বিশেষ ম্যাচের বিশেষ ইনিংস

২০১১ সালের ২৫ জুলাই। লর্ডসে ভারত মুখোমুখি হয়েছিল ইংল্যান্ডের। চার ম্যাচের টেস্ট সিরিজে প্রথম ম্যাচের প্রথম দিন ছিল এমনই একদিনে। সময়ের সাথে মিলিয়ে সেই টেস্টটি আপনার মনে পড়বে অনেকগুলো কারণে। প্রথমত ক্রিকেটের অভিজাত সংস্করণের ২০০০ তম ম্যাচ। ইংল্যান্ড-ভারত মুখোমুখি লড়াইয়ের ১০০ তম টেস্ট। ইংল্যান্ড দলের কোচ ডানকান ফ্লেচারের কোচিং ক্যারিয়ারের ১০০ তম টেস্ট। শচীন টেন্ডুলকারের শততম সেঞ্চুরির সম্ভাবনা নিয়ে আরেকটি ম্যাচ। আমার কাছে সেই টেস্ট ফিরে আসে কেভিন পিটারসেনের টেস্ট হয়ে।

ম্যাচটা কেপি খেলতে নেমেছিলেন পাহাড়সম চাপ মাথায় নিয়ে। তিন বছর ধরে ঘরের মাঠে তিন অঙ্কের দেখা পাননি। সর্বশেষ ঘরের মাঠে সেঞ্চুরি করেছিলেন ওভালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২০০৮ সালে। অ্যান্ড্রু স্ট্রাউসের আউটের পর উইকেটে আসেন কেপি। ঘরের মাঠে বড় ইনিংস নিয়ে যে অস্বস্তিতে আছেন সেটা স্পষ্ট করলেন কেপি নিজেই।

বল ব্যাটের কানা ছুঁতে চেয়েও ছুঁতে পারেনি কয়েকবার। ইনিংসের শুরুতে ছোট ছোট সুইংয়ের সামনে ফুট মুভমেন্ট দেখে আঁচ করা যাচ্ছিল মনোবল খানিকটা নড়বড়ে! প্রথম ৮০ বলের মধ্যে ৬৫ টাই ডট দিয়েছেন। যে দুটো চার মেরেছেন, দুটোই ব্যাটের কানা ছুঁয়ে স্লিপ দিয়ে সুপ্রসন্ন ভাগ্যর বদৌলতে।

অবশ্য তাতে লর্ডসের উইকেটেরও দায় আছে কিছুটা! ম্যাচ শুরুর রাত থেকে উইকেট ঢাকা, ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে উইকেট ঢাকা ছিল আধঘন্টা দেরীতে টস হওয়ার সময়ও। মেঘলা আবহাওয়ায় দরুন পিচের ময়েশ্চার কাজে লাগিয়ে ইনিংসের শুরু থেকেই দারুণ বল করছিলেন জহির খান এবং প্রবীন কুমার।

প্রথম ৮০ বল থেকে কেপি করতে পেরেছিলেন মাত্র ২৩ রান। ইনিংসের ৮৭ তম বলে পায়ের দারুণ ব্যবহারে মিডঅন দিয়ে ইশান্ত শর্মাকে মারা চারে অবশেষে দর্শকের কেপি’কে খুঁজে পাওয়া গেলো। মিডঅন দিয়ে মারা চারের সূত্র ধরে একদমই মনের কৌতূহল মেটাতে ইএসপিএন ক্রিকইনফোর ‘wagon-wheels’ টা দেখছিলাম। সেই ইনিংসের ২০২ রানের মধ্যে ১২০ রানই অন সাইড দিয়ে নিয়েছিলেন কেপি। তখনই মনে হলো মিডঅন কিংবা মিড উইকেটের উপর দিয়ে একেকটা শটে কতবারই তো ‘ওয়াও’ শব্দটা বের করিয়ে নিয়েছিলেন তিনি।

