‘জুলু’ এক নস্টালজিয়ার নাম

আমরা যারা লেট নাইন্টিজ থেকে ক্রিকেট ফলো করছি, তাদের কাছে ল্যান্স ক্লুজনার ওরফে ‘জুলু’ এক নস্টালজিয়ার নাম। একজন এক্সপ্লোসিভ হার্ডহিটার, লোয়ার মিডল অর্ডারে কার্যকরী ব্যাটিং কিংবা বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং দিয়ে যেকোন মুহূর্তে যিনি খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারতেন। বিশেষ করে ’৯৯ বিশ্বকাপের খেলাগুলো যারা সরাসরি টিভিতে দেখেছেন, তাদের পক্ষে চাইলেও এই মানুষটিকে ভোলা সম্ভব না। ওয়ানডে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফিনিশার, অলরাউন্ডার ও ম্যাচ উইনার তিনি।

আমরা যারা লেট নাইন্টিজ থেকে ক্রিকেট ফলো করছি, তাদের কাছে ল্যান্স ক্লুজনার ওরফে ‘জুলু’ এক নস্টালজিয়ার নাম। একজন এক্সপ্লোসিভ হার্ডহিটার, লোয়ার মিডল অর্ডারে কার্যকরী ব্যাটিং কিংবা বুদ্ধিদীপ্ত বোলিং দিয়ে যেকোন মুহূর্তে যিনি খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারতেন। বিশেষ করে ’৯৯ বিশ্বকাপের খেলাগুলো যারা সরাসরি টিভিতে দেখেছেন, তাদের পক্ষে চাইলেও এই মানুষটিকে ভোলা সম্ভব না। ওয়ানডে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফিনিশার, অলরাউন্ডার ও ম্যাচ উইনার তিনি। তাঁকে স্মরণ করে চলুন ঘুরে আসা যাক স্মৃতির চোরাগলি থেকে।

কিছু প্লেয়ার থাকে যারা প্রথম দেখাতেই নজর কাড়তে পারেন। সেরকম ক্লুজনারও আমার নজর কেড়েছিলেন বেসবল স্টাইলের হাই ব্যাকলিফট আর ব্যতিক্রমী বোলিং অ্যাকশন দিয়ে। অ্যাকশনের প্রসঙ্গ যখন উঠলই তাহলে বলি একটু। রানআপের শুরুতে ছোট্ট করে লাফ দিতেন ক্লুজনার। বল রিলিজের আগে ডান হাতটা চোখের সামনে এনে লক্ষ্য স্থির করতেন। সম্ভবত ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম ইউনিক বোলিং অ্যাকশন এটি।

১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জুলুর রঙিন জার্সিতে অভিষেক। তার কয়েক মাস পরই ভারতের মাটিতে টেস্ট ডেব্যু। একাদশে ঢুকেছিলেন ডানহাতি পেসার ফ্যানি ডি ভিলিয়ার্সের বদলি হিসেবে।

কলকাতার ইডেন গার্ডেনে জুলুর টেস্ট অভিষেকের গল্পটা বেশ ইন্টারেস্টিং। প্রথম ইনিংসে ভারত অধিনায়ক আজহারউদ্দীনের হাতে খেয়েছিলেন টানা ৫টি চার। ১৪ ওভার বল করে ৭৫ রান দিয়ে ছিলেন উইকেটশূন্য!

তবে দ্বিতীয় ইনিংসে বল হাতে পেয়েই জ্বলে ওঠেন অবিশ্বাস্যভাবে। মাত্র ৬৪ রানে তুলে নেন ৮ উইকেট! দলকে এনে দেন অবিস্মরণীয় এক জয়; অভিষেকেই হন ম্যাচ সেরা।

অভিষেক টেস্টেই এমন বিধ্বংসী বোলিংয়ের সৌজন্যে ক্লুজনার ঠাঁই করে নেন রেকর্ড বুকেও। দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে টেস্ট অভিষেকে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ডটি (৮/৬৪) আজও কেউ ভাঙতে পারেনি।

