একটা রাত, একটা থ্রু। বছর খানেক আগে একটা ছোট চিপ। পিছনে ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ধেয়ে আসছে এক একটা কালো রজনীর থাবা। কয়লাখনির কালি। গ্লানির মধ্যে ফুঁড়ে ওঠা হারকিউলিসের সংগ্রাম। সেই সংগ্রামকে বিশ্ব নাম দিয়েছে অ্যাঞ্জেল। পরীর মতো নাম দিয়েছে দাবানলের লেলিহানকে।
বাইসাইকেল থিফের মতো একটা জীবন। তবু তাকে থিফ হতে হল না। বাবা মায়ের হিমশীতল বনিবনার মধ্যেই সাইকেলে করে প্র্যাকটিস। ফিরে এসে কাজ। কাজের পর ঘুম, যৎসামান্য। রোজারিও শহরের নিয়ন আলোতে পকেটে হাত রেখে হেঁটে চলে বেড়ানো নিতান্ত স্বপ্ন বৈ কিছুই নয়। অ্যাঞ্জেলের চোখে ফুটবলের স্বপ্ন। রোগা, হাড় জিরজিরে এক স্বপ্নবিলাসী।
সেই অ্যাঞ্জেল ডাক পেল অবশেষে। ইউরোপ যেতে হবে তাকে। বেনফিকা ডেকে নিয়েছে। আর্জেন্টিনার সুপারস্টারদের ভিড়ে জায়গা করে নিতে রোজারিও থেকে দু’জন চলে এল ইউরোপে। একজন গ্রোথ হর্মোন ডেফিসিয়েন্সিতে ভুগে, একজন কয়লাখনির কালি ঝুলি মেখে।
একজনের চিকিৎসার গোটা দায় ভার নিল স্পেনের বার্সেলোনা। আরেকজন বেনফিকার ট্রায়ালে হাফভলিগুলোকে গোলে পরিণত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিছুদিন পর সেও তো পাড়ি জমাবে স্পেনে, ডেকে নেবে বার্সেলোনার অবিসংবাদী বিরুদ্ধপক্ষ। অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া নাম লেখাবে রিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাবে।
বহুবছর পর ঘাড় ঘুরিয়ে একটু পিছন ফিরে তাকালেই এক নিরলশ কিন্তু স্বপ্নের মতো একটা জার্নির গল্প সামনে ভেসে উঠবে। রোজারিওর দারিদ্রতা থেকে জাম্পকাটে দৃশ্যপটে দেখানো হচ্ছে লিসবনকে। সেখান থেকে মাদ্রিদ, মাদ্রিদ থেকে ম্যাঞ্চেস্টার, প্যারিস, তুরিন। ইউরোপের সব আশ্চর্য শহর, চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দেয়। পায়ে পায়ে ফ্রেস্কো, স্ট্রিটলাইটস। বোগেনভিলিয়া, পিটুনিয়ার সারি।
নদীর জল এখানে ঘোলা নয়। শুধু ফুটবলের জন্য জনপ্লাবনে ভেসে যায় এক একটা শহর। সেই শহরগুলোতে অ্যাঞ্জেল হয়ে উঠল দেবদূত। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মায়াভরা রাত এল জীবনে। ফাইনালে ডানদিকে শিফট করে একটা ক্রস। ঠিক আট বছর পর, আরেকটা ফাইনালে ডানদিকে শিফট করে টাচলাইন থেকে টেনে ঢুকবে পেনাল্টি বক্সে। দেশের জন্য।
অ্যাঞ্জেলের জন্য কাব্য করতে ইচ্ছে করে। বাঙালির ছেঁদো তরজাকে বাদ দিয়ে প্লেয়ারটার জন্য মন কেমন করে। এই তো অ্যাঞ্জেল খেলছে জুভেন্তাসে। চোট সারিয়ে ফের নেমে পড়েছে মাঠে। একটা টাচ ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে অপোনেন্টের রক্ষণদুর্গ। ডানদিক থেকে স্পিডে উঠছে দি মারিয়া। মাদ্রিদে সামনে রোনালদো, প্যারিসে সামনে নেইমার।
ম্যানচেস্টারে সামনে রুনি। তবু লেস্টারের বিরুদ্ধে সেই চিপ দোল খাইয়ে গেল গোটা ম্যানচেস্টার জনতাকে। একটু সময়, একটু ভাল কিছু পেলে হয়তো সেবার প্যারিস যাওয়া আটকে যায়। কিন্তু প্রেমের শহর তার অ্যাঞ্জেলকে ডেকে নিয়েছিল। টাকা দিয়ে কেই বা রুখতে পেরেছে ভালবাসার জোর।
বেজিংয়ের সোনা। হৃদয় মুচড়ে ওঠা মারাকানা। সাবেয়া ডাকেননি তাকে ডাগআউট থেকে। স্কালোনি ডেকে নিলেন। সাত বছর পর মারাকানায় হাসল অ্যাঞ্জেল। মেসিময় রাজত্বে নীরব আলো-ছায়ার খেলায় ঘুরেফিরে আসতে থাকল তার নাম। সৃষ্টিশীল বাঁ পা, সৃজনশীল খেলা তবু ফিল্ডের সবুজ ঘাসে গতিময়তা ফুঁড়ে ওঠে।
একটু জায়গা পেলে, সামনে দু’তিনজন ঘিরে থাকলেও সবাই জানে রোখা সম্ভব নয়। ফেলে দিতে হবে, মেরে সরাতে হবে। ডেম্বেলে পারেনি, রেনান পারেনি, লুইস পারেনি। পারেনি স্বদেশীয় দিয়েগো সিমিওনে। দি মারিয়া যেখানেই গেছে, মানুষ ভরসা পেয়েছে। আমাদের একটা অ্যাঞ্জেল আছে। সে যে কোনও শহর, ক্লাব … নীল সাদাদের প্রিয় ডি মারিয়া উপন্যাসের কেন্দ্রে না থেকেও থেকে যাচ্ছে।
কেউ না পারার দিনে সোনা এনে দিচ্ছে। একটা গোল দরকার স্বপ্নকে শুধু নিজের করে পেতে, দি মারিয়ার দ্বারস্থ হয়েছে আমজনতা থেকে কোচিং স্টাফ। নায়কের জন্য সাজানো রঙ্গমঞ্চ ব্যর্থতার কালো অন্ধকারে ঢেকে পড়ার আগেই দি মারিয়া রেখে যায় রামধনু। অথচ সে ঘুরে বেড়ায় দেশ থেকে দেশে। আসলে স্বপ্নের ফেরি করে বেড়ায়।
ছেলেবেলার বাইসাইকেল আসলে ছোট ছোট স্বপ্নগুলোকে ফেরি করে বেড়ানো ছাড়া কিছুই নয়। ব্রুনো স্বপ্ন দেখত। অ্যাঞ্জেলও তাই। জন্মদিনে শরীরের বয়স বাড়ে। রংচটা সামিয়ানা চিরকাল সোনায় মোড়া। তার বয়স বাড়ে না। তার বয়স বাড়ে না।