কলকাতার মানুষের নয়নমণি তিনি। খেলা ছেড়েছেন এক দশক পেরিয়ে গেছে, তবুও কলকাতাবাসী তাঁকে মহারাজা বলেই ডাকে। কলকাতাবাসীর আবেগ ঘুরপাক খায় তাঁকে ঘিরেই। তিনি সৌরভ গাঙ্গুলি, ‘প্রিন্স অব কলকাতা’।
প্রভাবশালী গাঙ্গুলি পরিবারের ছোট ছেলে সৌরভ। তিনি যখন জুনিয়র ক্রিকেটে আলো ছড়াচ্ছেন, তাঁর বাবা তখন ইডেন গার্ডেনসের কর্তা-ব্যক্তিদের একজন। বড়ভাই স্নেহাশিষও তখন বেঙ্গলের হয়ে খেলছেন। বিসিসিআই সভাপতি এবং বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব জগমোহন ডালমিয়া সৌরভের কাছে পিতৃতুল্য একজন মানুষ।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ভারতের ক্রিকেটের নতুন তারকা হিসেবে আবির্ভাব সৌরভ গাঙ্গুলির। সে সময়টাতে বাংলা পার করছিল ক্রান্তিকাল। রঞ্জি ট্রফিতে দলের বেশিরভাগ ব্যাটসম্যান ছিলেন বাইরের রাজ্য থেকে আসা। অরুণ লাল, অশোক মালহোত্রা, সাবা করিম, নরেন্দ্র হিরওয়ানি – ঘরের ছেলেদের ব্যর্থতার সুবাদে তাঁরাই হয়ে উঠেছিলেন বাংলার মুখ। ফুটবলেও একই দশা, দশাসই আফ্রিকান ফুটবলাররাই ক্রমাগত রাজা হয়ে উঠছিলেন কলকাতার লিগে।
তাঁদের দাপটের সামনে ম্রিয়মান বাংলার ছেলেরা। ঠিক সেই সময়টাতে যেন ত্রাতারূপে সৌরভের আবির্ভাব, এক লহমায় তিনি হয়ে উঠলেন বাংলার মানুষের আবেগ, তরুণদের রোলমডেল। কেবল রাজ্য দল নয়, পরবর্তী কয়েক বছরে হয়ে উঠলেন জাতীয় দলের মহীরুহ। ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অধিনায়ক। ভালো কিংবা খারাপ সময়ে গাঙ্গুলির আকাশে যখনই মেঘ করেছে, বাংলার মানুষ ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁদের আদরের সন্তানকে রক্ষা করতে। জাতীয় দলের অধিনায়ক কিংবা পরবর্তীতে বেঙ্গল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে – গাঙ্গুলির সকল সিদ্ধান্ত কায়মানোবাক্যে মেনে নিয়েছে কলকাতাবাসী। ডালমিয়া এবং দিদি দুজনেই আত্নসমর্পন করেছেন দাদার কাছে।
জীবনানন্দ দাসের কবিতার মতো করেই গাঙ্গুলি প্রেম একদিন ফুরোতে থাকে। রাজ্যের গন্ডি পেরিয়ে সৌরভ দায়িত্ব নেন পুরো ভারত ক্রিকেটের, বিসিসিআইয়ের সভাপতি হিসেবে নিয়োগ পান। কখনো কখনো আপনি তাঁকে পড়ে ফেলতে পারবেন, বুঝতে পারবেন তাঁর আদিনিবাস আসলে কলকাতাই। কলকাতাতে তাঁর জন্য কোনো নিয়মের সংবিধান ছিল না, তিনি যা করতেন তাই নিয়ম হয়ে যেতো। জীবনের এই অবাধ স্বাধীনতা তিনি উপভোগ করতেন।
বিসিসিআইয়ের সভাপতি থাকাকালীন সময়ে এই ব্যাপারটাই ফুটে উঠে তাঁর মাঝে, যখনই স্বার্থের সংঘাত বেধেছে কিংবা সভাপতি হিসেবে অনুচিত এমন কাজ করেছেন – গাঙ্গুলি পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে তা সঠিক প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। বোর্ড অব ডিরেক্টররাও সন্তুষ্ট ছিলেন না তাঁর কর্মকান্ডে। তাঁদের ভাষ্যমতে দল নির্বাচনে তিনি নির্বাচকদের সাথে মিটিংয়ে বসে তাঁদেরকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করতেন। এমনকি দল থেকে বাদ পড়ার পর উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান ঋদ্ধিমান সাহা দাবি করেছিলেন বোর্ড সভাপতি তাঁকে দলে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অথচ এরকম আচরণ তাঁর থেকে প্রত্যাশিত ছিল না।
