সুপার এজেন্ট হোর্হে মেন্ডেস ‘একাদশ’

ফুটবল মাঠে খেলোয়াড়রাই সর্বেসর্বা। তাঁদের পায়ের জাদুর উপর নির্ভর করে ম্যাচের ভবিষ্যৎ, দলের ভবিষ্যৎ। এক মুহুর্তের জাদুতে বদলে যেতে পারে পুরো ম্যাচ, কিংবা একটু ভুলের মাশুল দলকে গুনতে হতে পারে পুরো মৌসুমেজুড়ে। কিন্তু ফুটবল মাঠের ৯০ মিনিটের বাইরে? ফুটবল তো খেলেন শুধু খেলোয়াড়েরা, কিন্তু তাদের নিয়ে গড়ে উঠা ফুটবল বিজনেস তো আর খেলোয়াড়দের হাতে নেই। যদি ভেবে থাকেন ক্লাবের মালিক কিংবা হেভিওয়েট ক্লাব কর্তৃপক্ষ সামলান পুরো ফুটবল বিজনেস, তবে ভুল করছেন। ফুটবল মাঠের বাইরে ফুটবলারদের সমান প্রতিপত্তি নিয়ে যদি কেউ থাকেন, তারা হচ্ছেন ফুটবল এজেন্ট।

ফুটবল এজেন্টের কাজ সম্পর্কে একটু ধারণা দেওয়া যাক, ফুটবল এজেন্টরা মূলত খেলোয়াড়ের কন্ট্রাক্টের ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত। খেলাধুলা নিয়েই পরে থাকা খেলোয়াড়দের বিভিন্ন বিষয়াদি সামলাতে কাজে আসেন এজেন্টরা। এজেন্টরা মূলত ক্লাব আর খেলোয়াড়ের মধ্যে একটি যোগসূত্র। মূলত কোনো খেলোয়াড়ের কন্ট্রাক্ট রিনিউ কিংবা তার সাথে নতুন ক্লাবের চুক্তির ব্যাপারে আলোচনা করেন এজেন্ট। এজেন্ট যদি সব দেখে মনে করেন ঠিক আছে, তার খেলোয়াড় অর্থাৎ ক্লায়েন্টের সুবিধা আছে এই দলে গিয়ে, তবেই তিনি খেলোয়াড়ের কন্ট্রাক্টের ব্যাপারে আগান। এক কথায় বলতে গেলে একজন খেলোয়াড়ের চুক্তির ব্যাপারে সকল দায়িত্বই থাকে এজেন্টের। যার মূল কাজ থাকা খেলোয়াড়ের অর্থনৈতিক ও খেলোয়াড়ি জীবনের লাভ দেখা।

বেশির ভাগ সময় এজেন্ট হিসেবে থাকেন তাঁদের বাবা-ভাই-কাজিন কিংবা পরিবারের সদস্য। আরিয়েন রোবেন, নেইমার, হুয়ান মাতা এজেন্ট হিসেবে রেখেছেন নিজেদের পরিবারের লোককে। আবার আবার রিয়াল তারকা ইডেন হ্যাজার্ডের কোনো এজেন্ট নেই, সরাসরি যোগাযোগ করলে তাঁর সঙ্গেই করো। কিন্তু সবাই তো আর একরকম নয়, ফুটবল জগতে আধিপত্য বিস্তার করা খেলোয়াড়েরা তাই ছুটেন সুপার এজেন্টদের কাছে। সেরকমই একজন সুপার এজেন্ট হলেন হোর্হে মেন্ডেজ। পর্তুগিজ এই এজেন্টের খেলোয়াড় লিস্ট দেখলে চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। পর্তুগিজ এই এজেন্টের ক্লায়েন্টদের নিয়ে একাদশ বানালে কেমন হবে তা দেখতে?

হোর্হে মেন্ডেজকে মূলত সকলে চিনে রোনালদোর বন্ধু হিসেবে। একদম ছোট্টবেলা থেকে রোনালদোর এজেন্ট তিনি। ২০১৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘রোনালদো’ ডকুমেন্টারিতে দেখা গিয়েছে, কতটা সখ্যতা তাদের মধ্যে। বলতে গেলে রোনালদোর ক্যারিয়ার গড়ে দিয়েছেন তিনি নিজ হাতে। তার ক্লায়েন্ট কিন্তু শুধু রোনালদোতেই সীমাবদ্ধ নেই।

  • এডারসন (ম্যানচেস্টার সিটি)

