দোর্দণ্ড দাপটের সেই তিন দিন!

তিন মে, ২০০২। দিনটাকে মনে রাখে পাকিস্তান ক্রিকেট। এই দিনে লাহোরে ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ইতিহাস রচনা করে টেস্ট জয় পায় পাকিস্তান। ইনজামাম উল হকের সেই মহাকাব্যিক ইনিংস আর শোয়েব আখতারের অগ্নিঝড়া বোলিং স্পেলে উড়ে যায় সফরকারীরা। মাত্র তিন দিনেই একক আধিপত্য বিস্তার করে লাহোর টেস্ট নিজেদের করে নেয় পাকিস্তান।

টেস্ট ক্রিকেট মানেই মর্যাদার লড়াই, টেস্ট ক্রিকেট মানেই রানের পাহাড় কিংবা উইকেট ভর্তি ঝুলি! পাঁচ দিনের লড়াইয়ে নাটকীয় সব মুহূর্ত আর ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলানোর ফরম্যাট। টেস্ট ইতিহাসে অনেক অনেক মহাকাব্যিক ইনিংস যেমন আছে তেমনি অগ্নিঝরা বোলিং স্পেলও আছে। তেমনি ২০০২ সালে লাহোরে এক ঐতিহাসিক টেস্ট ম্যাচের ইতিহাস আছে। যে টেস্টে মহাকাব্যিক ইনিংস ও অগ্নিঝরা বোলিং দু’টোর সাক্ষীই হয়েছিলো ক্রিকেট দুনিয়া।

তিন মে, ২০০২।

দিনটাকে মনে রাখে পাকিস্তান ক্রিকেট। এই দিনে লাহোরে ঘরের মাঠে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ইতিহাস রচনা করে টেস্ট জয় পায় পাকিস্তান। ইনজামাম উল হকের সেই মহাকাব্যিক ইনিংস আর শোয়েব আখতারের অগ্নিঝড়া বোলিং স্পেলে উড়ে যায় সফরকারীরা। মাত্র তিন দিনেই একক আধিপত্য বিস্তার করে লাহোর টেস্ট নিজেদের করে নেয় পাকিস্তান।

পাঠক, সেই ঐতিহাসিক লাহোর টেস্টের আদি-অন্ত টা আরেকবার স্মৃতিচারণ করা যাক। ইনজামাম-শোয়েব আক্তারদের সেই দাপুটে দিনগুলো আরেকবার ফিরে দেখা যাক।

এক মে, ২০০২।

লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে দুই ম্যাচ সিরিজের প্রথম টেস্টে টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয় স্বাগতিক পাকিস্তান৷ পাকিস্তানের হয়ে ওপেনিংয়ে নামেন ইমরান নাজির ও শহীদ আফ্রিদি। ইনিংসের প্রথম ওভারের তৃতীয় বলেই নিজের খেলা প্রথম বলে ড্যারেল টাফির বলে শূন্য রানে আউট হয়ে বিদায় নেন আফ্রিদি।

দলীয় এক রানেই পাকিস্তানের প্রথম উইকেটের পতন হয়। এরপর দ্বিতীয় উইকেটে ইউনুস খানকে নিয়ে ৫৬ রানের জুটি গড়ার পথে ব্যক্তিগত ২৭ রান করে আউট হন ইউনুস খানও! ৫৭ রানে দুই উইকেট হারিয়ে কিছুটা চাপের মুখে পড়ে পাকিস্তান।

তবে তৃতীয় উইকেটে ইমরান নাজির ও ইনজামাম উল হকের অনবদ্য ২০৪ রানের জুটি চাপ সামাল দেয়! দুই জনই তুলে নেন সেঞ্চুরি। এরপর দলীয় ২৬১ রানে ইমরান নাজির ১২৭ রানে ফিরলেও একপ্রান্তে একা হাতে প্রতিরোধ গড়েন ইনজামাম।

অপরপ্রান্তে মোহাম্মদ ইউসুফ ও আব্দুল রাজ্জাকরা অল্প অল্প রানের ইনিংস খেললেও অনেকটা নিয়মিত বিরতিতে আসা যাওয়ার মিছিলেই ছিলেন তারা! ইনজামাম ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেও আরেক প্রান্তে কেউই খেলতে পারেনি বড় ইনিংস। ৪ উইকেটে ৩৫৫ রান নিয়ে প্রথম দিন শেষ করে স্বাগতিকরা।

২ মে, ২০০২।

এরপর দ্বিতীয় দিনে পাহাড়সম সংগ্রহের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামে পাকিস্তান। একপ্রান্তে উইকেটে থিতু হয়ে একে একে ডাবল সেঞ্চুরি ও ত্রিপল সেঞ্চুরি তুলে নেন ইনজামাম। আরেক প্রান্তে ছিলো উইকেটের মিছিল। দলীয় ৫৩৪ রানে যখন পাকিস্তানের ৮ উইকেট, তখনো উইকেটের একপ্রান্তে রান তোলায় ব্যস্ত ইনজামাম।

