শরীরটা মানুষের, ভেতরের খাঁচাটা দৈত্যের!

অধিনায়ক লোকটাকে বলেছিল – ‘এই রসগোল্লা, তুই শুধু জল বইবি!’ লোকটা প্রতিবাদ করেছিল। একটা ম্যাচে চান্স। ৩ রানে আউট। বাদ।

লোকটা একটু আলাদা। চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলে ও নিয়ে নেয়। জেতেও। লোকটা ফিরে এলো। চার বছর পর লর্ডসে যখন নামছে ও, আশেপাশে ফিসফাস। ও নাকি সম্বরণের কোটা।

সিল্ক টাচ এ একের পর এক বল যখন কভার বাউন্ডারি ছাড়াতে শুরু করল, সবাই হঠাৎ টানটান। লোকটা যখন শতরান ছুঁল, প্রিন্স অব ক্যালকাটা তখন জন্ম নিয়েছেন। তারপর এল সেই অভিশপ্ত ১৯৯৯।

ভারতের ক্রিকেট মিথ চূর্ণবিচূর্ণ। শচীন ছেড়ে দিয়েছেন অধিনায়কত্ব। গড়াপেটায় বিধ্বস্ত আজহার। লোকটাকে দ্বিতীয় বার ছূঁড়ে দেওয়া হল চ্যালেঞ্জ। -পারবি? -পারবো!

তারপরের ৪৯ টেস্টে ২১ টায় জয় যার মধ্যে ১৩ টাই দেশের বাইরে। পাকিস্তানকে পাকিস্তানে হজম। স্টিভ ওয়াহর চোখে চোখ রেখে ছিনিয়ে নেওয়া ফলো অন টেস্ট। লর্ডসের ব্যালকনিতে জামা ওড়ানো!

তারপর এলো চ্যাপেলওয়ে। বিদেশে সিরিজ জিতেও গেল অধিনায়কত্ব। আবার লোকটা বাদ। আবার চ্যালেঞ্জ। রঞ্জি খেলে ফিরে আয়। দেখি কত বড়ো মাচো তুই।

অনেকে তখন সরে দাঁড়ায়। মাথা নিচু করে। কিন্তু ওই যে বললাম, লোকটার কেমিস্ট্রি টা একটু আলাদা। ও আবার চ্যালেঞ্জ নিল। দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে খেলতে লাগল রঞ্জি ট্রফি। ছেলেবেলার মতো।

আর, বললে বিশ্বাস করবেন না, আবার ফিরেও এলো এক বছর পর। প্রত্যাবর্তন ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে করল অপরাজিত অর্ধশতরান। ভারত জিতল। পরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ডাবল সেঞ্চুরি।

তবু, আবার বাদ দেওয়ার চোখ রাঙানি। আর ভাল লাগল না ওর।

তাই অধিনায়ককে বললো – এটাই শেষ সিরিজ। অস্ট্রেলিয়া। এরপর আর খেলব না। প্লিজ, এই সিরিজটা খেলতে দাও আমায়। আবার চ্যালেঞ্জ। এবং কি আশ্চর্য, আবার জিতল। নাগপুরের শেষ টেস্টেও ৮৫। তারপর সব শেষ।

১৯৯৬ সালে সৌরভ গাঙ্গুলির ভারতীয় দলে অন্তর্ভুক্তির পর মুম্বাই এবং দক্ষিণী লবির সাংবাদিকরা গেল গেল রব তুলেছিল, যে কেন ভিভিএস লক্ষ্মণের মতো প্রতিভাবান খেলোয়াড় থাকতে একে দলে ঢোকানো হল?