পর্তুগালে যখন প্রথম আগমন হয়েছিল এডারসনের, তখনই কিছু একটা দেখে হোর্হে মেন্ডেসের চোখে লেগেছিল তাকে। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত এডারসনের সাথে সম্পর্ক অটুট মেন্ডেসের। ২০১৩ সালে থেকে এখন পর্যন্ত এডারসনের এজেন্ট হিসেবে আছেন মেন্ডেস। বেনিফিকা থেকে ম্যানচেস্টার সিটিতে আসার পেছনে মূল কলকাঠিও নেড়েছিলেন তিনি। বেনিফিকাতে থাকাকালীন সময়ে বড় ক্লাবে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন এডারসন। আর সেই মৌসুমেই তাকে ম্যানচেস্টার সিটির জার্সিতে অভিষেক করান মেন্ডেস। বলা বাহুল্য এডারসনের ৩৫ মিলিয়ন পাউন্ড ট্রান্সফার থেলকে ৭ মিলিয়ন পাউন্ড গিয়েছিল তার পকেটে।

  • রুবেন ডিয়াজ (ম্যানচেস্টার সিটি)

শুধু ম্যানচেস্টার সিটির গোলকিপার নয়, ম্যানচেস্টার সিটির ডিফেন্সও হোর্হে মেন্ডেসময়। প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার হয়ে উঠেছেন ডিয়াজ তার অভিষেক মৌসুমেই। গত মৌসুমে অসাধারণ পারফরম্যান্সের পর তাকে নেওয়ার জন্য উঠে পরে লেগেছিল অনেক দলই। কিন্তু ঠাণ্ডা মাথায় তাকে সিটিতে এনেছেন হোর্হে। কারণ সিটড়ি বাদে অন্য কোথাও গেলে হয়তো বসে বসেই দিন কেটে যেত তার। বেনফিকা থেকে বিশ্বসেরা হওয়ার পথটাও তার সুগম হয়েছে মেন্ডেসের হাত ধরেই।

  • জোয়াও ক্যান্সেলো (ম্যানচেস্টার সিটি)

ম্যানচেস্টার সিটির আরেক তারকা ডিফেন্ডার ক্যান্সেলোর এজেন্টও হোর্হে মেন্ডেস। তার সঙ্গে আছেন বেশিদিন হয়নি অবশ্য। কিন্তু এই কয়দিনেই ক্যান্সেলোকে বদলে দিয়েছেন তিনি। যে ক্যান্সেলোকে ভাবা হচ্ছিল ফিনিশড প্রোডাক্ট, জুভেন্টাসে জায়গা হারাচ্ছিলেন ডি শিলিওর কাছে, সেই ক্যান্সেলো বর্তমানের সেরা ডিফেন্ডারদের একজন। জুভেন্টাস থেকে ম্যানচেস্টার সিটিতে তড়িৎ ট্রান্সফার তার ক্যারিয়ারে নতুন মোড় দিয়েছে।

  • ফ্যাবিনহো (লিভারপুল)

হোর্হে মেন্ডেস একাদশ গড়লে সেই একাদশের ‘ক্রাউন জুয়েল’ হবেন ফ্যাবিনহো। লিভারপুলের ৩০ বছরের আক্ষেপ পূরণ করতে কম কাঠখড় পোড়াননি ক্লপ। কিন্তু ক্লপের বিশাল প্রশ্নের সমাধান ছিলেন এই ফ্যাবিনহো। প্রায় এক হাতে লিভারপুল ডিফেন্সের বিশাল প্রশ্নের সমাধান করে দিয়েছেন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে দাঁড়িয়ে। প্রয়োজনে তাকে ডিফেন্সেও নামিয়ে দলকে সামাল দিতে পেরেছেন ক্লপ। তাই ডিফেন্সিভ রোলে নাম থাকবে ফ্যাবিনহোর

  • রুবেন নেভেস (উলভারহ্যাম্পটন ওয়ান্ডার্স)

রুবেন নেভেসকে যখন প্রথম ইংলিশ লিগে অভিষেক হয়, তখন অনেকেই প্রশ্ন করেছিলেন, এই ছোট-খাটো দেখতে বাচ্চা ছেলেটা কী-ই বা করতে পারবে? কিন্তু কী-ই বা না করতে পারে সে? সব প্রশ্নের জবাব যেন মাঠে নেমেই দিতে শুরু করেন এই পর্তুগিজ। ২২-বছর বয়সী রুবেন নেভেস উলভলসের মাঝমাঠের ভরসার পাত্র।

  • হামেস রদ্রিগেজ (এভারটন)

