অন্য এক ডেনিস লিলির গল্প

ডেনিস লিলি নামটা শুনলেই শিরদাঁড়া বেয়ে যেন ভীতিকর এক অনুভূতি জানান দেয়। মনের দৃশ্যপটে ভেসে উঠে লম্বা, বুনো, ভয়ংকর গতিতে ছুটে আসা বলের কথা, স্বয়ং ভিভ রিচার্ডসের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছিলেন তিনি। অথচ খোদ অস্ট্রেলিয়াতেই ছিলেন আরেক লিলি যিনি কিনা স্বভাবে ডেনিস লিলির পুরো বিপরীত।

জাতীয় দল বহু দূরের পথ, ঘরোয়া ক্রিকেটেই যিনি নিয়মিত হতে পারেননি। তবে ফার্স্ট বোলার লিলির চাইতে আত্ননিবেদনে কোনো অংশে কম ছিলেন না তিনি, প্রায় একই সময়ে আবির্ভাব হলেও ক্রিকেটটাকে তিনি মনের মাঝে লালন করেন আজও। আমাদের আজকের গল্পের নায়ক তাই ডেনিস কিথ লিলি নন, বরং ডেনিস জন লিলি।

১৯৪৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের ব্রিসবেনে জন্ম এবং বেড়ে উঠা লিলির। আকারে ছোটখাটো গড়নের লিলি ছোটবেলা থেকেই শান্তশিষ্ট। বুনো আগ্রাসী পেস বোলিংয়ের চাইতে তাঁর ভালো লাগে বল নিয়ে কারিকুরি দেখাতে। হাওয়ায় ভাসিয়ে লেগস্পিনের মায়াজালে আবদ্ধ করে ব্যাটসম্যানদের সাজঘরে ফেরাতেই তাঁর প্রশান্তি। অ্যাংলিকান চার্চ গ্রামার স্কুলে পড়াকালীন সময়ে ক্রিকেটের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন তিনি।

১৯৬৫-৬৬ মৌসুমে প্রথমবারের মতো কুইন্সল্যান্ডের হয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলার সুযোগ পান তিনি। এর বছর তিনেক আগেই অবশ্য হইচই ফেলে দিয়েছিলেন পেসার লিলি। তিনি যখন বলের গতি দিয়ে পুরো বিশ্বে রাজত্ব করছেন, তখন অন্য লিলি ব্যস্ত পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে। দুই লিলির অবশ্য সৌভাগ্য হয়নি একই সাথে একই ম্যাচে মাঠে নামার।

তবে মজার ব্যাপার হলো, একবার কুইন্সল্যান্ড এবং ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচে দ্বাদশ ব্যক্তি ছিলেন জন লিলি। সেই ম্যাচে বদলি হিসেবে ফিল্ডিং করতে নেমে গ্রেগ চ্যাপেলের বোলিংয়ে ডেনিস লিলিকে সাজঘরে ফেরান তিনি। সেই ম্যাচে স্কোরকার্ডে লেখা ছিল এমন – লিলি ক্যাচ লিলি বল চ্যাপেল।

বিখ্যাত মানুষের সাথে নামের মিলের বিড়ম্বনা পুরো ক্যারিয়ারজুড়েই পোহাতে হয়েছে লেগস্পিনার লিলিকে। একবার হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘পুরো ক্যারিয়ারজুড়েই নামের জন্য নানা বিড়ম্বনা পোহাতে হয়েছে আমাকে, তবে মজার ঘটনার সৃষ্টিও কম হয়নি। আমি বেশ উপভোগই করেছি ব্যাপারটা।’ 

লেগস্পিনারদের ক্যারিয়ারের চিরন্তন ঝুঁকি হলো অনেক সময় ভালো বোলিং করেও তাঁদের মার খেতে হয়। শেন ওয়ার্ন থেকে আব্দুল কাদির সবাই কোনো না কোনো সময়ে রান বিলিয়েছেন দেদারসে, লিলির জীবনেও এসেছিল তেমন এক দিন। ১৯৮২ সালে সাউথ অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এক ম্যাচে ডেভিড হুকস টানা চার ছক্কাসহ এক ওভারে ২৮ রান তুলেছিলেন তাঁর ওভারে।

জাতীয় দলে কখনো খেলার সুযোগ না পেলেও মাঝে ১৫ বছরের ব্যবধানে ফিরেছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটের দলে। মূলত পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে গিয়ে মাত্র ২০ বছর বয়সে সাত ম্যাচ খেলার পর ক্রিকেট থেকে বিরতি নেন। ৩৫ বছর বয়সে পুনরায় ডাক পেয়ে দারুণ এক জুটি গড়েছিলেন ট্রেভর হন্সের সাথে। তাঁরা দুজনে মিলে বেশ কিছু ম্যাচও জিতিয়েছেন কুইন্সল্যান্ডকে। সবমিলিয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১৭ ম্যাচ খেলে তাঁর সংগ্রহ ৩৩ উইকেট। এর পাশাপাশি ব্যাট হাতে করেছেন ১৩৫ রান।

তবে একটা জায়গায় তিনি ছাপিয়ে গেছেন বিখ্যাত লিলিকেও। প্রায় একই সময়ে খেলা শুরু করলেও পেসার লিলি অবসর নিয়েছেন কয়েক যুগ হতে চললো। কিন্তু লেগস্পিনার লিলি আজো থামেননি, ক্রিকেটের প্রতি অদম্য ভালোবাসা দেখিয়ে ৬৬ বছর বয়সেও খেলে যাচ্ছেন। এখনো নিয়মিত ওয়ান্দারার্স এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়সী দলগুলোর হয়ে মাঠে নামেন। এমনকি গত মৌসুমে নিজের বোলিং এ ফিল্ডিং করতে গিয়ে আঙ্গুল ভেঙে ফেললেও এ মৌসুমে আবারো ফিরে এসেছেন পূর্ণ উদ্যমে।

ফ্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের রমরমা এ যুগে যেখানে ফিক্সিংয়ের কালো থাবায় কলুষিত হচ্ছে ক্রিকেট, সেখানে লিলির মতো ক্রিকেটাররাই মশাল হাতে বহন করে যাচ্ছেন ক্রিকেটের মশাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link