৯৬ এর নভেম্বরে ক্যারিয়ারের মাত্র ‘তৃতীয়’ ওয়ানডেতেই ম্যাচ সেরার পুরস্কার লাভ করেন জুলু। এবারে অবশ্য বোলিং নয়, ব্যাটিং দিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তিন নম্বরে নেমে খেলেন ৯৯ বলে অপরাজিত ৮৮ রানের একটি অনবদ্য ইনিংস৷

১৯৯৭ সালকে বলা যায় জুলুর ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। বছরটা শুরুই করেছিলেন দুর্দান্ত এক টেস্ট সেঞ্চুরি দিয়ে। কেপটাউনে ভারতের বিপক্ষে ৯ নম্বরে নেমে করেন ১০০ বলে ১০২। তারপর ওয়ানডেতে প্রথমবারের মত বল হাতে শিকার করেন ৫ উইকেট।

ক্লুজনার তখন লিমিটেড ওভার ক্রিকেটে ব্যাট করতেন টপ অর্ডারে, বল করতেন পুরো ১০ ওভার৷ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ক্যারিয়ারে প্রথমবার ওপেন করতে নেমেই উপহার দেন ১১৮ বলে ৯২ রানের ম্যাচ উইনিং নক৷

পাকিস্তানে আয়োজিত উইলস চারজাতি টুর্নামেন্টে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পরপর দুই ম্যাচে ম্যাচসেরা হয়ে আলোচনায় উঠে আসেন ক্লুজনার। প্রথম ম্যাচে ৫৪ রান (৪১ বলে) ও ৬ উইকেট, দ্বিতীয় ম্যাচে ৯৯ রান (৯৬ বলে) ও ২ উইকেট।

ক’দিন পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে আবারো ম্যাচ সেরা হন ক্লুজনার৷ মেলবোর্নে দক্ষিণ আফ্রিকার দেয়া ১৭১ রানের টার্গেট তাড়া করতে নেমে ১২৫ রানেই ধরাশায়ী হয় অজিরা৷ ক্লুজনার নেন ৫ উইকেট, মাত্র ২৪ রান খরচায়৷

১৯৯৮ সালে কেপটাউনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জুলুর বিধ্বংসী স্পেল, ২৫ রানে ৫ উইকেট নিয়ে হন ম্যাচসেরা। ওল্ড ট্র‍্যাফোর্ডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লো স্কোরিং থ্রিলারে আবারো ক্লুজনার হিরোইক্স! আটে নেমে ৪৯ বলে অপরাজিত ৫৫ রানের গেম চেঞ্জিং নক৷

ক্লুজনারের ব্যাটিং পজিশন ততদিনে টপ অর্ডার থেকে লেট অর্ডারে স্থানান্তর হয়েছে৷ গিবস, কারস্টেন, ক্যালিসদের মত টেকনিকালি সুপেরিয়র ব্যাটারদের জায়গা দিতে গিয়েই মূলত টপ অর্ডারে জায়গা হারান তিনি। অবশ্য সাত-আট নম্বরে ফিনিশার রোলেও মানিয়ে নেন দুর্দান্তভাবে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১৪ বলে ২৭* আর ৩৬ বলে ৫৪* রানের দুটো ফিনিশিং নক খেলে নিজের সামর্থ্যের প্রমাণ দেন তিনি৷

১৯৯৯ সালের মার্চে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য এক জয় ছিনিয়ে আনেন ক্লুজনার। ডানহাতি পেসার ডিওন ন্যাশের করা ইনিংসের শেষ বলে বিশাল এক ছক্কা হাঁকিয়ে ম্যাচ ফিনিশ করেন; অপরাজিত থাকেন ১৯ বলে ৩৫ রানে।