বায়ার্ন মিউনিখ থেকে ফেরত আসার পর চোট আর বাজে ফর্মের কারণে রিয়ালে ব্রাত্য হয়ে পরেছিলেন হামেস রদ্রিগেজ। ’১৪ বিশ্বকাপের গোল্ডেন বল জয়ী তারকাকে যেন খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না মাঠে। রিয়াল মাদ্রিদ তাদের রেকর্ড ট্রান্সফারকেও সহজে যেতে দিবে না। ফলে দুইপক্ষই পরেছিল বেশ বড় সমস্যায়। কিন্তু ত্রাতা হয়ে এসেছিলেন হোর্হে। রিয়াল মাদ্রিদের সাথে কথা বলে নামমাত্র মূল্যে এভারটনে নিয়ে এসেছেন হামেসকে। ইংলিশ লিগে এসে যেন ফুটবলকে আবার নতুন করে ভালোবাসতে শুরু করেছেন হামেস।

  • অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া (পিএসজি)

হোর্হে মেন্ডেসের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ের সাথেই সম্পর্ক শুরু হয় বেনফিকা থেকে। ডি মারিয়ার ক্ষেত্রেও তার বিপরীত কিছু নয়। বেনফিকায় থাকাকালীন সময়ে ডি মারিয়াকে নিয়েছিলেন নিজের ক্লায়েন্ট হিসেবে। আর সেখান থেকে সবটা সময় ছিলেন তার পাশে। ডি মারিয়ার ক্যারিয়ারে যখন দুর্দশা, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে খেলার সুযোগ পাচ্ছিলেন না; তখন তাকে পিএসজিতে নিয়ে আসেন হোর্হে। সেখানে এখনও সেরা অবস্থানে আছেন তিনি।

  • ডিয়েগো জোটা (লিভারপুল)

গত দুই মৌসুমে উল্ভারহ্যাম্পটনের হয়ে অসাধারণ পারফরম্যান্সের ফলাফল পেয়েছেন জোটা। এই মৌসুমের শুরুতে তাকে কিনে নিয়েছে লিভারপুল। যদিও এই মৌসুমে চোটের কারণে মাঠে নেই জোটা, কিন্তু নিজের ক্যারিয়ারের অন্যতম বড় বুস্ট পেয়ে গিয়েছেন এই মৌসুমেই।

  • বার্নাদো সিলভা (ম্যানচেস্টার সিটি)

ম্যানচেস্টার সিটির উত্তরোত্তর সাফল্যে অন্যতম বড় ভূমিকা ছিল বার্নাদো সিলভার। এই মৌসুমেও সবার উপরে থাকার পেছনে মূল কারিগর হিসেবে আছেন এই পর্তুগিজ সুপারস্টার। পেপ গার্দিওলার দলের এই সুপারস্টারকে সিটিতে আনার পেছনেও বড় কলকাঠি নেড়েছেন হোর্হে।

  • রাফায়েল লিয়াও (এসি মিলান)

এসি মিলানের হঠাৎ উত্থানের পেছনে যদি কোনো ইয়াংস্টারের অবদান থাকে, সেটা অবশ্যই লিয়াও। পর্তুহিজ সুপারস্টার তার বড় ব্রেক পেয়েছিলেন গত মৌসুমে লিঁলের হয়ে। আর এই মৌসুমে এসি মিলানের জার্সিতে সেটিকে করেছেন আরো বড়। সামনে বিশাল ক্যারিয়ারের সুযোগ থাকা লিয়াও নিশ্চয় সেটা হাতছাড়া করবেন না।

  • ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো (জুভেন্টাস)

হোর্হে মেন্ডেসের জীবনে রোনালদোর অবদান যতটুকু, রোনালদোর জীবনেও হোর্হে মেন্ডেসের অবদান ঠিক ততটুকুই। তার এজেন্ট ক্যারিয়ারের প্রথমদিকের তারকা ছিলেন রোনালদো। ২০০৩ সালে যখন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে নিজের সেরা খেলোয়াড় দেখিয়েছিলেন তখন পুরো বিশ্বের নজর পরেছিল তার দিকে। সেখান থেকে তার বুদ্ধিতেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ভিরেছিলেন রোনালদো। সেখান থেকে রিয়াল। ৩৬ বছর বয়সে এসেও নিজের সেরা খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন জুভেন্টাসে। এতোদিনের পথচলায় পারিবারিক বন্ধু হয়ে উঠেছেন হোর্হে।

হোর্হে মেন্ডেসের ক্লায়েন্টের তালিকায় যে শুধু খেলোয়াড়েরাই আছেন তা কিন্তু নয়। জোসে মোরিনহো, নুনো এস্পারিতো সান্তোর মতন কোচও আছেন তার ক্লায়েন্ট তালিকাত। সাধেই কী তাকে সুপার এজেন্ট আখ্যা দেওয়া হয়?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link