বল হাতে যেই জাদু তিনি দেখাতেন তা যে কোন স্পিন বোলারের জন্য স্বপ্নের মত। নি:সন্দেহে ভারতের ক্রিকেটে আসা সব চেয়ে প্রতিভাবান স্পিনারদের একজন। তাঁর সময়ের ব্যাটসম্যানদের জন্য এক মৃত্যু উপত্যকার মত ছিলেন বিষান সিং বেদি। কারো কারো চোখে তিনি ইতিহাসের সেরা বাঁ-হাতি স্পিনার।
বলের উপর নিখুঁত নিয়ন্ত্রণ ও ফ্লাইট, লুপ, স্পিনের এক দুর্দান্ত কম্বিনেশন। ব্যাটসম্যানদের হাওয়ায় ভাসানো বল দিয়ে লোভ দেখানোর সাহস দেখিয়েছেন পুরো ক্যারিয়ার জুড়ে। বল হাতে যতটা সরব ছিলেন, ততটাই সরব ছিলেন ক্রিকেটের সব অন্যায়ের বিরুদ্ধেও।
বিষান সিং বেদির ক্রিকেট যাত্রাটা শুরু হয় নিজের জন্মস্থান দিল্লীতেই। প্রথমে পেসার হিসেবে ক্রিকেটটা শুরু করলেও কোচদের পরামর্শে স্পিন বোলিং এ চলে এসেছিলেন। বাকিটা তো ভারত ক্রিকেটের ইতিহাস হয়েই রয়ে গিয়েছে। আর এই ইতিহাস তিনি গড়েছেন আঙুলের জোরে।
আঙুলের জোর কিভাবে এসেছে জানেন? – এর পেছনে আবার একটা গল্প আছে। বিষান সিং বেদির শৈশব কেটেছে মার্বেল খেলে। এই মার্বেল খেলার দক্ষতা তাঁকে স্পিন বোলিংয়ের সুবিধা দিয়েছে। তাঁর আঙুলগুলো আরো শক্তিশালী হয়েছে। এছাড়া তাঁর সমকালীনরা সাক্ষী দিয়েছিলেন নেটে বোলিং করা শুরু করলে বিষান যে কখন থামবে তা কেউ জানতো না।
১৯৬১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর যাত্রা শুরু হয়। নর্দান পাঞ্জাবের হয়েই ঘরোয়া ক্রিকেটে নিজেকে প্রমাণ করেন তিনি। ভারত দলের হয়ে ডাক পান ১৯৬৬ সালে মাত্র ১৯ বছর বয়সেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এক টেস্ট ম্যাচে ইডেন গার্ডেন্সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় এই কিংবদন্তি স্পিনারের।
বিষান সিং বেদি ও ভগবৎ চন্দ্রশেখর সেই সময় বিশ্বের অন্যতম সেরা স্পিন বোলিং জুটিতে পরিণত হন। এখনও ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসের সফলতম স্পিন বোলিং জুটি তাঁরা। অন্তত ৩০০ উইকেট পাওয়া বোলিং জুটির মধ্যে সবচেয়ে কম বোলিং গড় তাঁদেরই।
বিষান সিং (১৮৪) ও চন্দ্রশেখর (১৮৪) দুজনে একসাথে নিয়েছেন ৩৬৮ উইকেট। এই দুইজন ৩৬৮ উইকেট নিয়েছেন মাত্র ২৭.৯৬ বোলিং গড়ে। আরেক সফল জুটি হরভজন সিং ও অনিল কুম্বলে একসাথে ৫০১ উইকেট নিয়েছিলেন ৩০.২২ গড়ে।
ভারতের হয়ে বেদি সব মিলিয়ে খেলেছেন ৬৭ টি টেস্ট ম্যাচ। সেখানে ২৮.৭১ গড়ে নিয়েছিলেন ২৬৬ উইকেট। টেস্টে ১৪ বার পাঁচ উইকেট ও ১ বার দশ উইকেট নেয়ার কীর্তিও আছে তাঁর। এখনো তিনি টেস্টে ক্রিকেটে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি স্পিনার।