এরপর নবম উইকেটে শোয়েব আক্তারের সাথে ৭৮ রানের এক অসাধারণ জুটিতে ৬০০ রানের কোটা পেরোয় পাকিস্তান! শোয়েব আক্তার তৃতীয় সর্বোচ্চ ৩৭ রান করে ফিরলে শেষ উইকেটে আর ৩১ রান যোগ করতে ৬৪৩ রানে ব্যক্তিগত ৩২৯ রানের এক মহাকাব্যিক ইনিংস খেলে আউট হন ইনজামাম উল হক! ৩৪ চার আর ৯ ছক্কায় নিজের ইনিংস সাজান ইনজামাম।

৬৪৩ রানের পাহাড়সম রান সামনে রেখে দ্বিতীয় দিনের শেষ ভাগে নিজেদের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নামে সফরকারী নিউজিল্যান্ড। ব্যাটিংয়ে নেমে শোয়েব আক্তারের বোলিং তোপে দিনশেষে ৬ উইকেটে ৫৮ রান!

৩ মে, ২০০২।

দিনের শুরুতে মাত্র ১৫ রান যোগ করতেই বাকি ৪ উইকেট হারিয়ে ৭৩ রানেই নিজেদের প্রথম ইনিংস গুড়িয়ে যায় কিউইদের। ভাগ্যক্রমে মোটে দু’জন ব্যাটসম্যান দুই অঙ্কের কোটা ছুঁতে পেরেছিলো! মাত্র ১১ রানেই ৬ উইকেট শিকার করেন শোয়েব আখতার! কিউইদের পক্ষে ল্যু ভিনসেন্ট সর্বোচ্চ ১৫ রান করেন।

প্রথম ইনিংসে ফলোয়ানে পড়ে নিউজিল্যান্ড। এরপর প্রথম ইনিংসে ৫৭০ রানের পাহাড়সম রানে পিছিয়ে থেকে আবারো ব্যাটিংয়ে নামে সফরকারীরা। ব্যাটিংয়ে নেমে প্রথম ওভারেই প্রথম উইকেটের পতন হয় নিউজিল্যান্ডের। এরপর দলীয় ৬৯ রানে রিচার্ডসন আর ১০১ রানে ল্যু ভিনসেন্ট ফিরলে আবারো সেই ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে ব্ল্যাক ক্যাপরা।

আগের ইনিংসের সর্বোচ্চ স্কোরার ভিনচেন্ট এই ইনিংসেও করেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৫৭ রান। চতুর্থ উইকেটে অধিনায়ক স্টিভেন ফ্লেমিং ও ক্রিস হ্যারিসের ৮৫ রানের জুটি চাপ সামাল দিলেও এরপর দানিশ কানেরিয়ায় ঘূর্নিতে দিশেহারা হয়ে পড়ে কিউইরা। একপ্রান্তে ফ্লেমিং ভীত গড়ার চেষ্টা করলেও আরেক প্রান্তে কানেরিয়া ঘূর্নিতে ছিলো আশা যাওয়ার মিছিল!

১৮৬ রানে তিন উইকেট থেকে ১৯৩ রানেই হারায় ৬ উইকেট! এরপর ২০৪ রানে নেই ৭ম উইকেট। হার যখন চোখ রাঙাচ্ছিল কিউইদের সামনে তখন একপ্রান্তে ফিফটি তুলে নেন অধিনায়ক স্টিভেন ফ্লেমিং। তবে দলীয় ২২৭ রানে ব্যক্তিগত ৬৬ রানে তিনিও ফিরলে আর ১৯ রান যোগ করতেই ২৪৬ রানেই গুড়িয়ে যায় কিউইরা।

দানিশ কানেরিয়া শিকার করেন ৫ উইকেট! ঐতিহাসিক প্রথম টেস্টে পাকিস্তান জয় পায় এক ইনিংস ও ৩২৪ রানের বিশাল ব্যবধানে। টেস্টের ইতিহাসে সেটা সবচেয়ে বড় জয়ের তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে আছে। ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতেন মহাকাব্যিক সেই ৩২৯ রানের ইনিংস খেলা ইনজামাম উল হক।

পাকিস্তানের টেস্ট ইতিহাসের সেরা জয়ের একটি ছিলো এই টেস্ট। টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পাঁচ জয়ের একটি ছিলো এটি। লাহোরে সেদিন ইনজামাম-শোয়েব আখতাররা একবার ব্যাট হাতে দাম্ভিক ইনিংসের পর আবার বল হাতে দাপট দেখিয়েছিলেন। দুই দশকের বেশি সময় পরও ইতিহাসে সেই স্মৃতি আজো তাজা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...