ধুম্রজালের স্পেন বেশ বোরিং

এবারের বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি বল পজিশন নিজেদের কাছে রেখেছে কোন দল। এমন প্রশ্নের উত্তরটা বেশ সোজা। স্পেন। এবারের টুর্নামেন্টে স্পেন দেখিয়েছে, কি করে পাসিং ফুটবলটা খেলতে হয়। স্পেন দেখিয়েছে কি করে টিকি-টাকা ফুটবল খেলতে হয়। তবে একটা জায়গায় স্পেন মাত খেয়ে গেছে। আর ঠিক সে কারণেই স্পেন ধরে ফেলেছে বাড়ির প্লেন।

স্পেনের বিশ্বকাপ স্কোয়াড ঘোষণার পর বিতর্কের সূত্রপাত ঘটেছিল। ডেভিড ডি গায়া আর সার্জিও রামোসকে দলে না রাখায়। সেটার স্বপক্ষে লুইস এনরিকের প্লেয়িং স্টাইলের কথা বারেবারে বলা হয়েছে। তিনি বল পায়ে সাবলীল খেলোয়াড়দেরই তাঁরা দলে প্রাধান্য দিয়েছেন। সেটা গোলরক্ষক থেকে শুরু করে একেবারে স্ট্রাইকিং পজিশন অবধি। এর পেছনের মূল কারণ, তিনি ক্ল্যাসিক টিকি-টাকা ফুটবলটা খেলতে চেয়েছেন। তিনি প্রতিপক্ষকে অতিষ্ঠ করে হারিয়ে দিতে চেয়েছেন।

তবে শেষ অবধি কতটুকু সফলতা এনরিকে পেলেন সে প্রশ্ন না হয় পরে তোলা যাবে। কিন্তু এটাতো অন্তত এনরিকে এবং তাঁর দল নির্ধিদ্ধায় স্বীকার করে নেবে, তাঁরা ব্যর্থ। তবে ব্যর্থতার উর্ধ্বে গিয়েও স্পেন চরমরকম বোরিং ফুটবল খেলেছে। প্রথম ম্যাচের কথা না হয় বাদ। কোস্টারিকার বিপক্ষে ম্যাচটা একটা ফ্লুক হিসেবেই ধরে নেওয়া যায়। না ফ্লুক না, সেটা কোস্টারিকার বড্ড খারাপ দিন। নয়ত ওমন বাজেভাবে গোল খাওয়াটা কঠিন। ২০১৪ সালে ব্রাজিল খেয়েছিল। তবে তাদের মোরালিটি একেবারেই তলানীতে ছিল তখন।

ওই ম্যাচটা জেতা স্পেনের জন্যে, লুইস এনরিকের জন্যে বড্ড বড় একটা ভুল। না, ম্যাচটা জেতা নয় ঠিক। ৭-০ গোলের বড় ব্যবধানে জেতাটা। একটা মরিচীকার দিকে ছুটতে থাকে। তাঁরা যে ভুল পথের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, সেটা অবশ্য জাপান তাদের বুঝিয়ে দেয়। ম্যাচের ৮৩% বল নিজেদের দখলে রাখা সত্ত্বেও সে ম্যাচটি তাঁরা হেরেছিল ২-১ ব্যবধানে। তবুও ওই যে প্রথম ম্যাচের ভুলে তাঁরা চলে যায় পরবর্তী রাউন্ডে। জাপানের কাছে অবশ্য জার্মানিও হেরেছিল একই ব্যবধানে।