বাঁ হাতিই যদি নিতে হয় তাহলে অভিজ্ঞ ডব্লিউ ভি রমনকেই আবার ডাকা যেত। তখন ভারতীয় বোর্ডএর কিছু বাঘা কর্মকর্তা তাদের আশ্বস্ত করে দিয়ে বলেছিলেন – আরে বহুদিন ধরে বাংলা থেকে কোন খেলোয়াড় নেওয়া হয় না, বোর্ড নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে কোটা হিসাবে একজনকে নেওয়া হয়েছে আর নিলেই কি খেলাতে হবে নাকি? স্বয়ং আজাহার নির্বাচনী সভায় সৌরভের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করে তুলকালাম করেছিলেন।

কিন্তু গত দুই বছরে গাঙ্গুলির ধারাবাহিক পারফরম্যান্স আর সম্বরণ ব্যানার্জির উপস্থিত বুদ্ধি, গলার জোর, মেরুদণ্ড শক্ত করে থাকা সব মিলিয়ে মিশিয়ে সৌরভ ভারতীয় দলে ঢুকে পড়েন।

তারসঙ্গে ১৯৯৬ এর বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের খারাপ পারফরম্যান্স, ইডেন বিতর্ক, আজাহার সংগীত বিজলানী কেচ্ছা সবকিছুই একটা অনুঘটকের কাজ করেছিল। ইংল্যান্ডের দল ঘোষণা হওয়ার পরে সৌরভকে নিয়ে প্রথম বিদ্রুপটা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন গাভাস্কার – ‘ও তো কলকাত্তা কা রসগুল্লা হ্যায়!’

রবি শাস্ত্রী সরাসরিই বলেছিলেন – ‘কোটার মাল!’

আসলে এরা সবচেয়ে ভাল ওয়াকিবহাল ছিলেন সৌরভের ক্ষমতা সম্পর্কে। তাই সৌরভ গাঙ্গুলীর ভবিষ্যৎ মহীরুহ হওয়ার সম্ভাবনাকে অচিরেই শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন।

নির্বাচন কমিটির বৈঠকের পরে প্রবল বাঙালি বিদ্বেষী মুখ্য নির্বাচক সন্দীপ পাতিল ব্যাঙ্গ করে বলেছিলেন –  ‘আজ সম্বরণ আমাদের খাওয়াবে! সৌরভকে শেষ পর্যন্ত ও দলে ঢুকিয়েই ছাড়লো!’

ব্যাপারটা এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায় যে মধ্যাঞ্চলের নির্বাচক গোপাল শর্মা চিৎকার করে বলতে বাধ্য হন – ‘শাট আপ স্যান্ডি! সমস্ত কিছুর একটা সীমা আছে।’

উত্তরে সম্বরণ ব্যানার্জি হেসে বলেছিলেন – ‘তোমাদের তুলনায় এই বাঙালি একটু গরীব, কিন্তু নিশ্চয়ই খাওয়াবো। তবে সৌরভকে দলে ঢোকাতে পারলাম বলে নয় , ভারতীয় দলকে সৌরভের মতো একটা ক্রিকেটার দিতে পারলাম বলে।’

আসলে সম্বরণ ব্যানার্জি নিজেই তো একজন বঞ্চিত তারকা। নিজের ওপর হওয়া অবিচারের শোধ সম্বরন সুদে আসলে তুলে ছিলেন স্রোতের বিরুদ্ধে সৌরভকে ভারতীয় দলে অন্তর্ভুক্ত করিয়ে।

১৯৯৬ এর ইংল্যান্ড সফরে সৌরভের ক্যারিয়ার চিরকালের মতো শেষ করে দেওয়ার ব্লু প্রিন্ট ফ্লাইটে বসেই বানিয়ে ফেলেছিলেন আজহার আর পাতিল।

হোটেলে চেক ইন করার পরে আজহার সৌরভকে বলেছিলেন – ‘ভালো করে ইংল্যান্ড ঘোর, শপিং করো, আত্মীয় স্বজনের সাথে দেখা করো , মানে ভুলেও ক্রিকেট খেলার বা দলে জায়গা পাওয়ার কথা মনে স্থান দিও না।’

