একটি অমর প্রেম

৭ জানুয়ারি, ২০২১; সান সিরোতে এসি মিলান বিপক্ষে নেমেছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী জুভেন্টাস।

উইন্সটন ম্যাককেনির গোল মিলানের জালে জড়াতেই কোচ বুঝলেন, এ ম্যাচে আর রক্ষা করবার মতন কিছু নেই। ১-৩ গোলে পিছিয়ে যাওয়া ম্যাচে অল আউট অ্যাটাকই ভরসা। ডিফেন্ডার ডেভিড কালাব্রিয়াকে উঠিয়ে কোচ নামালেন ১৯ বছর বয়সী অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার দানিয়েল মালদিনিকে। মাঠে পা দেওয়াটাই যথেষ্ট ছিল মালদিনির জন্য। ফুটবল ইতিহাস নতুন করে লিখে ফেললো মালদিনি পরিবার। দাদা, বাবা, ছেলে; তিন প্রজন্ম মিলে মালদিনি পরিবার মিলানের জার্সি গায়ে সিরি-আ’তে মাঠে নেমেছে মোট ১০০০ বার!

গল্পটা শুরু হয়েছিল দাদা সিজার মালদিনিকে দিয়ে। সেই পঞ্চাশের দশকে। যখন বড় বড় পরিবারের লোকেরা মাঠে আসতেন দূরবীন নিয়ে, খেলোয়াড়দের ভালো করে দেখবার জন্য। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি, ১৯৫৪ সালে সিরি-আ ক্লাব ত্রেস্তিনা থেকে নামমাত্র মূল্যে একজন ডিফেন্ডার কিনল মিলান। নাম তার সিজার মালদিনি।

সেদিন হয়তো কেউ ঘুনাঘরেও চিন্তা করেনি, এই ২২ বছর বয়সী ছয়ফুটি ডিফেন্ডারের নাম লেখা হবে মিলানের হল অফ ফেমে, পুরো বিশ্বের প্রতিটা মানুষ তার আর তার পরিবারের নামেই চিনবে পুরো ক্লাবকে। সিজারের বাবা অ্যালবিনো মালদিনি ছিলেন নাবিক, সমুদ্রের বুক চিরে জাহাজ চালাতেন। আর তার ছেলে সিজার মালদিনি হয়েছিলেন ডিফেন্ডার। প্রতিপক্ষের একেকটা অ্যাটাক ধ্বংস করে তবেই ক্ষান্ত হতেন। ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪, প্রথম মিলানের জার্সি গায়ে মাঠে নামেন সিজার মালদিনি। আর সেখান থেকেই শুরু হয় মিলানে মালদিনি পরিবারের যাত্রা।

সিজার মালদিনি মিলানে খেলেছেন ১২ বছর। ১২ বছরে মিলানের জার্সিতে গায়ে নেমেছেন ৩৪৭ ম্যাচ, করেছেন মাত্র ৩ গোল। চারটি লিগ টাইটেলের সাথে রয়েছে নিজেদের প্রথম ইউরোপিয়ান কাপের স্বাদ; সেটাও জিতেছেন অধিনায়কের আর্মব্যান্ড হাতে নিয়ে। মিলান ক্যারিয়ারে সব জিতেই ১৯৬৬ সালে দল ছেড়েছিলেন মালদিনি। ততদিনে মিলানের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক সিজার, দেশের ভেতরে-বাইরে সব জায়গায় সাফল্য এনে দেওয়া মালদিনি ততদিনে মিলানের হিরো। অথচ কে জানতো, তার রেকর্ডকে চূর্ণ করা মানুষটা বেড়ে উঠবে তার বাড়িতেই?

মিলান ছাড়ার এক বছর পর ১৯৬৭ সালে অবসর নিয়েছিলেন ফুটবল থেকে। ফুটবল ছাড়ার একবছর পরেই মালদিনি আর স্ত্রী মারিয়া লুইসার কোলজুড়ে আসে সন্তান পাওলো মালদিনি। তখন কী আর সিজার বুঝেছিলেন, এই সন্তান ছাড়িয়ে যাবে তার পিতাকেও?

