২০২১ সালটা ছিল স্পেনের জন্য ফিরে আসার। লুইস এনরিকের শিষ্যরা ২০১৮ বিশ্বকাপের ব্যর্থতা ভুলে পুরনো ঝলক দেখিয়েছিল গত ইউরোতে। টুর্নামেন্টের শুরুর দিকে খানিকটা নড়বড়ে লাগলেও স্লোভাকিয়ার বিপক্ষে ৫-০ গোলে জয়ের পর আর পেছনে ফিরে তাঁকাতে হয়নি। সেমিতে ডোনারুম্মা বীরত্বে টাইব্রেকারে না হারলে শিরোপা উঠতে পারতো স্পেনের হাতেও। বছরের শেষভাগে ন্যাশন্স লিগের ফাইনালেও খেলেছে লা রোজারা। সব মিলিয়ে এবারের বিশ্বকাপে দারুণ এক ফর্ম নিয়েই খেলতে যাচ্ছে স্প্যানিশরা।
স্পেন দলে সবচেয়ে বড় তারকা তাঁদের কোচ লুইস এনরিকে স্বয়ং। বার্সেলোনার হয়ে এক মৌসুমে ঘরোয়া সম্ভাব্য সকল ট্রফিই জিতেছিলেন। অন্যদিকে ২০১৪ এবং ২০১৮ বিশ্বকাপে বাজেভাবে বাদ পড়ার পর স্পেন জাতীয় ফুটবল দল হন্যে হয়ে খুঁজছিল এমন কাউকে যিনি কিনা পথ দেখাবেন ধবংসস্তুপ থেকে ফিরে আসার। ২০১৪ বিশ্বকাপে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হিসেবে খেলতে গিয়ে গ্রুপ পর্বেই বিদায় নিয়েছিল তাঁরা।
অন্যদিকে রাশিয়া বিশ্বকাপ শুরুর মাত্র দুইদিন আগে কোচ হুলেন লোপেতেগিকে বরখাস্ত করে তাঁরা। সব মিলিয়ে হতোদ্যম এক দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন এনরিকে। কিন্তু চার বছরের ব্যবধানে বদলে দিয়েছেন দলের চেহারা। তারুণ্যই তাঁর দলের বড় শক্তি, এবারের বিশ্বকাপে দলও সাজিয়েছেন তরুণদের নিয়েই।
গোলবারের নিচে এনরিকের প্রথম পছন্দ অ্যাথলেটিকো বিলবাওয়ের কিপার উনাই সিমন। মাঝেমধ্যে হাস্যকর সব ভুল করলেও পাসিং দক্ষতার জন্য বিশ্বকাপেও তাঁকেই দেখার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়া বেঞ্চে থাকবেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দুই কিপার রবার্তো সানচেজ এবং ডেভিড রায়া। দারুণ ফর্মে থাকা সত্ত্বেও ডেভিড ডে গিয়াকে না ডেকে পুরনো শিষ্যদের উপরই ভরসা রাখছেন কোচ।
তবে এনরিকের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত বোধহয় অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার সার্জিও রামোসকে ছাড়াই বিশ্বকাপের স্কোয়াড ঘোষণা। ইনজুরি কাটিয়ে দারুণ ফর্মে থাকলেও তাঁকে বাদ দিয়ে তরুণদের উপরই নির্ভর করছেন এই কোচ। দলে সুযোগ দিয়েছেন এরিক গার্সিয়া, আইমেরিক লাপোর্তে, পাউ তোরেস, হুগো গুইলামোন এর মত প্রতিভাবান সব তরুণকে। বলাই বাহুল্য এই তরুণরা কাতারে জ্বলে উঠলে স্পেনের জালে বল পাঠানো দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকারদের জন্য।
স্পেনের ডানপ্রান্ত সামলানোর দায়িত্বে থাকবেন অভিজ্ঞ ড্যানি কারাভাহাল। বয়সের কারণে গতি কমে গেলেও এখনো নিখুঁত সব ক্রস বাড়াতে সিদ্ধহস্ত এই ফুলব্যাক। তাঁর বিকল্প হিসেবে থাকবেন চেলসির সেজার আসপিলিকুয়েতার। বাঁ প্রান্তে এনরিকের আস্থা দুই পুরনো সেনানী হোসে গায়া এবং জর্ডি আলবা। ক্লাবে তরুণ আলেহান্দ্রো বালদের কাছে জায়গা হারালেও জাতীয় দলে নিজের জায়গাটা ঠিকই ধরে রেখেছেন আলবা।
