ট্যাংগেনি লুঙ্গামেনি: স্রোতের বিপরীতে নি:সঙ্গ লড়াই

‘নিজের ভালোবাসা খুঁজে বের করো আর তাঁর হাতে নিহত হও’

আপনি হয়তো ভাবছেন ক্রিকেটের সাথে আমেরিকান কবি চার্লস বুকোভস্কির যোগসূত্র কিভাবে? আসলে বুকোভস্কির সাথে মিলিয়ে নিতে বাধ্য করেছেন নামিবিয়ার ক্রিকেটাররা।

গত বছরদুয়েক ধরেই ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম সংস্করণে ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলছিল দলটি। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের বড় মঞ্চে সুযোগ পেতেই এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন শ্রীলংকাকে হারিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে নিজেদের সামর্থ্য। সেই দলের অন্যতম তারকা ট্যাংগেনি লুঙ্গামেনির জীবনের সাথেই মিলে যায় বুকোভস্কির অমর সেই বাণী। 

মাত্র ছয় বছর বয়সে ক্রিকেটের সাথে পথচলা শুরু করলেও অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়লে ক্রিকেটকে বিদায় জানান লুঙ্গামেনি। প্রায় এক দশক অভিমানে মুখ সরিয়ে রেখেছিলেন জীবনের একমাত্র ভালোবাসা বাইশ গজ থেকে। কাজ করতেন ক্রিকেট নামিবিয়ার প্রধান কিউরেটর হিসেবে। অবশেষে ফিরে আসলেন, এবং ফিরলেন প্রবলভাবেই। আলো ছড়ালেন বিশ্বকাপের বড় মঞ্চে। 

ক্রিকেটটা ঠিক নামিবিয়ার লোকজনের পছন্দের খেলা না। তাঁদের ধারণা ব্যাট-বলের খেলাটা কেবলই সাদা মানুষদের জন্য। তাঁদের জনসংখ্যার মোটে শতকরা ছয় ভাগ শ্বেতাঙ্গ। জনসংখ্যার বিশাল অংশকে বাদ দিয়ে ভালো করাটা বরাবরই কঠিন, নামিবিয়াও তাই এতদিন পারেনি।

পরিবর্তনের জোয়ার আসা শুরু হতেই পালে হাওয়া লাগে নামিবিয়ার ক্রিকেটে, এবারের বিশ্বকাপে তাঁদের দলে মাত্র চারজন শ্বেতাঙ্গ ক্রিকেটার। স্বাধীনতার পূর্বে নামিবিয়া ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার অধীনে, নাম ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। আফ্রিকার বাকি দেশগুলোর মতো নামিবিয়াতেও সাদা-কালোর বৈষম্য প্রকট।

দেশের অর্থনীতির প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে শ্বেতাঙ্গ মানুষজন। ক্রীড়াক্ষেত্রেও চিত্রটা বদলায়নি, ২০১৭ সালে যোগ্য থাকা সত্ত্বেও দলে খেলার সুযোগ মেলেনি আজকের নায়ক লুঙ্গামেনি এবং পিক্কি ফ্রান্সের যে ঘটনাকে বর্ণনা করা হয়েছে “স্মোকস্ক্রিন ইনক্লুশন” হিসেবে। এমনকি কেবলমাত্র গায়ের বর্ণের জন একবার অনুর্ধব-১৬ দল থেকে বাদ পড়তে হয়েছিল এক নারী হকি খেলোয়াড়কে। 

নামিবিয়ার ক্রিকেট অনেকটাই শহরকেন্দ্রীক, দেশের বড় পাঁচটি ক্লাবের চারটিই রাজধানীর উইন্ডহেকে। তাছাড়া নামিবিয়ার জনসংখ্যাও বাকি ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের তুলনায় অনেক কম। আয়তনে পাকিস্তানের প্রায় কাছাকাছি হলেও পাকিস্তানের জনসংখ্যা যেখানে ২৪২ মিলিয়ন, নামিবিয়ার সেখানে মোটে ২.৫ মিলিয়ন।