খেলোয়াড়দের ফিডব্যাক রিপোর্টে সৌরভ সম্পর্কে ভয়ংকর সব অভিযোগ করেছিলেন পাতিল। পাতিল জানতেন ১৯৯৬ সালে সৌরভ যখন ভারতীয় দলে প্রথম নির্বাচিত হন তখন তার নাম শ্রীকান্ত, শাস্ত্রী সহ বেশ কিছু খেলোয়াড় অভিযোগ করেছিলেন সৌরভ নাকি উদ্ধত এবং তাদেরকে সিনিয়র ক্রিকেটার হিসাবে সম্মান করেন না। যেটা সৌরভ পরে মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন অভিযোগ বলেছিলেন। সেটাকেই কাজে লাগানোর চেষ্টা করলেন পাতিল।

রিপোর্টে লিখলেন – ‘সৌরভ টিমম্যান নন, ম্যাচের আগে কারোর সাথে কথা বলেননা, একা একা ঘুরঘুর করেন।’ এখানে আমরা নিজেরা যারা খেলাধুলা অল্পবিস্তর করি তারা একটা কথা বলতে চাই যে, খেলাধুলায় চূড়ান্ত ক্ষেত্রে নামার আগে মনোসংযোগ বলে একটা কথা আছে। কিন্তু ইচ্ছাকৃত ভাবে বিনোদ কাম্বলির রাস্তা পরিষ্কার রাখার জন্যে পাতিলরা ওই কাজ করেছিলেন।

আজহারের সাথে সিধুর ইগোর লড়াই চরমে পৌঁছে সিধু মাঝপথে সফর ছেড়ে চলে এলেও সৌরভের নাম ভাবা হয়নি। ঠিক ছিল রাহুল দ্রাবিড় আর বিক্রম রাঠোর এর নাম। কিন্তু এরপরে প্র্যাকটিসে সুনীল জোশির আঙুল ভাঙ্গায় কোনভাবেই উপায় না দেখে সৌরভকে খেলাতে বাধ্য হয় ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট। লর্ডসের স্যাঁতস্যাঁতে পিচে সৌরভকে ওয়ান ডাউনে ঠেলে দেন পাতিল আজহার জুটি।

উদ্দেশ্য পরিষ্কার সৌরভ ডমিনিক কর্ক আর এলান মুলালির বিষাক্ত সুইং এর সামনে খাবি খেয়ে অল্প রানে আউট হবেন আর তারপরেই ওৎ পেতে থাকা মুম্বাই আর দক্ষিণী মিডিয়ার সাহায্যে শেয়ালের চিৎকার করে সৌরভ অযোগ্য এই বলে সৌরভের ক্যারিয়ার জন্মের মতো শেষ করে দেওয়া হবে। সঙ্গ দেওয়ার জন্যে মাত্রাতিরিক্ত উদার, খাঁটি ভারতীয় বাঙালি কাঁকড়ারা তো আছেই।

লর্ডসে সৌরভ কি করেছিলেন সেটা বিশ্ব ক্রিকেটের রূপকথায় ঢুকে গেছে। কিন্তু যদি তিনি শূন্য রানে আউট হতেন তাহলে কি হোত? দিলীপ ভেঙ্গসরকার ১৬ টা টেস্ট খেলার পরে জীবনের প্রথম হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন, যে গাভাস্কার প্রথম তিনটে টেস্টে ৭০০ রান করেছিলেন সেই গাভাস্কারের ১০০০ হাজার টেস্ট রান পুরো করতে ১২ টা টেস্ট লেগেছিল। সৌরভ পেতেন এতগুলো সুযোগ? রোহিত শর্মা পরপর নয়টা ম্যাচে দুই অংকের স্কোরে পৌঁছাতে পারেননি।

