মাঠ আছে, মাঠ নেই

রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় নিজস্ব জমি আর অর্থায়নে গড়ে তোলা হচ্ছে স্পোর্টস কমপ্লেক্স। দেশের প্রথম ক্লাব হিসেবে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন ক্লাবটি এমন উদ্যোগ গ্রহন করেছে। মূলত দেশের ক্রীড়াঙ্গনে অবদান রাখার পাশাপাশি নিজেদেরকে পরিপূর্ন আর পেশাদার ক্লাব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেই এমন উদ্যোগের কথা জানা গেছে।

এবার প্রথমবারের মতো বিপিএল ফুটবলের ম্যাচ আয়োজন করার দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়ে ছিল বসুন্ধরা স্পোর্টস কমপ্লেক্স। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ৩ ফেব্রুয়ারি স্বাধীনতা ক্রীড়া সংঘের ম্যাচ দিয়ে নতুন ইতিহাস গড়ার অপেক্ষায় ছিল তাঁরা। কিন্তু সেটি আর হলোনা। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের কোন পেশাদার ক্লাব যা করে দেখাতে পারেনি বসুন্ধরা কিংস সেটা করে দেখানোর খুব কাছকাছি দাড়িয়ে রয়েছে।

বাংলাদেশের প্রথম ক্লাব হিসেবে নিজেদের হোম ভেন্যুতে নিজেদের করা স্টেডিয়ামে প্রথম ম্যাচ খেলার অপেক্ষা ছিল বসুন্ধরা কিংস! বাংলাদেশের আধুনিক ক্রীড়াঙ্গনের ধারক হিসেবে পরিচিত আবাহনী লিমিটেড ঢাকায় স্পোর্টস কমপ্লেক্স তৈরি করতে সময় নিলেও এখনো সেটি হয়নি। সে হিসেবে কিছুটা হলেও এগিয়ে রয়েছে বসুন্ধরা।

এছাড়া মোহামেডান ও সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবের নিজস্ব স্পোর্টস কমপ্লেক্স করার কথা শোনা গেলেও কোনটাই বাস্তব রুপ লাভ করেনি। সেখানে সবাইকে পেছনে নতুন ইতিহাস তৈরির খুব কাছে দাড়িয়ে রয়েছে বসুন্ধরা কিংস। কিন্তু এই মাঠে খেলা না হওয়াটাকে স্বাভাবিক বলতে চাইছেন না কেউ।

অথচ শুরুতে রিজার্ভসহ নয় টি ভেন্যু নিয়ে পেশাদার ফুটবলের সর্বোচ্চ আসর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) শুরু করতে চেয়েছিল। এরপর সাতটি থেকে চারটি এবং সবশেষ মাত্র দুটি ভেন্যুতে খেলা শুরু হতে যাচ্ছে। অনেকটা হারাধনের আটটি চেলে মধ্যে রইল মাত্র দুই! আবার অনেকে বলে থাকেন হারাধনের দশটি ছেলের মৃত্যু হয়েছিল অপঘাতে।

কেউ পানিতে ডুবে, কারো সাপের কামড়ে আবার কারো বোয়াল মাছের পেটেও প্রাণ গিয়েছিল তাদের। বলা যায় নয়টি ভেন্যুর সাতটিরই মৃত্যু হয়েছে অপঘাতে! প্রস্তুত থাকলেও খেলা হচ্ছে না বসুন্ধরা কিংস কমপ্লেক্সে। অথচ সবকিছুই প্রস্তু ছিল। শুধুমাত্র লিগ কমিটির হঠকারি সিদ্বান্তের কারণেই এমনটি হয়েছে বলে ক্লাবটির কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন। নয়তো আজই ইতিহাসের পাতায় ঠাই হয়ে যেত বসুন্ধরা কিংসের।

অথচ ভেন্যু তালিকায় কিংসের নাম অনুমোদন দিয়েছিল পেশাদার লিগ কমিটি। সেভাবে ক্লাবটি প্রস্তুতি নিয়েছিল। বাফুফে থেকে বলা হয়েছিল ভেন্যুটি তাদের নিয়ন্ত্রনে থাকবে। অন্যদিকে বসুন্ধরা কর্তৃপক্ষ বলেছিল নিজ ক্লাবের পাশাপাশি শেখ রাসেলের ম্যাচগুলো রেখে বাকি ম্যাচগুলো যেন বাইরের ভেন্যুতে আয়োজন করা হয়। আর তাতেই ভেন্যু বাতিলের ছুতো পেয়ে যায়।

পরে খেলা শুরুর ৪৮ ঘন্টারও কম সময় আগে বসুন্ধরা ভেন্যু বাতিল করা হয়। অথচ ম্যাচ পরিচালনা করা রেফারীদের কাছে যে ম্যাচের তালিকা পাঠানো হয় সেখানে বসুন্ধরা কমপ্লেক্সের নাম ছিল! লিগ কমিটির সর্বশেষ সভায় এক ক্লাব প্রতিনিধি নাকি বলেছেন, বসুন্ধরা কিংসের ইতিহাস গড়া নাকি অনেকেরই পছন্দ হয়না।