১৯৯৯ বিশ্বকাপকে বলা হয় ক্লুজনারের বিশ্বকাপ। যে টুর্নামেন্টে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন একজন সত্যিকারের ইম্প্যাক্ট প্লেয়ার হিসেবে। দলের প্রায় প্রতিটি জয়েই রেখেছিলেন উল্লেখযোগ্য অবদান, চারটিতে জিতেছিলেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার। বল হাতে মাত্র ২০ গড়ে ১৭ উইকেট আর ব্যাটিংয়ে ১৪০.৫০ গড়ে করেছিলেন ২৮১ রান। স্ট্রাইক রেট ১২২.৭০! যথারীতি বিশ্বকাপের ‘প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট’-এর ট্রফিটাও উঠেছিল তাঁর হাতে।

লক্ষণীয় ব্যাপার হল, বিশ্বকাপে ক্লুজনারের প্রতিটি ম্যাচ জয়ী ইনিংস এসেছিল দলের বিপদের মুহূর্তে, প্রচন্ড চাপের মুখে৷ যেমন- শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১১২ রানে ৮ উইকেট পড়ার পর ৫২*(৪৫), ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৮/৭ অবস্থায় ৪৮*(৪০) কিংবা পাকিস্তানের বিপক্ষে ২২১ টার্গেট তাড়া করতে নেমে ১৩৫ রানে ৬ উইকেট যাওয়ার পর ৪৬*(৪১)। যেখানে গেম চেঞ্জিং মোমেন্ট ছিল ওয়াসিম আকরাম আর শোয়েব আখতারকে গ্যালারিতে আছড়ে ফেলা দুই ছক্কা!

আপাতদৃষ্টিতে ছোট কিন্তু ‘প্রাইসলেস’ এসব ইনিংসের ইম্প্যাক্ট সত্যি বলতে লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। উল্লেখ্য, ’৯৯ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমিফাইনালটি জন্ম দিয়েছিল ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় ট্র্যাজেডির, যেখানে ট্র্যাজিক হিরোর ভূমিকায় ছিলেন ল্যান্স ক্লুজনার!

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়ের জন্য শেষ ওভারে প্রোটিয়াদের দরকার ছিল ৯ রান, হাতে উইকেট মাত্র ১টা। ড্যামিয়েন ফ্লেমিংয়ের করা ওভারের প্রথম দুই বলেই বাউন্ডারি হাঁকিয়ে খেলাটা হাতের মুঠোয় নিয়ে আসেন ক্লুজনার। ম্যাচের সমীকরণ তখন ৪ বলে মাত্র ১ রান!

ওভারের তৃতীয় বলে অল্পের জন্য রানআউটের হাত থেকে বেঁচে যান নন-স্ট্রাইক এন্ডে থাকা অ্যালান ডোনাল্ড। পরের বলটা ক্লুজনার ঠিকমত ব্যাটে বলে করতে পারেন নি। বল চলে যায় সরাসরি ফিল্ডারের হাতে। তবুও কী মনে করে প্রান্ত বদলের জন্য পড়িমরি করে ছুটলেন ক্লুজনার।

কিন্তু একি! ডোনাল্ড যে তখনও ক্রিজের ভেতর ঠায় দাঁড়িয়ে, একমনে চেয়ে আছেন বলের দিকে! যতক্ষণে দৌড় শুরু করলেন ততক্ষণে সর্বনাশ যা হবার তা হয়ে গেছে! ক্লুজনারের ১৬ বলে অপরাজিত ৩১ রানের ইনিংসটা তাই হয়ে রইল একটি দীর্ঘশ্বাসের নাম!

প্রখ্যাত ধারাভাষ্যকার বিল লরির মুখ থেকেই শুনুন বাকিটা, ‘…this will be out surely – oh it’s out, it’s gonna be run out…oh, that is South Africa out – Donald did not run, I cannot believe it. Australia go into the World Cup Final – ridiculous running with two balls to go. Donald did not go, Klusener came – what a disappointing end for South Africa.’