তবুও দশ নম্বর ম্যাচটা খেলার সুযোগ কেন পায় জানেন কারণ ঠিক সেই সময়েই মহারাষ্ট্রের মিডিয়া আর কর্মকর্তারা খাঁটি ভারতীয় থেকে খাঁটি মুম্বাইয়া হয়ে যায়। এদের জন্যেই শচীন, লক্ষণ, দ্রাবিড় সৌরভের সমসাময়িক হয়েও কেউ ২০১২ কেউ ২০১৩ আবার কেউ ২০১৪ তে অবসর নিতে পারেন আর ফর্মের শিখরে থাকা সৌরভকে অকাল অবসর নিতে বাধ্য করা হয় ২০০৮ সালে। চ্যাপেল কাণ্ডে সারা ভারতের ক্রিকেটপ্রেমী সৌরভের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল আর ভারতীয় বোর্ড ছিল সৌরভের বিপক্ষে।

সারা জীবনে অদ্ভুত অদ্ভুত সব অভিযোগের মুখোমুখি হতে হয়েছে বেঙ্গল টাইগারকে। প্রথমে বলা হোত ক্রিকেটই খেলতে পারেন না, লর্ডসের পরে নতুন গান শুরু হল টেস্টে মোটামুটি চললেও ওয়ানডে এর দ্বারা হবে না। টরন্টোতে একটা ম্যাচে কুম্বলেরও পরে আট নম্বরে সৌরভকে ব্যাট করতে পাঠিয়েছিলেন পাতিল। খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন সাকুল্যে আটটা বল। ১২ রানে নট আউট ছিলেন। তার মধ্যেই ওয়াসিম আকরামের একটা ব্যানানা ইনসুইঙ্গারকে স্ট্রেট ড্রাইভে বাউন্ডারিতে পাঠিয়েছিলেন, শটটা আজও চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে।

পরের ম্যাচেই বাদ পড়েছিলেন। সেইজন্য নিজের দশ হাজার ওয়ানডে রান পূর্ণ করার পরে একটা দুর্দান্ত স্টেটমেন্ট দিয়েছিলেন, তখন চ্যাপেল, মোড়ে দুই জোড়া ফলা দিয়ে সৌরভকে ছিন্নভিন্ন করছেন শরদ পাওয়ার। অধিনায়কত্ব পাওয়ার লোভে জেন্টেলম্যান রাহুল দ্রাবিড় তখন নগ্ন ব্রুটাস। সেই সময়ে দশ হাজার রান পূর্ন করে সংবাদিকদের বলেছিলেন – ‘জীবনের প্রথম ওয়ানডে রানটা করার পরে জানতাম না পরের ম্যাচে দলে থাকবো কিনা! আজ দশ হাজার ওয়ানডে রান করার পরেও জানিনা পরের ম্যাচে জায়গা থাকবে কিনা।’

খুব ভালো সিঙ্গেলস জাজ করতে পারতেন, সেইজন্যে অতিরিক্ত বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে নির্বোধের মতো রান আউট হতেন না এটাকে একশ্রেণীর মিডিয়া প্রচার করতো সৌরভ রান নিতে পারেন না। ঘোড়াতেও হাসবে শুনলে। শচীন, দ্রাবিড় ক্যাচ ফেললে ওটা ক্রিকেটেরই অঙ্গ কিন্তু সৌরভের একটা মিসফিল্ড হলেই খাঁটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ক্রিকেটপ্রেমী বাঙালি কাঁকড়াগুলো গেল গেল রব তুলেছে। অথচ সৌরভের মতো উচুঁ ক্যাচ ধরার দক্ষতা অতীত বর্তমান মিলিয়েও কোন ভারতীয় ক্রিকেটারের নেই। ফ্লাড লাইটের ওপরে চলে যাওয়া ক্যাচগুলো কি অসাধারণ দক্ষতায় তালুবন্দী করতেন। ক্লোজ ইন ফিল্ডার হিসাবেও দুর্দান্ত ছিলেন।

সবচেয়ে হাস্যকর অভিযোগ ছিল গাঙ্গুলী জোরে বল খেলতে পারে না! আঠেরো হাজার রান শুধুই স্পিনের বিরুদ্ধে এসেছে? কার্টলি অ্যামব্রোম, ওয়াসিম আকরাম, চামিন্দা ভ্যাস, আকিব জাভেদ, ড্যারেন গফ, অ্যালান ডোনাল্ড, শন পোলক, ব্রেট লি – কে ঠ্যাঙানি খায়নি দাদার হাতে? শোয়েব আখতারের বল বুকে লেগে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পরেও হসপিটাল থেকে এসে দুরন্ত ৫৭ রানের ইনিংস খেলেছিলেন।