তার চেয়ে বেশি উইকেট নিয়েছেন শুধু অনিল কুম্বলে, হরভজন সিং ও রবিচন্দ্রন অশ্বিন। ওদিকে ভারতের হয়ে ১০০ টেস্ট উইকেট নেয়া স্পিনারদের মধ্যে তাঁর চেয়ে কম বোলিং গড় মাত্র ২ জনের। শুধু শুধু তো আর তিনি সর্বকালের সেরাদের একজন নন।
বিষান সিং বেদি পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই দেখিয়েছেন ধারাবাহিকতার চূড়ান্ত রূপ। তিনিই একমাত্র বোলার যিনি ভারতের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিয়েছেন ১৫০০ উইকেট। বিশেষ করে দিল্লির হয়ে অবিশ্বস্য সব কীর্তি গড়েছেন এই স্পিনার। দিল্লী তাঁদের প্রথম দুই রঞ্জি ট্রফি জিতেছিল বেদির নেতৃত্বেই।
তাঁর নেতৃত্বে পাঁচ মৌসুমের চারবারই ফাইনাল খেলেছিল দিল্লী। এছাড়া দিল্লির হয়ে ৫৭ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি। সেখানে ১৪ বোলিং গড়ে নিয়েছিলেন ২৯৮ উইকেট। এরমধ্যে ২৭ বার পাঁচ উইকেট ও ৭ বার নিয়েছেন দশ উইকেট।
ভারতের হয়েও ২২ টি টেস্ট ম্যাচে অধিনায়কত্ব করেছেন তিনি। ভারতের হয়ে ১০ টি ওয়ানডে ম্যাচও খেলেছিলেন বিষান সিং। এছাড়া কাউন্টি ক্রিকেটেরও বড় নাম ছিলেন তিনি। ১৯৭২ থেকে ৭৭ সাল পর্যন্ত খেলেছেন কাউন্টিতে। সেখানে ২১.১৬ গড়ে নিয়েছিলেন ৩৯৪ উইকেট।
১৯৭৫ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপেও ঝলক দেখিয়েছিলেন এই স্পিনার। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে ইংল্যান্ডের কাছে হারার পর জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল ভারত। ভারতকে সেদিন সেই জয়টা এনে দিয়েছিলেন বিষান সিং। সেদিন পূর্ব আফ্রিকার বিপক্ষে ১২ ওভারের ৮ টাই করেছিলেন মেইডেন। ৬ রান দিয়ে তুলে নিয়েছিলেন ১ টি উইকেট। সেদিন বেদিকে খেলাটাই যেন অসম্ভব ছিল।
এছাড়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব সময়ই আওয়াজ তুলতেন তিনি। তাঁর সময়ে কয়েকবার ম্যানেজম্যান্টের বিপক্ষে কথা বলে সমালোচনার স্বীকার হয়েছিলেন। তবুও যখনই মনে হয়েছে কিছু একটা ভুল হচ্ছে তখন মুখ খুলেছেন তিনি। তাঁর সেই বৈশিষ্ট্যে এখনও এতকুটু ধুলা জমেনি। এখনো প্রতিবাদ জানান নিজের মত করে কিংবা তাঁর টুইটার থেকে।
প্রায় এক যুগ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পরেও নতুন স্পিনার তৈরির গুরুদায়িত্ব নিয়েছিলেন। ১৯৯০ সালে হয়েছিলেন ভারতের কোচও। সব মিলিয়ে ভারতের ক্রিকেটে আসা এক অবিস্মরণীয় চরিত্র বিষান সিং বেদি। দেশটির স্পিন বোলিং ইতিহাসেরও সোনালি ইতিহাসের নাম বিষান সিং।