ইডেন গার্ডেনসে তাঁর কথাই ছিল শেষ কথা, তাঁর কথা বেদবাক্যের মতো অনুসরণ করত সবাই। হয়তো পুরনো অভ্যাসবশত বিসিসিআইয়ের সভাপতি হবার পরও একই কাজ করবেন ভেবেছিলেন গাঙ্গুলি। নির্বাচকদের সভায় যুক্তিতে টিকতে না পেরে তিনি তাঁদের অবমূল্যায়ন করেছেন এবং শেষতক বলেছেন,’আমি কিন্তু ভারতের হয়ে ৩২৪ আন্তর্জাতিক ম্যাচে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছি।’ বিসিসিআইয়ের সভাপতি হিসেবে তাঁর নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝতে পারা উচিত ছিল। বুঝতে হতো কোথায় তাঁকে থামতে হবে। নির্বাচক হবার যে চেষ্টাটা তিনি করেছিলেন সেটা স্পষ্টতই প্রতিষ্ঠানের আইনবিরোধী।
তাঁর অভিধানে ‘স্বার্থের সংঘাত’ এর সংজ্ঞা ছিল খুব বিস্তৃত, সহজে নমনীয় এবং বোকার মতো। বিসিসিআইয়ের সভাপতি থাকাকালীন সময়ে তিনি এটিকে মোহনবাগানের মালিকানায় তিনি সমস্যা দেখেন না, যেখানে তাঁর পার্টনার আইপিএলেরই এক দলের মালিকানা কিনে নেয়। বোর্ড সভাপতি হয়েও তিনি ফ্যান্টাসি এক অ্যাপের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হন যেখানে তাঁদের প্রধান প্রতিদ্বন্দী কোম্পানি ছিল ভারত জাতীয় দলের প্রধান স্পন্সর।
তিনি তাঁর ইন্সট্রাগ্রাম থেকে জেএসডব্লিউ এর টিশার্ট পরা ছবিটিও সরাননি, যারা কিনা আইপিএল দল দিল্লি ক্যাপিটালসের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। গাঙ্গুলি অবশ্য বলার চেষ্টা করেন জেএসডব্লিউ এর ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হলেও বিসিসিআইয়ের সভাপতি হিসেবে কোনো প্রকার স্বার্থের সংঘাত ঘটবে না। ‘আমি কিভাবে প্রভাবিত করবো? আমি কোনো স্বার্থের সংঘাত দেখতে পাচ্ছি না। আমি তাঁদের ক্রিকেটীয় কোনো কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত না, যদি তাই থাকতাম তবে স্বার্থের সংঘাতের প্রশ্ন উঠতো।’
এই অভিযোগে অবশ্য গাঙ্গুলি একা দুষ্ট নন। ফ্যাব ফাইভের বাকি চারজন – শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষণ, অনিল কুম্বলে সবাই অভিযুক্ত। এক পর্যায়ে নিজেদের একাধিক স্বার্থের কারণে একে অন্যের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পরেন। তবে অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাঁদের সবার প্রতিক্রিয়াই একই রকম ছিল। তাঁদের মুল্যায়ন এমনকি সন্দেহ করায় তাঁরা কষ্ট পেয়েছিলেন।
অথচ ক্যারিয়ারজুড়ে এরা শত প্রত্যাশার চাপ, এজেন্টের চাহিদা, পরিবারের শত দায়িত্ব সামলে ক্রিকেট খেলেছেন। যখনই ক্রিকেট মাঠে নামতেন বাইরের সব কিছু ভুলে যেতেন, কেবল একটা কথাই ভাবতেন কিভাবে ভারতীয় ক্রিকেটকে আরো উচুতে নিয়ে যাওয়া যায়। তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিজীবনের সাথে ক্রিকেটজীবনের সামঞ্জস্য ঘটাতে পুরোপুরি সফল ছিলেন। কিন্তু ক্রিকেট প্রশাসক হিসেবে কাজ করতে এসে একই পদ্ধতির প্রতিফলন তাঁরা ঘটাতে পারেননি।
তবে এতে তাঁদের পুরো দোষ দেয়া যায় না। প্রথমে জনতা তাঁদের ঈশ্বর ভেবেছে এবং পরে আশা করেছে তাঁরা মানুষের মতো আচরণ করবে।