ওয়াকার ইউনূসের মার খাওয়ার কথা বললেই লোকে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে জাদেজার কথা বলে । এর থেকেও ভয়ংকর মার ইউনুস সৌরভের হাতে খেয়েছিলেন ১৯৯৭ এ করাচির ওয়ানডেতে। পাকিস্তান এর বিরুদ্ধে ভারতকে ধারাবাহিকভাবে জিততে শিখিয়ে ছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলি। অফ সাইডের স্কোয়ার কাট আর কভার ড্রাইভ সর্বকালের সেরা। হিংসুকরা বলতো অন সাইডে খেলতে পারেন না। কতবড় নির্বোধ হলে এই কথাকে সমর্থন করা যায় । এতবড় দুর্বলতা নিয়ে ১২ বছর এই আকাশছোঁয়া সাফল্য নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা সম্ভব!

২০০৬ এর শেষদিকে সৌরভের কামব্যাক যখন নিশ্চিত। তখন কাছের লোকেরা বলেছিল – ১এত তাড়াহুড়োর দরকার কি, এই সিরিজটার ওপরে সারা জীবনের ক্রিকেট ক্যারিয়ার দাঁড়িয়ে আছে। তোমাকে আতস কাচের নিচে ফেলে দেখছে গোটা ক্রিকেট বিশ্ব, কি দরকার দক্ষিণ আফ্রিকার গ্রিনটপে গিয়ে স্টেইন, মরকেল, এনটিনিদের মুখোমুখি হওয়ার? এর চেয়ে অনেক দুর্বল ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভারতে আসছে এরপরেই ওদের বিরুদ্ধে সহজ সিরিজে কামব্যাক করো।’

উত্তরে দেওয়ালের কোনা থেকে ব্যাট তুলে উত্তেজিত ভাবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলেন সৌরভ। জবাব দিয়েছিলেন – ‘এইভাবে কাপুরুষের মতো ক্রিকেট কেন কোন খেলাই হয় না, এইভাবে বাচঁতে শিখিনি, যার সত্যিকারের ক্ষমতা আছে সে স্থান আর প্রতিপক্ষ বিচার করে না । যদি ক্ষমতা থাকে তো ওখানেই কিছু করে দেখাবো।’ কি করেছিলেন ইতিহাসে লেখা আছে!

পাকিস্তানের ফাস্ট বোলার শোয়েব আখতার নিজের আত্মজীবনীতে সৌরভ সমন্ধে লিখেছেন – ‘শরীরটা মানুষের কিন্তু ভেতরের খাঁচাটা দৈত্যের!’

পাকিস্তানের শাহিদ আফ্রিদি বলেছেন – ‘ও বান্দাহি থোড়া আলাগ হ্যায়!’ ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিস গেইল বলেছেন – ‘আইপিএল থেকে আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি সৌরভ গাঙ্গুলীর সাথে ওপেন করতে নামা, ওর মতো ম্যাচ রিডিং করতে আর কাউকে দেখিনি।’

শ্রীলঙ্কার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজ বলেছেন – ‘যে সৌরভকে সম্মান করতে পারেনা সে ক্রিকেটকে সম্মান করতে পারেনা। আইপিএলে সৌরভের অধিনায়কত্বে খেলতে পেরে আমি গর্বিত।’

খেলোয়াড়ী জীবনে অসংখ্য সমস্যার সমাধান করেছেন একদম সামনে থেকে। ম্যাচ ফিক্সিং করে আজহার-জাদেজারা ক্রিকেটকে ধর্ষণ করে সরে পড়ার পরে চাপ সামলাতে না পেরে ভদ্রলোক শচীনও যখন পালালেন তখন এক্কেবারে যাতা, অসংখ্য দোষে দুষ্ট গাঙ্গুলির ঘাড়ে অধিনায়কত্বের বোঝা ফেলে নিশ্চিন্ত হয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট। ২০০০ থেকে ২০০৮ সেরা ক্রিকেট খেলেছিল ভারত গাঙ্গুলির নেতৃত্বে।

