আরেক লিওর গল্প। তিনি কি আর্জেন্টিনার যিশু? হয়তো তাই। নীল-সাদার পৃথিবী দেখার পর মনে হচ্ছে তিনিই যিশু। তাঁর হাত ধরেই তো কালো মেঘের হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে মায়াবী আলোয় ভাসছে বুয়েনোস এয়ার্স। আর্জেন্তিনীয়রা বলেন ওখানে নাকি ভাল বাতাস বয়। ওখানে এখন বসন্তর বাতাস বইছে।
এই লিও বিশ্ববন্দিত নন। বরং তীব্র সমালোচিত। রক্তাক্ত। একসময়ে নাক উঁচু ইংরেজদের ক্লাব থেকে চোখের জলে বিদায় নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে।’
তাঁর বাবার কাঁধে মুখ গুঁজে কেঁদে চলেছিলেন। তাঁর কোচ, সতীর্থরা তাঁকে ভিলেন সাজিয়েছিলেন। ১৬ বছর আগের এক ঘটনার জন্য আজও তাঁকে ক্ষমা করতে পারেন না ওয়েস্ট হ্যামের সমর্থকরা। সেই সময়ের কোচ, সতীর্থরা তার পর থেকে কথা বন্ধ করে দিয়েছিলেন এই লিওর সঙ্গে।
দেশকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করে লিও যখন শিশুর মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন, তার পরে ওয়েস্ট হ্যামের প্রাক্তন কোচ অ্যালান পারডিউ বলছিলেন, ‘সেই ম্যাচের পর থেকে ওর সঙ্গে আমার আর কথা হয়নি। এবার নিশ্চয় ওর সঙ্গে কথা বলব।’
দেখা হলে পারডিউ জানতে চাইবেন, দল যখন জয়ের মুখে তখন আর্জেন্টাইন কোচ তাঁর ছাত্রদের কী নীতিশিক্ষা দিয়েছিলেন।
তাঁর একসময়ের সতীর্থ এখনও দোষারোপ করে চলেন তাঁকে। বিশ্বজয়ের পরও। বলেন, ‘ওর জন্যই তো আমার আর এফএ কাপ জেতা হল না। আমরা জিতছিলাম। বল ওর পায়ে। বলটা গ্যালারিতে পাঠিয়ে বিপন্মুক্ত করতে পারত। তার বদলে এত দুর্বল একটা ক্লিয়ার করল যে আমাদের দলই বিপন্ন হল।’
২০০৬ সালের এফএ কাপ ফাইনাল। লিভারপুল আর ওয়েস্ট হ্যামের খেলা। ওয়েস্ট হ্যাম এগিয়ে ৩-২ গোলে। ম্যাচ জেতার অপেক্ষায় ওয়েস্ট হ্যামের সমর্থকরা। ঠিক তখনই পাহারপ্রমাণ ভুল করে বসলেন লিও। স্পেনের ক্লাব ডিপোর্টিভো থেকে লোনে এসেছিলেন ওয়েস্ট হ্যামে। খেলার একেবারে শেষের দিকে লিভারপুলের প্লেয়ার সিসের চোট লাগল। স্পোর্টসম্যানশিপের পরিচয় দিয়ে বল সাইডলাইনের বাইরে পাঠিয়ে দিলেন লিও। লিভারপুলও সৌজন্য দেখিয়ে থ্রো থেকে বল ফিরিয়ে দিল তাঁর কাছে।
কিন্তু, নিজেদের কর্নার ফ্ল্যাগের প্রায় কাছ থেকে বলটা মাঝমাঠের কাছাকাছি শট করে পাঠাল। খেলার শেষ পর্যায়ে মরিয়া প্রতিপক্ষের পায়ে ওভাবে কেউ বল জমা দেয়! বাকি কাজটা সারেন লিভারপুলের স্টিভেন জেরার্ড। দূরপাল্লার শটে গোল করে সমতা ফেরান। টাইব্রেকারে ম্যাচ জিতে নেয় লিভারপুল। লিওকে দুয়ো দিতে থাকেন সমর্থকরা। তিনি ছাড়তে বাধ্য হন ওয়েস্ট হ্যাম।অতীত এই সেদিনও তাড়া করছিল তাঁকে।
বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর কি সব ধুয়ে মুছে গেল? মনে হয় না। এখনও তো ওয়েস্ট হ্যামের অনেকেই বলছেন, ‘ওকে আজও ক্ষমা করতে পারিনি।’
তাঁর দেশের কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাপোনা যিনি মেক্সিকোয় বল পায়ে আলপনা এঁকেছিলেন তিনি কী বলেছিলেন এই লিও সম্পর্কে? ‘ও ভাল মানুষ। কিন্তু ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করারও ক্ষমতা নেই। আমার দেশের দায়িত্ব নিক ও, এটা চাই না।’
চার বছর আগে রাশিয়ায় বিপর্যয়ের পরে হোয়াটসঅ্যাপে একসময়ের সতীর্থ লিও-কে এই লিও বলেছিলেন, ‘হ্যালো, লিও। আমি স্কালোনি। আমার সঙ্গে আইমার রয়েছে।’ আইমারকে আদর্শ মানতেন আর্জেন্টিনার দশ নম্বর জার্সিধারী। তাই এই লিও ভেবেছিলেন, আইমারকে সঙ্গে নিয়ে কথা বললে লিও মেসি হয়তো সব কথা মেনে নেবেন। সব কথা শুনবেন।
সেদিন থেকেই বিশ্বজয়ের বীজ বুনছিলেন এই লিও। মাঝে কোপা আমেরিকা জিতেছেন। ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বলে যে কিংবদন্তি একদিন তাঁকে বিদ্রুপ করেছিলেন, তাঁরও কোপা জয় অধরা থেকে গিয়েছে। ইতিহাস সেরকমই বলে।
এত পর্যন্ত পড়ার পরে সবাই বুঝতেই পারছেন এই সমালোচিত, ক্ষতবিক্ষত লিও আসলে কে! তিনি লিওনেল স্কালোনি। প্রবল ধিক্কৃত, অসম্মানিত এক ব্যক্তিত্বের বিশ্বজয় দেখল বিশ্ব। আজ সবাই তাঁর ভক্ত।
সব দেখে শুনে রবিঠাকুরের লাইনগুলো মনে পড়ছে, ‘একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে রাজার দোহাই দিয়ে, এ যুগে তারাই জন্ম নিয়েছে আজি, মন্দিরে তারা এসেছে ভক্ত সাজি।’
এই লিও যিশু না হয়ে পারেন না।