লুঙ্গামেনির জন্ম রাজধানী উইন্ডহেক থেকে ২১০ কিলোমিটার দূরে গোবাবিস নাম গ্রামে। তাঁর গ্রামটি এতটাই প্রত্যন্ত অঞ্চলে যে তিনি ছিলেন তাঁর গ্রামের প্রথম দশজনের মাঝে একজন যাদের কিনা স্কুলে যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল।

লুঙ্গামেনি বলেন, ‘এটা ছিল সাদাদের স্কুল এবং সেখানে প্রত্যেকের খেলাধুলায় অংশ নেয়া বাধ্যতামূলক ছিল। তাই শিক্ষকরা যাচাই করে দেখতো কারা কোন খেলায় ভালো। সেখানেই প্রথমবারের মতো এক শিক্ষক তাঁকে ক্রিকেট খেলতে বলেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।’

প্রাইমারি থেকে হাইস্কুলে যাবার পর যে স্কুলে ভর্তি হন সেখানে ক্রিকেট খেলার সুযোগ ছিল না। কিন্তু যার রক্তে ক্রিকেট, সে কি করে দূরে থাকে। লুঙ্গামেনি তাই বাইরের প্রাইভেট স্কুলগুলোর হয়ে ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন। দারুণ খেলার সুবাদে নামিবিয়ার অনূর্ধ্ব ১৫ এবং অনূর্ধ্ব ১৭ দলের হয়ে খেলার জন্য ডাক পান।

উইন্ডহেকের এক ক্লাবের বৃত্তি পেয়ে চলে আসেন শহরে। সেই সময়টা ছিল লুঙ্গামেনির ক্যারিয়ারে সবচেয়ে সুসময়, নিজের ধ্যানজ্ঞান ক্রিকেটটা খেলতেন নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে। কিন্তু বছরখানেক পরই আসে দুঃসময়, কোনো কারণ ছাড়াই বাদ পড়েন ছোটদের বিশ্বকাপগামী নামিবিয়া দল থেকে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে লুঙ্গামেনির। ‘তাঁরা আমাকে বলেছিল আমি বিশ্বকাপের খেলার যোগ্য না। আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম এবং ক্রিকেট ছেড়ে বাড়ি ফিরে যাবার কথা ভাবছিলাম।’, বলেন লুঙ্গামেনি।

দুঃসময়ের মেঘ কেটে যায় একবছর পর নামিবিয়া ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাংক ইরাসমাসের এক ফোন কলে, যিনি কিনা বর্তমান অধিনায়ক গেরহার্ড ইরাসমাসের বাবা। তাঁর ক্লাবের চতুর্থ দলের জন্য একজন পেসারের দরকার ছিল, সে কারণেই দলে ভেড়ান লুঙ্গামেনিকে। 

ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বপ্নটা আবার দানা বাঁধতে শুরু করে লুঙ্গামেনির মনে। গোবাবিস থেকে প্রতি শনিবার এসে ক্রিকেট খেলতেন, পরদিন আবার বাড়ি ফিরে আসতেন। বললেন, ‘আমার ৬০ ভাগ বন্ধুই আমাকে বলছিল আমি পাগলামি করছি। আমার ক্রিকেট ছেড়ে দেয়া উচিত, বাকি ৪০ ভাগ আমাকে উৎসাহিত করেছে।’

ধীরে ধীরে উন্নতি করতে শুরু করেন তিনি। চতুর্থ থেকে ধাপে ধাপে উন্নতি করে উঠে আসেন ক্লাবের মূল দলে। কিন্তু বড় হবার সাথে সাথে আর্থিক সংকট দেখা দেয় তাঁর জীবনে। ফলে ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি কিউরেটর হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। একসময় বনে যান ক্রিকেট নামিবিয়ার প্রধান কিউরেটর।