পিটারসেন সেদিন খেলেছিলেন সুনীল গাভাস্কারের মন্ত্র জপতে জপতে! সেই মন্ত্রে ৩২৬ বলের ইনিংসটাকে যদি প্রতি সেশনে ৮০ বল হিসেবে চারটা সেশনে ভাগ করি। তাহলে প্রথম সেশনটা বোলারের হাতে সমর্পণ করেছিলেন। দ্বিতীয় সেশনটা তাঁর ঘুরে দাঁড়ানোর। এই সেশনের ৮০ বলে ৫ চারের সাহায্য কেপি করেছেন ৪৮ রান। ডট বলের সংখ্যা ৬৫ থেকে কমে আসে ৪৮-এ।

তৃতীয় সেশনে ঝড়ের পূর্বাভাস দিলেন খানিক রয়েসয়ে খেলে। এই সেশনে রান করেন ৪২। ডট বলের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৮-তে। চারের সংখ্যা ওই পাঁচটিই। চতুর্থ এবং শেষ সেশনে বিধ্বংসী কেপির উপস্থিতি টের পেল ভারতীয় বোলাররা। এই সেশনে ৮৬ বলে করেছেন ৮৯ রান। স্বাভাবিকভাবেই ডট বলের সংখ্যা কমে আসে ৪৫-এ।

নয় চারের সঙ্গে লং অন দিয়ে সুরেশ রায়নাকে মারা বিশাল ছক্কা। এই সুরেশ রায়নাকে পয়েন্ট অঞ্চল দিয়ে দারুণ এক কাট শটে চার মেরে ডাবল সেঞ্চুরিতে পৌঁছেছিলেন কেপি। তাক করে থাকা একেকটা ক্যামেরা উদযাপনে মত্ত কেপিকে খুঁজে নিয়েছিল স্থিরচিত্রে। ধারাভাষ্যকক্ষ থেকে হার্শা ভোগলে সেটাতে যোগ করেন বাড়তি মাত্রা – ‘হি ক্যান বি মাইটি প্রাউড অব দিস। গন কেভিন পিটারসেন, গো… গো… গো থ্রু দ্য সেলিব্রেশন। বিকজ ইউ ডিজার্ভ ইট।’

চার ছক্কা ছাড়াও রায়নার আট বল থেকে নিয়েছেন ২৪ রান। তবে পুরো ইনিংসে ঝড়টা বেশি গেছে ইশান্ত শর্মার উপর দিয়ে। আগের সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে তাদের মাটিতে হয়েছিলেন সিরিজ-সেরা। ব্রিটিশ ভূমিতে কেপির ডেরায় এসে যেন লাইন লেংথ গুলিয়ে ফেললেন। সেটারই খেসারত হিসেবে কেপির ইনিংসের ২১ চারের ১০ টিতেই বোলারের নাম ইশান্ত শর্মা। বলের হিসেবে ইশান্তের ১০১ বল থেকে নিয়েছেন ৭৫ রান।

কেপি সেই স্পেশাল খেলোয়াড় যার প্রেমে অজি ফ্যান ‘মজনু; হয়। ক্রিকেট একজন ক্রিকেটারের জীবনেরই অংশবিশেষ। কিন্তু ক্রিকেটের উথান-পতন একটা জীবনের সামগ্রিক প্রেক্ষাপট! তাই হয়তো-বা উপলব্ধির ব্যাপারগুলো মাঝামাঝে ক্রিকেটের সীমানা ছাড়িয়ে যায়।

এই যেমন সেই ইনিংসের পর কেপির কথাগুলো আপনি চাইলে জীবনের আয়নায় বাঁধিয়ে রাখতে পারেন, ‘আপনার ভাল সময় বা খারাপ সময় আসতেই পারে। তবে, সেই ব্যপারে আপনাকে সৎ থাকতে হবে, নিজের কাজে আপনাকে চূড়ান্ত পরিশ্রম করতে হবে। কঠোর পরিশ্রম করলে তার ফল আসবেই।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link