নব্বইয়ের দশকটা জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের স্বর্ণালী সময় হিসেবেই জানা হয়। মারে গুডউই, ফ্লাওয়ার ভাইদ্বয়, পল স্ট্র্যাং, হেনরি ওলোঙ্গা, গাই হুইটালরদের মত তারকাদের ভীড়ে দলটা ছিল বেশ শক্তিশালী। অ্যালিস্টেয়ার ক্যাম্পবেল থেকে হিথ স্ট্রিক, ব্রায়ান মারফিরাও ছিলেন সেরাদের দলে।
নব্বইয়ের শেষভাগ থেকে ২০০০ পরবর্তী সময়ে এই তারকা ক্রিকেটাররা জিম্বাবুয়ের হয়ে মাঠ মাতিয়েছিলেন। এই তারকাদের সাথেই জিম্বাবুয়ের সোনালী সময়ের আরেক সারথী ছিলেন স্টুয়ার্ট কার্লাইল।
সামনের পায়ে ভর করে দুর্দান্ত সব শট খেলতে পারেন। মারকাটারি ব্যাটিং করতেই পছন্দ করেন। তবে পুরো ক্যারিয়ারে নিজের নামে কোনো স্থায়ী ব্যাটিং পজিশন তিনি পাননি। এক থেকে শুরু করে সাত পর্যন্ত সব পজিশনেই তিনি ব্যাটিং করেছেন।
তরল পদার্থের মত যেই পজিশনে সুযোগ পেয়েছেন সেখানেই নিজের অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন। প্রতিভাবান তো ছিলেনই; সামর্থ্যের কমতি ছিল না। ক্যারিয়ার জুড়ে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটকে যা দিয়েছেন, সামর্থ্যের বিচারে কমই বলা চলে।
২০০১ সালে ত্রিদেশীয় সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অজিদের বিপক্ষে অল্পের জন্য জয় পায়নি জিম্বাবুয়ে। ওই ম্যাচে কার্লাইলের বিধ্বংসী ইনিংসে এক ঐতিহাসিক জয়ের হাতছানি ছিল জিম্বাবুয়ের সামনে। অজিদের দেওয়া ৩০৩ রানের বিশাল লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে কার্লাইলের ৪৫ বলে ১১৯ রানের তাণ্ডব ইনিংসের পরেও মাত্র ২ রানে হেরে যায় জিম্বাবুয়ে! আক্ষেপ নিয়েই সেদিন মাঠ ছাড়ে আফ্রিকার দেশটি।
একই বছর হারারেতে ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষে অনবদ্য এক ইনিংস খেলে দলকে জয় এনে দিয়েছিলেন এই জিম্বাবুইয়ান তারকা। ১৫৭ রানের লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে ২৫ রানে প্রথম উইকেট হারায় জিম্বাবুয়ে। তখন ক্রিজে আসেন কার্লাইল।
সেখান থেকে একপ্রান্তে একের পর এক উইকেট গেলেও মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত কার্লাইলের ৬২ রানের অপরাজিত ইনিংসে শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে ৪ উইকেটের রোমাঞ্চকর জয় পায় জিম্বাবুয়ে। কার্লাইল ছাড়া কেউই ওই ইনিংসে জিম্বাবুয়ের কেউই বিশের বেশি রান করতে পারেনি!
রবার্ট মুগাবের সরকারের অধীনে জিম্বাবুয়ের অবস্থা তখন বেশ শোচনীয়র দিকে। রাজনৈতিক প্রভাবটা পড়েছিল ক্রিকেটেও। মারফি, হুইটালর, ক্যাম্পবেলরা একে একে অধিনায়কত্ব থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। দায়িত্ব পেলেন কার্লাইল। প্রথম ছয় টেস্টের পাঁচটি’তেই অধিনায়ক হিসেবে হার! অধিনায়কত্ব তো দূর, ক্যারিয়ার টেকানোই দায় তখন।
হিথ স্ট্রিককে পুনরায় দায়িত্বে আনা হল। যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন কার্লাইল। তবে বাজে অধিনায়কত্বের কারণে ২০০৩ বিশ্বকাপের স্কোয়াডে জায়গা হারান এই তারকা ব্যাটার। বছর খানেক বাদে ২০০৪ সালে আবার সুযোগ পান। এবার বাঁধে আরেক বিপত্তি। রাজনৈতিক ইস্যু ও বোর্ডের বিপক্ষে দাঁড়ানোয় হিথ স্ট্রিককে বরখাস্ত করে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট (জেডসি)। অনেকের মত কার্লাইলও এই অন্যায়ের প্রতিবাদ জানিয়ে ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়ান।
২০০৫ সালে ফের জাতীয় দলে ফিরেন তিনি। তবে খুব বেশি সময় আর জাতীয় দলে খেলার সময় কিংবা সুযোগ পাননি তিনি। ২০০৬ সালে জিম্বাবুয়ের টেস্ট সদস্যপদ বাতিল করে আইসিসি।
কার্লাইল তখন ক্ষোভে বলেছিলেন, ‘৯৫ শতাংশ দোষ বিশ্ব ক্রিকেটের। জিম্বাবুয়ে এখন অনেক নিচে নেমে গেছে। আমাদের অনেক ক্রিকেটারদের বেতন ভাতা বাকি। এক মাসের বেতন পেলেই দেখবেন অনেকে চলে যাবে। টেস্ট সদস্যপদ পাওয়ার সম্ভাবনা দেখিনা।’
আইসিসিকে উদ্দেশ্য করে কার্লাইল আরো বলেছিলেন, ‘তারা একটা সার্কাস চালাচ্ছে!’
১৯৯৯ সালে ঘরের মাটিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলেছিলেন ক্যারিয়ার সেরা ১২১ রানের ইনিংস। এরপর অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ২০০২ সালের সেই সেঞ্চুরি। পরের বছরই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিডনি টেস্টে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি করেন কার্লাইল।
একমাত্র জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডে ও টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন এই তারকা। টেস্ট ক্যারিয়ারে নিজের দ্বিতীয় ও শেষ সেঞ্চুরির দেখা পেয়েছিলেন বাংলাদেশের বিপক্ষে। ওই বছরই ভারতের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতেই ওয়ানডে ক্যারিয়ারের তৃতীয় সেঞ্চুরি দেখা পান তিনি।
৩৭ টেস্টে প্রায় ২৭ গড়ে করেছেন ১৬১৫ রান। সাদা পোশাকে আছে ২ সেঞ্চুরি ও ৮ ফিফটি। ১১১ ওয়ানডেতে প্রায় ২৮ গড়ে ২৭৪০ রান। ৩ সেঞ্চুরি আর ৯ ফিফটি করেছেন রঙিন জার্সিতে।
ক্যারিয়ারে বিভিন্ন পজিশনে ব্যাটিং করেছেন তিনি। তবে জিম্বাবুয়ের রাজনৈতিক শিকার হয়ে ক্যারিয়ারে অনেক আগেই থমকে যেতে হয়েছে। বার বার বাঁধার সম্মুখীন হয়েছেন এই তারকা ব্যাটার। জিম্বাবুয়ের সোনালি সময়টা যেমন দেখেছেন, তেমনি নিজের চোখেই দেখেছেন জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের ধ্বংস। সোনালী সময়ের এই আগ্রাসী তারকা রাজনীতির শিকার হয়ে সম্ভাবনার শেষ সীমারেখা অবধি যেতে পারেননি।