‘কাটার’ একটা শিল্প। ক্রিকেটে এই শিল্পের বহুল প্রচলন রয়েছে। তবে এই নামটার সাথে বাংলাদেশের সখ্যতা খানিক বেড়েছে গত কয়েক বছরে। কেননা এই কাটার ভেলকি দেখিয়েই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন মুস্তাফিজুর রহমান।
শুধু আন্তর্জতিক ক্রিকেট না বিশ্বের নানা প্রান্তের ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটেও তাঁর দাপটটা দিনের আলোর মত স্পষ্ট, গ্রীষ্মের রোদের মত প্রখর। সে কাটারে আবার বাংলাদেশের অন্যতম সফল অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজাও সিদ্ধহস্ত। তবে আরও একজন ছিলেন।
এই কাটারই ছিল যার প্রধান অস্ত্র। বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খুব বেশি একটা ম্যাচ খেলা হয়নি তাঁর। তবে তিনি বাংলাদেশের জয়ের খরা কাটানোর অন্যতম নায়ক। অনেকেরই হয়ত মনে নেই তাঁকে। আবার অনেকের স্মৃতির গহীন কোণে রয়েছে তাঁর আনাগোনা।
বলছিলাম ডান-হাতি মিডিয়াম ফাস্ট বোলার তারেক আজিজের কথা। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই তারেক আজিজ একজন পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে পদার্পণ করেছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেট। সে বহুকাল আগের কথা। বাংলাদেশের ক্রিকেট তখন হাটি হাটি পা পা করে এগোচ্ছিল।
২০০১/০২ মৌসুমে তিনি প্রথম শ্রেণি এবং লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে নিজের নাম ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন। তাঁর শাণ দেওয়া অস্ত্র কাটার দিয়ে নজর কাড়েন সে সময়ের জাতীয় দলের নির্বাচকদের।
তাইতো জাতীয় দলে আসতে তাঁর খুব বেশি সময় লাগেনি।
২০০২ সালে তিনি প্রথম ওয়ানডের রঙিন পোশাক গায়ে জড়ান। চট্টগ্রামের ঘরের ছেলে খেলতে নামেন পাকিস্তানের বিপক্ষে। তারও বছর দু’য়েক বাদে তাঁর অভিষেক হয় সাদা পোশাকে। তবে কোন ফরম্যাটেই যে লম্বা সময় ধরে থিতু হতে পেরেছিলেন তা নয়।
দুই ফরম্যাটেই তাঁর খেলার ম্যাচের সংখ্যা নিতান্তই হাতে গোনা। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি ছিলেন লম্বা সময় ধরেই। প্রথম খেলতে নেমেছিলেন চট্টগ্রাম জেলার হয়ে।
প্রথমবারের মত প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে নেমেই তিনি উপড়ে ফেলেছিলেন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের উইকেট। এই অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারকে সে সময়ে বিবেচনা করা হত বিশ্বের সেরা টেস্ট ব্যাটারদের একজন। এরপর তিনি প্রথম শ্রেণি ক্রিকেটে ম্যাচ খেলেছেন ৬৯ টি আর লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে তাঁর খেলা ম্যাচের সংখ্যা ৫৬ টি।
তিন টেস্ট ম্যাচ খেলে কেবলমাত্র একটি উইকেট তিনি নিতে পেরেছিলেন। তবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তাঁর নামের পাশে রয়েছে ২২৬ উইকেট। লিস্ট ‘এ’ ক্যারিয়ারেও উইকেটের ট্যালিটা বেশ পূর্ণ। ৭২ টি উইকেট রয়েছে সেখানে। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে আবার ম্যাচের সংখ্যা কম, মোটে দশটি। তবে টেস্ট ক্রিকেটে নিজের জন্মে সুখকর স্মৃতির জোগান দিতে না পারলেও তারেক তা পেরেছেন ওয়ানডে ক্রিকেটে।
প্রায় পাঁচ বছর ধরে চলা জয়ের খরায় তিনি যেন বর্ষার আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন। সেটা ২০০৪ সালের হারারে। তবে সে বর্ষার বৃষ্টি চক্রে মেঘ উৎপন্ন করেছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল, রাজিন সালেহ ও হাবিবুল বাশার সুমন। তিনজনই পেয়েছিলেন অর্ধ-শতকের দেখা।
আশরাফুল ছিলেন ইনিংসের শেষ অবধি অপরাজিত ৩২ বলে ৫১ রানের এক দুর্দান্ত ইনিংস খেলে। বাংলাদেশ ১০ মার্চ ২০০৪ সালে জিম্বাবুয়ের হারারেতে খেলা সে ম্যাচটায় স্বাগতিকদের টার্গেট দিয়েছিল ২৩৮ রান। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ এক লক্ষ্যমাত্রা। এরপর বাংলাদেশের বোলাররা ম্যাচটা ঠিক নিজেদের হাত থেকে ফসকে যেতে দেননি।
শুরুটা করেছিলেন তারেক আজিজ। নিজের ‘ইনকাটার’ অস্ত্র ব্যবহার করে এলবিডব্লিউয়ের ফাঁদে ফেলেন গ্রান্ট ফ্লাওয়ারকে। গুড লেন্থের বল, অফ স্ট্যাম্পের খানিকটা বাইরে পিচ করে ভেতরের দিকে ঢুকতে থাকে। আর তাতেই পরাস্ত হন গ্রান্ট ফ্লাওয়ার। তবে সেখানেই তিনি থেমে থাকেননি।
সতীর্থ বোলারদের উইকেট পাইয়ে দিতে চাপটা ঠিক প্রয়োগ করেই যাচ্ছিলেন তিনি। আর বাকিরা রানের চাকা ঠিক আটকে রাখতে পেরেছিলেন। তবে খেলাটা একেবারে শেষ ওভারের জন্য বাকি থেকে যায়। শেষ ওভারে জয়ের জন্য জিম্বাবুয়ের প্রয়োজন ছিল মাত্র ১৩ রান। টি-টোয়েন্টির এই জামানায় নেহায়েত স্বল্প রান। তবে সে সময়েও যে একেবারেই ১৩টি রান করে ফেলা যেত না তা নয়।
সে ম্যাচের অন্যতম সেরা বোলারের হাতে বল তুলে দিলেন বাংলাদেশের অধিনায়ক হাবিবুল বাশার। তারেক আজিজ সেদিন আস্থা রেখেছিলেন, নায়ক বনে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের জয়ের। প্রথম বলেই উইকেট তুলে নেন। ২০ রান করা স্টুয়ার্ট ম্যাতসিকেনিয়েরিকে বোল্ড আউট করেন তারেক। ঠিক তাঁর পরের বলেই আরও একবার স্ট্যাম্পে আঘাত হানেন তারেক। ব্যাস! খরার অবসান!
সেই তারেক আজিজ খুব বেশি সুযোগ পাননি জাতীয় দলে। তবে তিনি যখনই দলে ছিলেন নিজের চেষ্টাটা চালিয়ে গেছেন দলকে সর্বোচ্চটুকু দিয়ে যাওয়ার। ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের এক বড় নাম হয়ত হতে পারতেন। তবে তা আর হওয়া হল না তারেক আজিজের। তিনি রয়ে গেলেন আড়ালে। প্রদীপের নিচে।