গোড়ালি ও পিঠের ইনজুরির কারণে ‘৯৯ বিশ্বকাপের পর থেকেই বলের গতি এবং ধার দুটোই হারাতে থাকেন ক্লুজনার। তবে পেস কমে গেলেও অ্যাকুরেসি ঠিক রেখেছিলেন। ব্যাটসম্যানের ব্লকহোল বরাবর নিখুঁত ইয়র্কার দিতে পারতেন। আর ছিল স্লো অফ কাটারের মত কিছু ভ্যারিয়েশন যা তাঁকে লিমিটেড ওভার ক্রিকেটে দারুণ কার্যকর এক বোলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।

অনেকেই হয়ত জেনে অবাক হবেন, দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশিবার পাঁচ উইকেট শিকার করা বোলারের নাম ল্যান্স ক্লুজনার (৬ বার)!

’৯৯ বিশ্বকাপের নায়ক ক্লুজনার খেলেছিলেন ২০০৩ বিশ্বকাপেও। স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকা সেবার বাদ পড়েছিল গ্রুপ পর্ব থেকেই, ক্লুজনারের পারফরম্যান্সও ছিল বিবর্ণ। ৫ ইনিংসে রান করেছিলেন মাত্র ৯১! উইকেট পেয়েছিলেন ৫টি।

ওয়ানডেতে অসংখ্য জয়ের নায়ক, বাঁহাতি ক্যারিশম্যাটিক হার্ডহিটার ক্লুজনার ব্যাট হাতে অবদান রেখেছেন টেস্ট জয়েও। ভারতের বিপক্ষে ব্লুমফন্টেইনে ১০৮ এবং ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ক্যারিয়ার সেরা ১৭৪ রানের ম্যাচ উইনিং ইনিংস দুটোর কথা না বললেই নয়। তবে টেস্ট ক্যারিয়ারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ইনিংসটি খেলেছিলেন বোধহয় শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ‘ঐতিহাসিক’ ক্যান্ডি টেস্টে।

২০০০ সালে শ্রীলঙ্কার মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম টেস্ট জয়ের নায়ক ল্যান্স ক্লুজনার। ক্যান্ডির স্পিন সহায়ক উইকেটে ক্লুজনারের ২১৯ বলে ১১৮ রানের ‘এক্সট্রা-অর্ডিনারি’ ইনিংসের সৌজন্যেই ৭ রানের নাটকীয় এক জয় পেয়েছিল সফরকারীরা।

ভাস-মুরালির বোলিং তোপে প্রথম ইনিংসে মাত্র ৩৪ রান তুলতেই ৫ উইকেট হারায় দক্ষিণ আফ্রিকা। সেখান থেকে দলীয় স্কোর আড়াইশ’র ওপর নিয়ে যাওয়ার পুরো কৃতিত্বই ছিল ক্লুজনারের। কেবল তাই নয়, লঙ্কানদের দ্বিতীয় ইনিংসে বল হাতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ব্রেকথ্রুও এনে দিয়েছিলেন তিনি।

১৯৯৬ সালে শুরু, ২০০৪ সালে শেষ। ইনজুরির কারণে ক্যারিয়ারের শেষভাগটা কেটেছে ফর্মহীনতায়। তবে এই সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ারে উত্থান-পতন মিলিয়ে ব্যাটে-বলে তাঁর অর্জন নেহায়েত কম নয়। ওয়ানডেতে ৪১.১০ গড়ে ৯০ স্ট্রাইক রেটে ৩৫৭৬ রান আর ছয়টি ‘ফাইভ-ফার’সহ ১৯২ উইকেটই বলে দেয় রঙিন পোশাকের ক্রিকেটে ঠিক কতটা ইম্প্যাক্টফুল অলরাউন্ডার ছিলেন ক্লুজনার৷

টেস্টেও খারাপ করেন নি, ৪৯ টেস্টে ৩২.৮৬ গড়ে ১৯০৬ রান, চারটি সেঞ্চুরিসহ, উইকেটসংখ্যা ৮০। টেস্টে দুইবার ও ওয়ানডেতে সর্বমোট ১৯ বার জিতেছেন ম্যাচ সেরার পুরস্কার। নব্বইয়ের অতিমানবীয় এক চরিত্র হয়েই মানুষটি থাকবেন চিরকাল।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...