বাবার দেখাদেখি ফুটবলে হাতেখড়ি হয়েছিল মালদিনির। বাবার মতন নিজেও পছন্দ করতেন বল আটকাতে। গোল করার থেকে গোল আটকানোতেই স্বাচ্ছন্দ্য তার। তাই দশ বছর হতেই মিলান একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেন সিজার মালদিনি। মাত্র ১৬ বছর বয়সে উদিনেসের বিপক্ষে মাঠে ডাক পান মালদিনি। ইঞ্জুরড সার্জিও বাতিস্তিনির পরিবর্তে কোচ নাইল লিডহোম তাকে নামিয়ে দেন ডিফেন্স সামলাতে। সেই মৌসুমে ১৬ বছর বয়সী পাওলো ঐ এক ম্যাচেই মাঠে নেমেছিলেন, জহুরীর চোখে পড়তে ওটুকুই যে যথেষ্ট ছিল।

পরের মৌসুম থেকে মিলানের মূল দলের রাইট-ব্যাক পজিশন পাকাপাকিভাবে হয়ে যায় মালদিনির। আর গায়ে উঠে বাবা সিজার মালদিনির রেখে যাওয়া আইকনিক ‘৩’ নম্বর জার্সি।

তবুও প্রশ্ন ছিল, মিলানের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক, পরে কোচ হয়ে এসেও জেতানো সিজারের মান কতটুকু রাখতে পারবেন ছেলে পাওলো? মাত্র ১৭ বছর বয়সেই ইতালিয়ান লিগে ত্রাস করে বেড়ানো ম্যারাডোনা, ব্যাজিও, প্লাতিনির সাথে মালদিনি পেরে উঠবেন তো? কিন্তু তার সতীর্থ ফ্রাঙ্কো বারেসি জানতেন, বাবার পথ ধরে উঠে আসা সন্তান হতাশ করবে না। আর জানতেন আরিগো সাচ্চি।

১৯৮৭ সালে এসে মালদিনির রোলও পালটে দেন সাচ্চি। রাইট ব্যাক থেকে মালদিনিকে থিতু করেন লেফট ব্যাকে। আনচেলত্তি, রুদ গুলিত, ফন বাস্তেন, ফ্র্যাঙ্ক রাইকার্ডদের নিয়ে তৈরি অ্যাটাক আর মাঝমাঠের ভরসা ছিল বারেসি-মালদিনি জুটি। সেই দলের নাম দিয়েছিলেন সাচ্চি, ‘দ্য ইমমর্টালস’ । ১৯৮৭-৮৮ সিজনে মাত্র বারেসি-মালদিনি জুটি হজম করেছিল গুনে গুনে মাত্র ১৪ গোল। জিতে নিয়েছিল লিগ। সে রেকর্ডের টিকিটি পর্যন্ত ছুতে পারেনি এখন পর্যন্ত কেউ।

‘দ্যা ইমমর্টালস’ এর পর এসেছিল ‘দ্য ইনভিসিবলস’। সাচ্চির ছেড়ে যাওয়া জায়গায় কোচ হয়ে এসেছিলেন ফ্যাবিও ক্যাপেলো। মালদিনি যেন আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিলেন এখানে। ১৯৯৩-৯৪ মৌসুমে ৩৬ গোল করে লিগ জিতেছিল মিলান। আর সেই মৌসুমেই ৩৫ গোল করে রিলেগেটেড হয়ে গিয়েছিল উদিনেস আর আতালান্তার মতন ক্লাব। বারেসি-মালদিনি জুটি তখন মিলানের সর্বেসর্বা।

বারেসির অবসরের পর অধিনায়ক হন মালদিনি। ততদিনে ফুটবল পালটে গিয়েছে বহুগুণে। ম্যারাডোনা-প্লাতিনি থেকে চলে এসেছে জিদান-রোনালদো-পিয়েরোদের যুগ। মালদিনি যুগের সাথে তাল মেলাতে সময় নিলেন না, বারেসির জায়গাতে নেস্তাকে নিয়ে আরেক দশকে সাফল্য গাঁথা শুরু করলেন মালদিনি। এবার কোচ হয়ে আসলেন তারই সতীর্থ কার্লো আনচেলত্তি। পাঁচ বছরের মধ্যে তি চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল আর দু’টি শিরোপা। ২০০৭ ফাইনাল দিয়ে পাঁচ নম্বর চ্যাম্পিয়নস লিগটা জিতে নিজেকে চ্যাম্পিয়নস লিগের সর্বেসর্বা বানিয়ে ফেলেছিলেন মালদিনি।

