ক্রিকেটকে বলা হয় গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। ফুটবল নিয়ে এমন কোনো বিশেষণ না থাকলেও ইউরোর ফ্রান্স-সুইজারল্যান্ড ম্যাচের পর বিশেষণ যোগ হয়ে যাবে সে ব্যাপারে নি:সন্দেহ। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে সম্ভাব্য চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ফ্রান্সকেই বেছে নিয়েছিলেন ফুটবলবোদ্ধারা। সুইজারল্যান্ডকে কেউ হিসেবেও রাখেননি।
সেই সুইসরা ম্যাচে দুই গোলে পিছিয়ে পড়েও শেষ মুহূর্তে গোল করে ম্যাচে সমতা ফেরানোর পর টাইব্রেকারে হারিয়ে দিয়েছে ফ্রান্সকে। প্রথম চার কিক সমতায় থাকার পর কিলিয়ান এমবাপ্পের শেষ শটটা ফিরিয়ে দিলেন ইয়ান সমার, আর তাতেই সুইজারল্যান্ড উঠে গেল শেষ আটে। আর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স বিদায় নিল দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই।
আচ্ছা একটা ফুটবল ম্যাচে কতবার রঙ বদলাতে পারে? দল নির্বাচনে হাস্যকর ভুল, পেনাল্টি মিস, এগিয়ে গিয়েও তিন মিনিটের মাঝে দুই গোলে পিছিয়ে পড়া, দুর্দান্ত সব গোল, অফসাইডে গোল বাতিল, শেষ মুহূর্তে সমতা, গোলরক্ষকদের অনবদ্য সব সেভ এবং সবশেষে টাইব্রেকারে সমাপ্তি, এ যেন ডেভিড ফিঞ্চারের কোনো থ্রিলার মুভি। উত্থান-পতনের এই ম্যাচে শেষ হাসিটা সুইসদেরই। আর তাতে করেই ১৯৫৪ সালের পর প্রথম কোনো আসরের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠলো সুইজারল্যান্ড।
দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলাটা যেন অভ্যাসে পরিণত করেছে সুইজারল্যান্ড দলটা। সেই ২০১৪ বিশ্বকাপ থেকে শুরু করে প্রতিটা আন্তর্জাতিক আসরেই কমপক্ষে নকআউট পর্ব খেলেছে তাঁরা। কিন্তু অতিরিক্ত সময়ে ডি মারিয়া গোল কিংবা টাইব্রেকারে পর্তুগালের কাছে হার, বারবার যেন তীরে গিয়ে তরী ডুবছিল তাঁদের। কোয়ার্টারে যাবার গেঁড়োটা কাটছিল না কোনোমতেই, এবারও ফ্রান্সের মুখোমুখি হবে নিশ্চিত হবার পর আশা ছেড়ে দিয়েছিল সবাই। কিন্তু অসাধারণ ফুটবল খেলে দ্বিতীয় রাউন্ডের বাঁধা অতিক্রম করলো সুইজারল্যান্ড।
দলে বড় কোনো তারকার উপস্থিতি নেই। আজ তারকা হবার সুযোগ ছিল জেরদান শাকিরির, আগের ম্যাচেই জোড়া গোল করে যিনি কেড়ে নিয়েছিলেন সবটুকু আলো। এ ম্যাচে নিষ্প্রভ রইলেন তিনি, সে সুযোগে নিজেকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসলেন হারিস সেফেরোভিচ।
বেনফিকার এই ফরোয়ার্ড ইউরোতে এসেছেন দারুণ ফর্ম নিয়ে, শেষ মৌসুমে করেছেন ২২ গোল। ক্লাবের দুরন্ত ফর্ম টেনে এনেছেন জাতীয় দলের জার্সিতেও, ম্যাচের ১৫ মিনিটে সুইসদের এগিয়ে নেয়া গোলটিও তাঁর করা। আবার তিন মিনিটের মাঝে দুই গোল হজম করে সুইসরা যখন হতভম্ভ তখন গোল করে ম্যাচে ফিরিয়েছেন এই সেফেরোভিচই।
কিংবা, ম্যাচের নায়ক হতে পারতেন স্টিফেন জুবের, এই ইউরোর আগে যাকে কেউ চিনতোই নাহ। ১৯৮০ সাল থেকে ইউরোর অ্যাসিস্টের হিসাব রাখা হয়, তখন থেকে এখনো পর্যন্ত এক ইউরোতে চার অ্যাসিস্ট করা একমাত্র ফুটবলার তিনিই।
এবারের ম্যাচেও সুইসদের মিডফিল্ড নিয়ন্ত্রণ করেছেন তিনিই, প্রতিটা আক্রমণই শুরু হয়েছে তার পা থেকে। কেবল গোল করা কিংবা গোল করানোর দিকে না থেকে এবার গোল ঠেকানোর মানুষের দিকে নজর দেয়া যাক। সুইস অধিনায়ক গ্রানিট জাকার কথাই ধরুন নাহ, ক্লাব ফুটবলে আর্সেনালে খেলা এই তারকা কখনোই নিজের খেলার প্রয়োজনীয়তা বুঝাতে পারেননি।
অথচ প্রতিপক্ষের আক্রমণ নস্যাৎ করার পাশাপাশি ডিফেন্সচেরা সব পাস দেবার ক্ষেত্রে তার জুড়ি মেলা ভার। রক্ষণভাগে প্রাচীর গড়ে তোলা ম্যানুয়েল আকাঞ্জি কিংবা বদলি নেমে সমতাসূচক গোল করা গাভ্রানোভিচ যে কেউ হতে পারতেন আজকের ম্যাচের নায়ক।
কিন্তু, সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন গোলরক্ষক ইয়ান সমার, তিন গোল হজম করলেও অনবদ্য সব সেভ করে ম্যাচে টিকিয়ে রেখেছিলেন দলকে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ঠেকিয়ে দিয়েছেন এমবাপ্পের স্পটকিক। আজকের ম্যাচের নায়ক তাই তিনিই।
করিম বেনজেমা জাতীয় দলে ছয় বছরের শূন্যতা কাটিয়ে ফিরেছিলেন এই ইউরো দিয়েই। টানা দুই ম্যাচে জোড়া গোল করেই বুঝিয়ে দিয়েছেন নিজের সামর্থ্য। কিন্তু তিনি যতটাই উজ্জ্বল ছিলেন মাঠে ঠিক ততটাই অপ্রতিভ তার সতীর্থরা।
এক পল পগবা ছাড়া কেউই যোগ্য সঙ্গ দিতে পারেননি। কিলিয়ান এমবাপ্পে কিংবা আন্তোনিও গ্রিজম্যান ছিলেন নিজের ছায়া হয়ে। সারা ম্যাচে সহজ সব সুযোগ মিস করেছেন এমবাপ্পে। এছাড়াও টাইব্রেকারে শেষ শটটা মিস করে ডুবিয়েছেন দলকে। ফলশ্রুতিতে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিদায় নিতে হলো বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের।
কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেনের মুখোমুখি হবে সুইজারল্যান্ড। সুইসদের স্বপ্নের দৌড় কোথায় গিয়ে থামে তার জন্য তাই অপেক্ষা শুক্রবারের।