মিডফিল্ড নিয়ে স্পেনের কোনোদিনই দুশ্চিন্তা ছিল না। বিশ্বসেরা সব মিডফিল্ডরা মাঝমাঠে রাজত্ব করেছেন লা রোজাদের হয়ে। এবারের বিশ্বকাপেও স্পেন দলে রয়েছেন এক ঝাঁক তারকা মিডফিল্ডার। অভিজ্ঞ সার্জিও বুসকেটস, কোকে, মার্কাস লরেন্তের পাশাপাশি সুযোগ পেয়েছেন তরুণ পেদ্রি, গাভি, রদ্রি, কার্লোস সোলেররা। আলাদা করে বলতে হয় পেদ্রির কথা, বার্সার এই ১৮ বছর বয়সী তরুণ অভিষেকের পর থেকেই আছেন দুর্দান্ত ফর্মে। দারুণ পাসিং দক্ষতার পাশাপাশি গোল করতেও সমান দক্ষ এই মিডফিল্ডার। এছাড়া প্রেসিং নির্ভর দলগুলোর বিপক্ষে কার্যকরী হয়ে উঠতে পারেন আরেক মিডফিল্ডার গাভি।
আক্রমণভাগের ডানপ্রান্তটা সামলাবেন এই বছরের শুরুতে বার্সায় নাম লেখানো ফেরান তোরেস। উইংগার হলেও খেলতে পারেন ফলস নাইন হিসেবে, ফিনিশিংটাও মন্দ নয়। বাঁ পাশে মার্কো অ্যাসেনসিওর জায়গাটা আবার তোরেসের মত নিশ্চিত নয়, ফর্ম নিয়ে চিন্তায় থাকা অ্যাসেনসিওকে বেঞ্চ করার জন্য দলে আছে আনসু ফাতি। বার্সার এই তরুণ লম্বা সময় ইনজুরির কারণে বাইরে থাকলেও ধীরে ধীরে পুরনো রূপে ফিরছেন।
স্ট্রাইকার হিসেবে এনরিকের প্রথম পছন্দ সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ ফরোয়ার্ড আলভারো মোরাতা। হাস্যকর সব মিস করে সমালোচনার শিকার হলেও গত ইউরোর সেমিফাইনালে সমতাসূচক গোল করে কোচের আস্থার প্রতিদান দিয়েছিলেন মোরাতা। এছাড়া বেঞ্চে থাকা ড্যানি ওলমো, ইয়েরেমি পিনো, নিকো উইলিয়ামস, পাবলো সারাবিয়ারা সামর্থ্য রাখেন যেকোনো মুহুর্তে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেবার।
আপাতদৃষ্টিতে শক্তিশালী দল মনে হলেও স্পেনের মূল সমস্যাটা ফিনিশিংয়ে। মিডফিল্ড থেকে বলের জোগানের অভাব না হলেও গোল করার মানুষের বড়ই অভাব। ডেভিড ভিয়ার পর আর সমমানের স্ট্রাইকার পায়নি লা রোজারা। আলভারো মোরাতা দলে থাকলেও তিনি গোল করেন কালেভদ্রে। গত ইউরোতে জেরার্ড মরেনো এবং মিকেল ওইয়ারজাবালরা দলে থাকলেও ফর্মহীনতায় তাঁদের কাউকেই দলে রাখেননি কোচ এনরিকে। নক আউট ম্যাচগুলোতে মোরাতার গোল খরা ভালোই ভোগাতে পারে স্পেনকে।
তবে এবারের স্পেন দলের এক্স ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেন বার্সেলোনার মিডফিল্ডার পেদ্রি। থিয়াগো, রদ্রি, ফ্যাবিয়ান রুইজ, ওলমোদের ছাপিয়ে মাত্র ১৮ বছর বয়সেই একাদশে জায়গা নিশ্চিত করে ফেলেছেন এই মিডফিল্ডার। ফাইনাল থার্ডে অসাধারণ, দারুণ ড্রিবলিং, ডিফেন্স চেড়া সব পাস বাড়ানোর পাশাপাশি ডিফেন্সিভ ওয়ার্করেটও দারুণ পেদ্রির। সবমিলিয়ে কমপ্লিট এক প্যাকেজ এই মিডফিল্ডার। নিজের দিনে একাই ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম এই তারকা।
গ্রুপ ই’তে স্পেনের সঙ্গী জার্মানি, কোস্টারিকা এবং জাপান। সুতরাং ধরে নেয়াই যায় গ্রুপ সেরা হবার দৌঁড়ে স্পেনের সবচেয়ে বড় বাঁধা জার্মানরাই। তবে এনরিকেকে আশা জাগাবে জার্মানির বিপক্ষে তাঁদের সাম্প্রতিক রেকর্ড, সবশেষ সাত দেখায় তাঁদের বিপক্ষে হার নেই স্পেনের। তবে কোন কারণে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলে কঠিন এক পথই অপেক্ষা করছে তাঁদের জন্য। দ্বিতীয় রাউন্ডেই বেলজিয়াম বাঁধা উতরে গেলে কোয়ার্টার ফাইনালে তাঁদের জন্য অপেক্ষায় থাকবে ব্রাজিল। অতএব, বিশ্বকাপ জেতার দৌঁড়ে টিকে থাকতে হলে স্পেনকে প্রথমে পেরোতে হবে গ্রুপ পর্বের জার্মান বাঁধা। অন্যথায় পথটা অনেকটাই বন্ধুর হয়ে যাবে তাঁদের জন্য।