‘রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস’ – শুধু এটুকু বললে শোয়েব আখতারকে বোঝা যায় না। দর্শকের অ্যাড্রেনালিন রাশ করাতে তাঁর জুড়ি ছিল না। যেকোনো পরিস্থিতিতে তাঁকে দেখাটা একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার। আর সেটার মধ্য ছিল রেসলিংয়ের যুদ্ধংদেহী আবহ। তাঁকে বোলিং করতে দেখাটাও ছিল দর্শনীয়।
ক্ষুরধার চাহনী দিয়ে দেখছেন ব্যাটসম্যানকে, রান আপ যখন শুরু করতেন, মনে হন লাগামহীন এক পাগলাঘোড়া ছুটছেন। বাতাসে তাঁর উড়তে থাকা চুল যেন সেই বোলিংরে আবেদন বাড়াতো। আর বলগুলো হাত থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই হয়ে যেত একেকটি আগুনের গোলা। ব্যাটসম্যানরা এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরাতে পারতেন না। নিজের দিনে তিনি যেকোনো অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারতেন, তিনি কখন কি করে বসেন তা বোঝা ছিল দুস্কর।
আধুনিক ক্রিকেটের অন্যতম সেরা দ্বৈরথগুলোর একটি হল শচিন টেন্ডুলকার বনাম শোযেব আখতারের। ১৯ ওয়ানডেতে লিটল মাস্টারকে পাঁচ বার আউট করেছেন শোয়েব, আর শচীনের ব্যাটিং গড় ৪৫। আর নয় টেস্টে শচীনের উইকেট পেয়েছেন তিনবার।
তিনি ছিলেন পেস জিনিয়াস, গতির সাথে মস্তিষ্কও চলতো (তবে সেটা পুরেোটাই তাঁর মর্জি)। দুই বলের ব্যবধানে তিনি দুই ব্যাটিং গ্রেট রাহুল দ্রাবিড় ও শচিন টেন্ডুলকারের উইকেট পেতে জানতেন, ১১ বলের মধ্যে রিকি পন্টিং, দুই ওয়াহ ভাই আর অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে বিদায় করেছিলেন।
শোযেব মরা উইকেটে প্রাণ সঞ্চার করতে পারতেন। লাহোরে একবার নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৮.২ ওভারের মধ্যে ছয় উইকেট পেয়েছিলেন, নিউজিল্যান্ড অল আউট হয় ৭৩ রানে। সেটাও সেই উইকেট যেখানে পাকিস্তান আগেই ৬৪৩ করে ফেলেছে। এর চেয়ে বড় লিডের নজীর ইতিহাসে আর একবারই দেখা যায়, সেটাও আবার সেই টাইমলেস টেস্টের জমানায়।
২০০৩ বিশ্বকাপে যখন তিনি ইংল্যান্ডের নিক নাইটের বিপক্ষে করা সেই মেইডেন ওভারের শেষ ডেলিভারিটায় যখন ১৬১.৩ কিলোমিটার/ঘণ্টা গতি তুললেন, তখন বিশ্বজুড়ে নতুন আলোচনার ঝড় উঠলো। বলাবলি হল, এসেছেন নতুন পেস দানব, তাঁকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান।
জেফ থমসন, অ্যান্ডি রবার্টস কিংবা ম্যালকম মার্শালরা তখন অতীত। ব্রেট লি’র সাথে বরাবরই গতি নিয়ে শোয়েব আখতারের রেষারেষি ছিল, তাতে বরাবরই জিতে এসেছেন শোয়েব আখতার। গতির জন্য শোযেব আখতারের সুখ্যাতি ছিল, আর কুখ্যাত ছিলেন শৃঙ্খলাভঙ্গজনিত কারণে।
১৪ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার তাঁর। অথচ, এই সময়ে খেলতে পেরেছেন মাত্র ৪৬ টি টেস্ট, ১৬৩ টি ওয়ানডে আর ১৫ টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। তাতে উইকেট পেয়েছেন সাড়ে চারশোর মত। এই তালিকাটা লম্বা হতে পারেনি শোয়েবের নিজের খামখেয়ালির কারণে।
কখনো তিনি ইনজুরিতে পড়েছেন, রাত করে টিম হোটেল ছেড়ে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছেন, ডোপ টেস্টে পজিটিভ এসেছেন, বল টেম্পারিং করে নিষিদ্ধ হয়েছেন। সতীর্থ, কোচ বা অধিনায়ক কিংবা প্রতিপক্ষের সাথে ঝামেলায় জড়ানো ছিল তাঁর জন্য ডালভাত। তাকে পাকিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত ‘ব্যাড বয়’ বললেও ভুল বলা হবে না।
ক্যারিয়ার জুড়ে তিনি যতই বিতর্কের জন্ম দেন না কেন, সাবেক ক্রিকেটার হিসেবে তিনি একেবারেই নিপাট ভদ্রলোক। ধারাভাষ্যকক্ষের সুবক্তা, ইউটিউবেও তাই। আত্মজীবনী ‘কন্ট্রোভার্সালি ইওরস’ও যথেষ্ট সুলিখিত। খেলোয়াড়ী জীবনের মত এই বইটিও যথেষ্ট আলোচিত।
শোয়েব আখতার ছিলেন স্বয়ং ইমরান খান কিংবা ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনুসের যোগ্য উত্তরসুরী ছিলেন। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে তো তাঁকে জায়গা দিতে গিয়ে প্রায় খেলতেই পারেননি ওয়াকার ইউনুস। তারপরও শেষ বেলায় তাঁকে বোঝার জন্য শুধু পরিসংখ্যানের আশ্রয় নিলে চলে না। আরো অনেক যদি/কিন্তু টানতে হয়।