখন খুব জরুরী কিছু না থাকলে মাঠে যাওয়া হয় না। ডেস্ক সামলাই।
কিন্তু সেই পাগলটার পাগলামি চলছে। আজো তিনি সবার আগে মাঠে গিয়ে উপস্থিত হন। অনুশীলন করেন, জিম করেন। মাঠে খেলা থাকুক কিংবা না থাকুক – তাঁর লড়াই থেমে থাকে না।
কার কথা বলছি সেটা নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হয় না। তিনি মুশফিকুর রহিম।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে এযাবৎকালে যতজন ব্যাটসম্যান এসেছেন, তাঁদের মধ্যে সন্দেহাতীত ভাবে হয়তো তাঁকে সেরা বলা যাবে না – তবে এটা ঠিক যে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে তো বটেই বিশ্বের ইতিহাসেরই অন্যতম পরিশ্রমী ক্রিকেটার।
অনেকে অনেকরকম সমালোচনা করতে পারেন মুশফিককে নিয়ে। কখনো তাঁর ব্যাটিং নিয়ে, কখনো অধিনায়কত্ব নিয়ে, কখনো বা স্যোশাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিটি নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। আমি নিজেও সেই সমালোচকদের মধ্যে ছিলাম উচ্চকণ্ঠ – আমি বলেছি মুশফিকের অধিনায়কত্ব খুব ডিফেন্সিভ, আমি বলেছি ফেসবুক পেজ ব্যবহারে মুশফিকের আরো বেশি সচেতন হওয়া উচিৎ, আমি বলেছি মুশফিক যে মানের উইকেটরক্ষক তা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশকে ম্যাচ পর্যন্ত হারাতে পারে।
তবে মুশফিকের প্যাশন, মুশফিকের নিবেদন, মুশফিকের পরিশ্রম নিয়ে কোনো প্রশ্ন কিংবা সন্দেহের অবকাশ নেই। এখানে তিনি বাংলাদেশের শেষ কথা। চূড়ান্ত মান। আর আজকাল সেই মাপকাঠিটা আরো উপরের দিকে উঠছে। মুশফিকের সেই পরিশ্রম নিয়ে কখনো বলা হয়নি। সরি, মুশফিক – আপনার সবচেয়ে ভাল ব্যাপারটাই এড়িয়ে গিয়েছি।
কখনো মুশফিককে স্যালুট জানানোর প্রয়োজন বোধ করিনি। করা উচিৎ ছিল। এই মুশফিকই পাজোরের ভাঙা হাড় নিয়ে ব্যাট হাতে তাণ্ডব চালিয়েছেন – শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয় এনেছেন তাঁদেরই মাঠে। সেদিন মুশফিককে স্যালুট জানানো হয়নি। সরি। সরি, মুশি!
ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আগাম উদযাপন করেছিলেন বলে মাথা নিচু হয়েছিল আমাদের। সেটা নিয়ে বলেছি। কিন্তু বলিনি এই মুশফিকই ভারতের মাটিতে আমাদের টি-টোয়েন্টি জিতিয়েছেন। সেই জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করি। সরি, মুশফিক।
২০১৫ বিশ্বকাপে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ‘ব্যাক টু ব্যাক’ সেঞ্চুরির কথা বলেছি, পাতার পর পাতা লিখেছি, হিট কামিয়েছি। ভুলে গিয়েছি মুশফিককে। তিনিই তো প্রতিটা ম্যাচে সেবার রান রেট বাড়াতে ঝড় তুলেছেন। বলা উচিৎ ছিল, সরি।
উইকেটের পেছনে মুশফিকের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি বারবার। সেটা করতে গিয়ে মুশফিক যে নিজের ব্যাটিংয়ে কত হাজারো পরিবর্তন এনেছেন – সেসব নিয়ে বলতেই ভুলে গেছি। সরি, মুশফিক।
মুশফিকের বয়স হয়েছে। বাস্তবতা হল তিনি হয়তো আর লম্বা সময় সার্ভিস দিতে পারবেন না বাংলাদেশ দলকে। সেই বাস্তবতা তিনি নিজেও বোঝেন। মুশফিককে ছাড়াই হয়তো এগিয়ে যাওয়া শিখে ফেলবে বাংলাদেশ। হয়তো, মুশফিকের চেয়েও বড় কোনো ব্যাটসম্যান পাবে বাংলাদেশ। তবে, সেই ‘বড় ব্যাটসম্যান’টিকেও পরিশ্রমের মাপকাঠিতে অনুসরণ করতে হবে এই মুশফিককেই!