সবাই হয়ত ভেবে বসল, দ্বিতীয় রাউন্ডে স্পেন নিজেদের সেই ধুম্রজাল থেকে বেড়িয়ে আসতে পারবে। তবে আফসোস, তাঁরা পারেনি। হাজার খানেক পাস খেলেও তাঁরা কাঙ্ক্ষিত গোলের দেখাটা পায়নি। কোথাও একটা স্পেনের স্পিরিটের অভাবটা স্পষ্ট। শেষ অবধি মরক্কোর কাছে পেনাল্টি শ্যুট-আউটে হারতে হয়েছে। আফ্রিকার দলটি প্রথমবারের মত কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে যাচ্ছে। অথচ, সবাই ধরেই নিয়েছিল স্পেন একটা সহজ জয় পেয়ে চলে যাবে পরের রাউন্ডে। ১০১৯টি পাস খেলে স্পেন মাত্র কেবল একটি শট গোল অভিমুখে রাখতে পেরেছে।

মরক্কোর গোলবার আবার সামলে রাখছিলেন স্প্যানিশ লিগে বছর খানেক আগে সেরা গোলরক্ষক হওয়া ইয়াসিন বোনো। তিনি এই টুর্নামেন্টে কেবল একটি গোলই হজম করেছেন। তাও আবার আত্মঘাতি। এমন একজন গোলরক্ষকের ঠিকঠাক পরীক্ষাই নিতে পারেনি স্প্যানিশ আক্রমণভাগ। প্রতিটা আক্রমণের পরিসমাপ্তিতে একরাশ হতাশা। অ্যাটাকিং থার্ডে স্পেনকে বেশ দিশাহীন মনে হয়েছে। এতে অবশ্য মরক্কোর দুর্দান্ত রক্ষণকেও কৃতীত্ব দেওয়া উচিৎ। তবুও স্পেন, যারা কি-না একবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন তাদের অন্তত এই ম্যাচে ভাল করবার কথা, জয় পাবার কথা।

যাই হোক মরক্কান খেলোয়াড়দের আপ্রাণ চেষ্টায় খেলাটা টাই-ব্রেকার অবধি নেওয়া গেছে। সেখানেও নির্ধিদ্বায় স্পেনের পরের রাউন্ডে চলে যাবার কথা অভিজ্ঞতার বিচারে। আগের দিন ক্রোয়েশিয়া তো তাই করে দেখিয়েছে। জাপান তাদের বিরুদ্ধে হেরেছে অভিজ্ঞতায় আর চাপ সংবরণ করতে না পারায়। মরক্কোর ক্ষেত্রেও তেমনটাই হবার কথা। তবে না, হয়েছে তাঁর উল্টো।

শোনা যায়, বিশ্বকাপের আগে এনরিকে তাঁর খেলোয়াড়দের হাজারটা পেনাল্টি শ্যুট অনুশীলন করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। খেলোয়াড়দের নিশ্চয়ই গুরুর কথা মানবার কথা। মেনেছেও হয়ত তাঁরা। তবে নির্দিষ্ট দিনে সে অনুশীলন কাজে লাগাতে ব্যর্থ লা রোজারা। পেনাল্টিতে একটি স্কোরও করতে পারেনি স্প্যানিশরা। এটা নিশ্চয়ই লজ্জার। মরক্কান খেলোয়াড়দের তুলোনায় স্প্যানিশ খেলোয়াড়দের বেশ নার্ভাস মনে হয়েছে টাই-ব্রেকারে। এটা অবশ্য এসেছে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি থেকে।

এই ঘাটতির মূল কারণ, তাদের আত্মঘাতী রণকৌশল। ফুটবলটা যে আখেরে গোলের খেলা। এখানে যে দিনশেষে গোলটাই সবচেয়ে বড় বিষয়, সেটাই ভুলে গিয়েছিল স্প্যানিশরা। আগের রাতেই ব্রাজিল দেখিয়েছিল ঠিক কি করে নান্দনিক ফুটবলের সাথে প্রতিপক্ষকে রীতিমত দুমড়ে-মুচড়ে ফেলতে হয়। স্পেনের কাছেও নিশ্চয়ই তেমনটা প্রত্যাশা ছিল সকলের। চরমভাবে ব্যর্থ! কোথাও একটা উইনিং স্পিরিটের বড্ড অভাব ছিল।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link