আগে তাঁর নাম টাইপ করলে গুগল দেখাত তাঁর সমনামী এক অভিনেতার ডিটেলস। ১৩ জুলাই ২০২১ তারিখের সকালে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে না ফেরার দেশে চলে গিয়ে হই হই করে গুগল সার্চে ফিরে এলেন তিনি, যশপাল শর্মা, ১৯৫’র ১১ আগস্ট যার জন্ম হয়েছিল লুধিয়ানায়। আন্ডাররেটেড হয়েই তিনি সারা জীবন থেকে গেছেন ক্রিকেটের মত জীবনেও।
২ আগস্ট ১৯৭৯ থেকে ২৯ অক্টোবর ১৯৮৩’র মধ্যে ৩৭টি টেস্ট খেলে ২টি শতরান ও ৯টি অর্ধশতরান এবং সর্বোচ্চ ১৪০ রান (বনাম ইংল্যান্ড, চেন্নাইতে) সহ ৩৩.৪৫ গড়ে ১৬০৬ রান করেছিলেন যশপাল শর্মা।আর ১৩ অক্টোবর ১৯৭৮ থেকে ২৭ জানুয়ারি ১৯৮৫’র মধ্যে ৪২টি ওয়ানডে খেলেছিলেন তিনি, রান করেছিলেন ৮৮৩, ২৮.৪৩ গড়ে, যার মধ্যে ছিল ৪টি অর্ধশতরান আর সর্বোচ্চ ছিল ভারতের জেতা ১৯৮৩’র বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে করা ৮৯।
টেস্ট আর ওয়ানডে, দুই ধরণের ক্রিকেটেই ডানহাতি মিডিয়াম ফাস্ট বোলিং তাকে এনে দিয়েছিল একটি করে উইকেটও। দেখনদারি না, কার্যকরী ক্রিকেটেই অভ্যস্ত ছিলেন তিনি, যশপাল শর্মা। ১৯৭৯’র বিশ্বকাপে ভারতীয় স্কোয়াডে থাকা তিনি একটি বলের জন্যও মাঠে নামেন নি। ১৯৮১-৮২ মৌসুমে চেন্নাইতে গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ (২২২) আর তিনি (১৪০) জুটিতে ৩১৬ রান করার পথে একটা গোটা দিন ব্যাট করে অপরাজিত থেকে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে, যার স্মৃতিচারণ করেছেন আজ বিশ্বনাথ।
তবে তাঁর আসল মাস্তানি ছিল দু’দশক জুড়ে বিস্তৃত প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে, ১৬০ ম্যাচে ৮৯৩৩ রান (২১ শতরান, ৪৬ অর্ধশতরান) সাক্ষ্য দেয় একথার স্বপক্ষে। তবু আন্ডাররেটেড হয়েই তিনি সারা জীবন থেকে গেছেন ভারতের ক্রিকেটে।
সব শুরুরই একটা শুরু থাকে। ১৯৮৩র বিশ্বকাপ জয়কে আজও কেউ কেউ বলেন ‘ফ্লুকে জয়’,কেউ বলেন ‘টিমএফর্টের জয়’ আবার কেউ বা বলেন ‘অলরাউন্ড পারফর্মেন্সের জয়’। কিন্তু ২৫ জুন ১৯৮৩র বিশ্বকাপ জয়ের মাস তিনেক আগে, ২৯ মার্চ ১৯৮৩-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বার্বিসে ‘আমরাও পারি’র বিশ্বাসের তেলে প্রথম সলতে পাকিয়েছিল ভারত (৪৭ ওভারে ২৮২/৫), ওয়ানডে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে, ২৭ রানে প্রবল পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে (৪৭ ওভারে ২৫৫/৯), হারিয়ে দিয়ে।
সেই ম্যাচে ২৬ বলে তিনটি ঝকঝকে চারসহ ২৩ রান করা ছাড়াও রবি শাস্ত্রীর বলে ফাউদ বাক্কাসের ক্যাচ নিয়েছিলেন এক গাঁট্টাগোট্টা ভারতীয় ক্রিকেটার। ১৯৮২-৮৩ মৌসুমের সেই ৩ টেস্টের ওডিআই সিরিজ ১-২ ফলে হেরেছিল ভারত আর ৫ ম্যাচের টেস্ট সিরিজ হেরেছিল ০-২ ফলে। ৫ টেস্টে ৯ ইনিংস খেলে ২টি অর্ধশতকসহ ২২২ রান আর ৩ ওডিআই ম্যাচ খেলে ৫৩ রান করেছিলেন সেই ভারতীয় ক্রিকেটার। এইরকমই চোখ না টানা পারফরমেন্স করেও ‘টিমম্যান’ হয়ে টিমের জন্য সর্বস্ব দিয়ে দিতেন তখন তিনি, যশপাল শর্মা। তবু আন্ডাররেটেড হয়েই তিনি সারা জীবন থেকে গেছেন ভারতীয় ক্রিকেটে।