এক সময়ে ভারতীয় ক্রিকেটে ওপেনিং জুড়ি টিকত দুই থেকে পাঁচ ওভার। গাঙ্গুলিকে ধরে ওপেনার বানিয়ে দেওয়া হোক! ঘরোয়া ক্রিকেটেও ওপেন না করা সাহসী সৌরভ নিজের ক্যারিয়ার বাজি রেখে ইনিংস শুরু করতে রাজি হয়ে যান।

কচ্ছপ গতির ওয়ানডে ব্যাটিং নিয়েও দ্রাবিড় টিকে গিয়েছিলেন উইকেটকিপিং করে, সাহসটা দেখিয়েছিলেন অধিনায়ক সৌরভ। শেবাগকে বলেছিলেন, ‘২৫ টা ম্যাচে শূন্য করলেও ২৬ নম্বর ম্যাচটা তুই খেলবি, যতক্ষণ আমি অধিনায়ক হিসাবে আছি।’ ধোনিকে সুযোগ দিয়েছিলেন, ব্যাটিং অর্ডারে ওপরে তুলে এনেছিলেন।

হরভজন আর কুম্বলেকে নিজের ক্যারিয়ারের বাজি রেখে বিদেশের মাটিতে বোর্ডের ঘোষনা উপেক্ষা করে নিয়ে যান এবং সফল হন। শুধু নিজে কারোর কাছ থেকে কোন নিরাপত্তা বা সাহায্যের আশ্বাস পাননি।

সবচেয়ে বড় দুটো ভুল করেছিলেন ২০০৩ ওয়ান্ডার্সে বিশ্বকাপ ফাইনালে টস জিতে ফিল্ডিং নিয়ে আর তৎকালীন মন্ত্রী অশোক দাশগুপ্তের সাথে কথা বলে নির্বাচক কমিটির চেয়ারম্যান দিলীপ বেঙ্গসরকারকে ক্রিকেট একাডেমির জন্যে জমির ব্যবস্থা করে দেবেন বলে। যেটা সম্ভব না হওয়ায় ভেঙ্গসরকার অস্ট্রেলিয়া সফরে ওয়ানডে দল থেকে সৌরভকে ছাঁটাই করেন।

মদত দেন ধোনি যিনি সৌরভের ব্যক্তিত্বের সামনে হীনমন্যতায় ভুগতেন। আর ছিলেন শ্রীনিবাসন ও গুরুনাথ মায়াপ্পন। শ্বশুর জামাই আবার ম্যাচ গড়াপেটার ব্যবসা নতুন করে শুরু করেছিলেন। যেটা সৌরভের মতো একটা লোক থাকলে কিছুতেই সম্ভব হচ্ছিল না।

সেই জন্যেই হঠাৎ করে অবসর ঘোষণার পরে সৌরভ প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন – ‘আজ রাত্রে নিশ্চিন্তে ঘুমাবো।’ কি আশ্চর্য্য কথা, একজন ক্রিকেটার যে সারা জীবন শান্তিতে ক্রিকেটটাই খেলতে পারেননি!

সত্যিই তিনি এইরকম সংগ্রামে সবসময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে জয় ছিনিয়ে এনেছিলেন, প্রকৃতঅর্থে তিনি একজন সংগ্রামী। অবসর পরবর্তীতে বাংলার মহারাজ বেঙ্গল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নিযুক্ত হন, সেখানেও তিনি দুর্দান্ত ভাবে সফল। দ্বিতীয় বাঙালি হিসেবে বর্তমানে তিনি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নিযুক্ত হবেন, আমরা জানি সেখানেও তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে দুর্নীতিমুক্ত দূরে হটিয়ে ক্রিকেট বোর্ডকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link