২০০৯ সালে রোজারিও জার্সিতে নিজের ক্যারিয়ারের ইতি টানার আগে এমন কিছু নেই যাতে হাত ছোঁয়াননি। ২৫ মৌসুমে জিতেছেন সাতটি লিগ টাইটেল, পাঁচটি চ্যাম্পিয়নস লিগ। তিনটা সুপার কাপ, এমনকি ক্লাব বিশ্ব কাপও। ২০০৯ সালে অবসরের আগে মিলানের জার্সিতে মোট ৬৪৭ টি সিরি ‘এ’ ম্যাচ নেমেছিলেন মিলানের জার্সি গায়ে। বাপ-ব্যাটা মিলে খেলেছিলেন মোট ৯৯৪টি সিরি ‘এ’ ম্যাচ।

সিরি-আতে মালদিনি পরিবারের সহস্র পূরণ করতে প্রয়োজন ছিল মাত্র ছয়টি ম্যাচের। গত মৌসুমেই এই স্বপ্ন যেন আস্তে আস্তে পূরণের পথে এগুতে থাকে। কোচ স্টেফানোস পিওলির অধীনে দুই ফেব্রুয়ারি ২০২০-এ অভিষেক হয় দানিয়েল মালদিনির। ছোটবেলায় বাবা-দাদার মতন ডিফেন্সেই খেলতেন মালদিনি। কিন্তু তার ফ্রি-রোমিংয়ের দক্ষতা দেখে তাকে অ্যাটাকিং-মিডফিল্ডার বানিয়ে দেন কোচ। সেই থেকে এখন পর্যন্ত অ্যাটাকিং মিড হিসেবেই মিলানে অভিষেক দানিয়েলের। আর এই জানুয়ারির ৭ তারিখ এই বিরল রেকর্ডে পা রাখল মালদিনি দানিয়েলের হাত ধরে। এক পরিবারের সদস্যদের সহস্র ম্যাচ খেলার রেকর্ড যে আর কারোর নেই।

বাংলা অভিধানে একটা শব্দ আছে, “সমার্থক শব্দ”। যার অর্থ, ‘একই অর্থ বহন করে এমন দুইটি শব্দ’। ‘এসি মিলান’ আর ‘মালদিনি’কে দুটো শব্দকে সমার্থক বললেও ভুল কিছু বলা হবে না। মালদিনি পরিবার মিলানের ‘মিডাস টাচ’। মিডাস হচ্ছেন গ্রিক মাইথলজির সেই রাজা, যার হাতের ছোঁয়ায় সবকিছু পরিণত হতো স্বর্ণে। মালদিনি হচ্ছেন মিলানের সেই রাজা মিডাস। মিলানের ১৮ লিগ টাইটেলের ১১টি এসেছে মালদিনিদের সঙ্গী করে। ৭ চ্যাম্পিয়নস লিগের ৬টিই মালদিনিদের হাত ধরে।

গত ৬০ বছরে মধ্যে গত দশকেই মিলান মূল দলের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই ছিল না মালদিনি পরিবারের কারোর। ফলাফল চোখের সামনে, সেই মিলানের সাথে আগের মিলানকে মেলাতে বড্ড কষ্ট হচ্ছিল পাড় সমর্থকদেরও। আর গত দুই বছর ধরে যেই না ম্যানেজমেন্টে এসছেন পাওলো, দলে প্রমোটেড হয়েছেন দানিয়েল, ওমনি যেন ‘রোজানারি’রা ফিরেছে ‘রোজেস থ্রন’ কিংবা গোলাপের কাঁটা হয়ে। সমর্থকদের চোখের মনি, কিন্তু সামনে এসে যেই না অন্য কেউ ছিড়তে যায়, তখনই বোঝা যায়, এই গোলাপের কাঁটা বড্ড ভয়ঙ্কর।

ইতালিয়ান সিরি এ-তে নিজেদের ইতিহাসে মিলান এ পর্যন্ত ২৯৮১ অফিশিয়াল ম্যাচ খেলেছে। এর মধ্যে ক্লাবের ইতিহাসে এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি সময় ধরে মালদিনি পরিবারের কারও না কারও গায়ে মিলানের জার্সি ছিল। আর সিরি ‘আ’ সহ পুরো সব আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট ধরলে মালদিনি পরিবার পা দিয়েছে ১৩৬৩ ম্যাচে। মালদিনি সন্তানদের হাতে আর কত রেকর্ড ভাঙ্গতে বাকি, সেই দেখার বিষয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link