কিউরেটর হিসেবে কাজ করতে করতে একসময় নজরে আসেন নামিবিয়া সাবেক কোচ দে ঠাকুরের। তিনিই লুঙ্গামেনিকে জিজ্ঞেস করেন কাজ শেষে নেটে বল করতে পারবেন কিনা। লুঙ্গামেনির জন্য সেটা ছিল মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো, সুযোগটা তাই লুফে নেন তিনি। সারাদিন পিচ রক্ষণাবেক্ষণের কঠোর খাটুনি শেষে নেটে আগুন ঝরাতেন বল হাতে। 

এভাবেই চলে যাচ্ছিল লুঙ্গামেনির দিন। অবশেষে ২০১৬ সালে ডাক পান জাতীয় দলে এবং কেন্দ্রীয় চুক্তির আওতায় আসেন। প্রথমবারের মতো দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত ওয়ান্ডারার্স ক্রিকেট স্টেডিয়ামে মাথা উঁচু করে প্রবেশ করেন লুঙ্গামেনি, গ্রাউন্ডসম্যান হিসেবে নন বরং নিজের দেশের প্রতিবিধিত্বকারি হিসেবে। যেখানে তাঁর বিপক্ষ দলে ছিলেন ডেভন কনওয়ের মতো ক্রিকেটার।

লুঙ্গামেনি বলেন, ‘জীবনের সেই পর্যায়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটকেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মনে হতো আমার। মানে আমি খেলতে পারছিলাম না। দুই বছর আগে আমি ক্রিকেট ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম, সেখান থেকে আজকে আমি নিজের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছি। আমার জন এটা ছিল অনেক বড় একতা বিষয়।  

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নামিবিয়ার ঐতিহাসিক সিরিজ জয়ের অংশ ছিলেন লুঙ্গামেনি। যদিও সেই সিরিজে আলো ছড়াতে পারেননি। ফলে বাদ পরেন গত বছরের বিশ্বকাপ দল থেকে। যদিও বাদ পরার মূল কারণ পারফরম্যান্স নয়, বিশ্বকাপ শুরুর সপ্তাহ দুয়েক আগে ইনজুরিতে পরেন তিনি।

লুঙ্গামেনির জন্য সেটা ছিল কষ্টের এক স্মৃতি। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। বিগত একটা বছর কাছের মানুষদের সাহায্যে পরিশ্রম করে গেছেন প্রাণান্ত। মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে নিয়মিত পরামর্শ নিয়েছেন নিজের মনোবিদ ল্যানি ডি ককের। ডি কক তাঁকে সাহায্য করেছেন বিশ্বকাপের হতাশা থেকে বেরিয়ে নতুন উদ্যমে সবকিছু শুরু করতে। 

অবশেষে এবারের বিশ্বকাপ দিয়ে নিজের স্বপ্নটা পূরণ করলেন তিনি। তাঁর সাফল্য সাহস যোগাবে পুরো নামিবিয়ার পিছিয়ে পড়া হাজারো জনগোষ্ঠীকে। লুঙ্গামেনি সবসময় স্মরণে রেখেছেন সেই অমর উক্তি, ‘তুমি সিস্টেমের অংশ হয়ে, ঘুণে ধরা সিস্টেমটাকে বদলে দাও।’ লুঙ্গামেনির পরবর্তী লক্ষ্য সেটাই।

লুঙ্গামেনি দেখিয়েছেন কিভাবে নিজের যোগ্যতার জানান দিতে হয়, দশ বছর আগের হতাশাগ্রস্থ অবস্থা আজকে তিনি বিশ্বকাপের মঞ্চে প্রতিনিধিত্ব করছেন নিজের দেশের। গোবিবাসের সেই ছোট্ট গ্রাম থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত লুঙ্গামেনির যাত্রাটা অনুপ্রেরণা জোগাবে বিশ্বজুড়ে থাকা লক্ষ-কোটি নিপীড়িতকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link