অত:পর ৯-২৫ জুন, ১৯৮৩র বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের প্রখর গ্রীষ্মকালকে নিজের ক্রিকেট কেরিয়ারের বসন্তদিনে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নিলেন সেই তিনি, যশপাল শর্মা। ৯ জুন ১৯৮৩, বিশ্বকাপের প্রথম গ্রুপ ম্যাচেই ওল্ড ট্রাফোর্ডে ভারত হারাল তখন দুরন্ত, তখনো আয়োজিত দুটি বিশ্বকাপই জেতা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে, আড়াই মাসের মধ্যে দ্বিতীয় বার।তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ওডিআই-তে হারানোর চেয়ে অসম্ভব খুব কম জিনিসই ছিল বিশ্ব ক্রিকেটে। সেই ওল্ড ট্রাফোর্ডের ম্যাচে ৮৯ রান (৯X৪) করে ভারতকে জয়ের রাস্তা দেখিয়েছিলেন তিনি, যশপাল শর্মাই।
আর একটি গ্রুপ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২০ জুন চেমসফোর্ডে তাঁর ৪০ রান আজও চর্চার বিষয়, ভারতীয় ক্রিকেটে।কিন্তু আজও সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় ওল্ড ট্রাফোর্ডের সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২২ জুন তারিখে তাঁর করা ৬১ রান (৩X৪, ২X৬) নিয়ে, সন্দীপ পাতিল ও মহিন্দর অমরনাথকে সঙ্গে নিয়ে ৫০:৫০ ম্যাচ যিনি অনায়াসে নিয়ে গিয়েছিলেন ভারতের জিম্মায়।
তিন দিন পরের লর্ডস ফাইনালে অবশ্য মাত্র ১১ রানে প্যাভিলিয়নে ফিরেছিলেন তিনি। ৮ ম্যাচে ২৪০ রান করেছিলেন তিনি সেই বিশ্বকাপে, ৩৪.২৮ গড়ে। তবু, তবুও সারা জীবন ভারতীয় ক্রিকেটে আন্ডাররেটেড হয়েই থেকে গেছেন যশপাল শর্মা।
শোনা কথা, সদ্যপ্রয়াত অভিনেতা দিলীপকুমার তাকে ভারতীয় ক্রিকেট দলে নেবার জন্য রাজ সিং দুঙ্গারপুরের কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন। হয়ত তাই, হয়ত নয়, ভারতীয় ক্রিকেট দলে ঢুকেছিলেন যশপাল শর্মা। এবং তারপর নিজের ১০০ শতাংশ দিয়ে দেওয়া খেলা দিয়েই তিনি অমর থেকে গেছেন ভারতের ক্রিকেটে, বিশেষত প্রথম বিশ্বকাপ জেতায়।
টেকনিকালি খুব সাউন্ড ছিলেন তিনি, কেউ কখনো বলবে না, কিন্তু দলের জন্য তাঁর পরিশ্রম আর চেষ্টা ছিল সশব্দ। খেলা ছাড়ার পরে ধারাবিবরণী ও আম্পায়ারিং করেছিলেন যোগ্যতার সাথে। দুই দফার নির্বাচক ছিলেন তিনি, ২০০৪-২০০৫ আর ২০০৮-২০১১। চ্যাপেল অধ্যায়ে খোলাখুলি অধিনায়ক সৌরভের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন যশপাল, উচিত কথা সোজাসাপটা বলে দিতে যার কোন জুড়ি ছিলনা। তবুও ভারতীয় ক্রিকেটে আন্ডাররেটেড হয়েই সারা জীবন থেকে গেছেন ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম দিকের এই ‘শর্মাজি কা বেটা’।
১৯৮৩ সালের সেই বিশ্বজয়ী টিমের প্রথম কেউ ‘আউট’ হয়ে গেলেন মৃত্যুর বোলিংয়ে। তাঁর সেই টিমমেটদের বেদনাবিধুর স্মৃতিচারণের কান্নাভেজা পোশাক পরে আজ ঝরে গেল এক অমূল্য মুক্তো, ভারতীয় ক্রিকেটের এক ঐতিহ্য ও আদরের মণিমুক্তোর সেট থেকে, চেষ্টা করে যাওয়াই ছিল যার জীবনের মূলমন্ত্র, ব্যাটিং-বোলিং আর ফিল্ডিংয়েও।