এখনো কাজ শেষ হয়নি এই অযুহাতও দাড় করিয়েছে সালাম মুর্শেদির নেতৃত্বাধীন লিগ কমিটি। বসুন্ধরা কিংসের নিজেদের তৈরি করা স্পোর্টস এরেনা পরিদর্শন করেছিল ঢাকায় প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হওয়া প্রো লাইসেন্সে অংশগ্রহনকারী কোচরা। পরে বাফুফে ভবনে ফিরে এই মাঠের প্রশংসাও করেছিল। কিন্তু বাফুফেরই কেবল পছন্দ হলোনা।

অথচ বাংলাদেশ কেন দক্ষিন এশিয়ার কোন দেশই এখন পর্যন্ত নিজেদের তৈরি মাঠ পায়নি। সেখানে মাত্র চার বছরের মধ্যেই একটি ফুটবল মাঠ তৈরি করে নতুন পথও দেখিয়েছিল ক্লাবটি। সে কারণেই বসুন্ধরা কিংস সভাপতি ইমরুল হাসান চরমভাবে হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, ’আমরা দেশের ফুটবলকে নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সবকিছু ঠিক থাকার পরও বসুন্ধরা স্পোর্টস কমপ্লেক্সে খেলা অনুষ্ঠান করা যাচ্ছেনা। বিষয়টি নিয়ে যা হয়েছে সেটিকে দু:খজনক না বলে আর কিউবা বলতে পারি। আমি এমনটি আশা করি নাই। ইতিহাস থেকে আমাদের দুরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।’

লিগ কমিটির সর্বশেষ সভার পর বাফুফের পাঠানো খসড়া সূচিতে প্রথম লেগের ১১ ম্যাচে নিজেদের মাঠে মাত্র তিনটি ম্যাচ খেলার কথা ছিল বসুন্ধরার। আর এই মাঠেই আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচও আয়োজনের পরিকল্পনাও করে রেখেছিল বাফুফে। বসুন্ধরার আপত্তিকে কেন্দ্র করে জরুরি বৈঠকে বসে পেশাদার লিগ কমিটি। আড়াই ঘণ্টা ধরে চলা এই সভাতে বসুন্ধরার মালিক পক্ষের সঙ্গে পেশাদার লিগ কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম মুর্শেদীর কয়েকবার ফোনালাপও হয়েছে। তবে তাতে কোন কাজই হয়নি। শেষ পর্যন্ত বসুন্ধরা স্পোর্টস কমপ্লেক্সের আশা ছেড়ে টঙ্গী ও মুন্সিগঞ্জকেই প্রথম লেগের ভেন্যু হিসেবে নাম প্রকাশ করা হয়েছে।

তাই ফুটবল ভালবাসা মানুষ ভালভাবে নেয়নি বিষয়টিকে। এদিকে ঘরোয়া ফুটবলের মর্যাদার আসর বিপিএল শুরু ২৪ ঘন্টারও কম সময় আগে ভেন্যু নিয়ে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ আর্চারী ফেডারেশন। ভেন্যু জটিলতাকে সঙ্গি করেই বৃহস্পতিবার থেকে মাঠে গড়াচ্ছে পেশাদার ফুটবলের সর্বোচচ আসরটি। এদিন টঙ্গীতে চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরা কিংস খেলবে নবাগত স্বাধীনতা ক্রীড়া সংঘের বিপক্ষে।

অন্য ম্যাচে মুন্সিগঞ্জের শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব মাঠে নামবে উত্তর বারিধারা ক্লাব। বিপিএল মাঠে গড়ানোর আগের দিন ভেন্যু জটিলতায় হঠাৎ করেই প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে আর্চারি ফেডারেশন। টঙ্গীর শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়ামকে বিপিএলের ভেন্যু করায় আপত্তি তুলেছে আর্চারি ফেডারেশন। কারণ এই স্টেডিয়াম আর্চারিরর স্থায়ী ভেন্যু। যেখানে সারা বছর তীর ধনুকের খেলোয়াড়রা অনুশীলন করে থাকেন।

এখানে ফুটবল খেলা হলে জাতীয় দলের আর্চারদের অনুশীলন নিশ্চিতভাবে বাধাগ্রস্থ হবে। সংবাদ সম্মেলনে আর্চারি ফেডারেশনের সভাপতি লে. জেনারেল (অব.) মো. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘২০২০-২১ মৌসুমে এই স্টেডিয়ামে ১৩ সপ্তাহে বিপিএলের পাঁচটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যার মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫টি এবং মার্চে ১২টি ম্যাচ রাখা হয়েছে। অথচ বিশ্ব আর্চারীর র‌্যাঙ্কিং বাড়াতে এ বছর আমাদের ৪১টি কার্যক্রম রয়েছে। যার সবকটিই এই হচ্ছে আবার স্টেডিয়াম কেন্দ্রিক। এখন আমাদের কি হবে আর আমরা কোথায় যাবো বলেন?’

ঘরোয়া ফুটবলে বাফুফে মাঠের জন্য হাহাকার করে, সেখানে মাঠ থাকার পরও ব্যবহার করতে না দেওয়া যৌক্তিকতা কি!

ভেন্যু নির্ধারণের জন্য দুই মাস সময় পেলেও লিগের জন্য ভেন্যু চূড়ান্ত করতে অনেক সময় নিয়েছে বাফুফে। দেশের ফুটবলে সিনিয়র পর্যায়ে ম্যাচ আয়োজনে রাজধানী ঢাকায় একমাত্র সম্বল এই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। সংস্কার কাজ চলমান থাকায় আগেই ঘোষনা এসেছিল ২০২১-২২ মৌসুমে বিপিএল ফুটবলের সব ম্যাচ হবে ঢাকার বাইরে। কিন্তু হলো তার ছিটেফোটাও।

গত নভেম্বরে পেশাদার লিগ কমিটির সভায় জানানো হয়েছিল আটটি ভেন্যু চূড়ান্ত করার কথা। এরপর সবদিক বিবেচনা করে সেখান থেকে ছয়টি ভেন্যুকে বেছে নেওয়া হবে। স্বাধীনতা কাপ ও ফেডারেশন কাপের পর এখন অল্প সময় থাকলেও ভেন্যু নিয়ে জটিলতায় পড়ে গেছে পেশাদার লিগ কমিটি। দুই মাসের বেশি সময় পেলেও ভেন্যু চুড়ান্ত করতে না পারায় নানা সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে। ১২ দল নিয়ে জানুয়ারির মাঝামাঝিতে লিগ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ক্লাবগুলোর অনুরোধে তা পিছিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে নেওয়া হয়েছে।

সময় পাওয়ার পরও ভেন্যু চূড়ান্ত করতে না পারায় তাই সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে বাফুফেকে। দুর্দান্তভাবে মৌসুম শুরু করা ঢাকা আবাহনীর হোম ভেন্যু সিলেট জেলা স্টেডিয়াম এবং মোহামেডান চেয়েছিল কুমিল্লা শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়াম, কিন্তু এসব আর কিছুই হয়নি। জানা গেছে, দুই ঐতিহ্যবাহী দলের হোম ভেন্যুই কিনা এখনো পর্যন্ত ম্যাচ আয়োজনের জন্য উপযোগী করা হয়নি।

দুই মাঠেই নিয়মিত স্থানীয় ক্রিকেট টুর্নামেন্টগুলো আয়োজন হয়ে থাকে। যার মধ্যে সিলেট জেলা স্টেডিয়ামে চলছে স্থানীয় প্রথম বিভাগ লিগের খেলা। আর যে কারণে মাঠের মাঝখানে ক্রিকেট পিচ থাকায় ফুটবলের জন্য প্রস্তুত করা সম্ভব হচ্ছেনা। তবে জানুয়ারী মাসের মধ্যে নাকি এই দুই মাঠ ফুটবলের জন্য উপযুক্ত করা হবে, এমনটাই জানিয়েছেন পেশাদার লিগ কমিটির চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম মুর্শেদি। এদিকে নিজেদের তৈরি স্পোর্টস কমপ্লেক্সে প্রথমবারের খেলতে মুখিয়ে ছিল বসুন্ধরা কিংস। এছাড়া অংশগ্রহনকারী ১২টি দলের সম্ভাব্য ভেন্যু তালিকার কোন কিছুই আর পেশাদারী ভঙ্গিতে করতে পারেনি পেশাদার লিগ কমিটি।

নিজেদের ভেন্যু নিয়ে বাফুফের মধ্যে তেমন একটা আগ্রহ দেখা যায়নি। তবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সংষ্কার কাজ চলমান থাকায় সমস্যাটা বেশি তৈরি হয়েছে। এছাড়া ইচ্ছে থাকলেও নেওয়া সম্ভব হয়নি বসুন্ধরা স্পোর্টস কমপ্লেক্সকে। শুরুতে আটটি ভেন্যু নিয়ে কথা ওঠার পর এখন মাত্র দুটি ভেন্যুতে লিগ শুরু করছে লিগ কমিটি।

যার একটি গাজীপুরের টঙ্গীর শহীধ আহসানউল্লাহ মাস্টার স্টেডিয়াম ও মুন্সিগঞ্জের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্টেডিয়াম! ভেন্যু সংকটের শেষ কোথায় সে উতর কারোরই জানা নেই। তবে নিজেদের পয়সা খরচ করে বসুন্ধরা কিংসকে যে বাইরের মাঠে খেলতে হবে এটা নিয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বলা যায় বাফুফে কোন জায়গাতেই পেশাদারিত্বের ছিটেফোটাও দেখাতে পারেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link