মাভৈ সেনানী, হৃদয় নিংড়ে সোচ্চার

একটা জীবদ্দশা পেরিয়ে আরেক জীবনের জন্য বসে থাকা, এই চলন আমাদের তামাম বিশ্বের খুব নিজস্ব। আমরা ফুটবলকে মনের আঙিনায় বিনা বাক্যব্যয়ে এক্কাদোক্কা খেলতে দিয়েছি। কখনও বকাবকি করিনি। ঠিক যেভাবে আমরা ছোট থেকে এতটা বড় হয়ে উঠেছি, সেই প্রকৃতির নিজের করাল নিয়মে কোনও একদিন লুকা মদ্রিচ খেলা ছাড়বে। রিয়াল মাদ্রিদের দেওয়া ফেয়ারওয়েলে কতগুলো শুকনো ফুলের স্তবক নিয়ে মঞ্চে উঠে একটা কিছু বলবে। কাকা বলেনি, ওজিল বলেনি, মদ্রিচ বলবে।

ফুটবল প্লেয়ার, ফুটবলকে আত্মজা ভেবে নিজের সামনে বড় করে একটা সামিয়ানা টাঙিয়ে দেওয়া। খেলা ছাড়ার পর খেলোয়াড়দের মানসিকতার কোন ডিপার্টমেন্টটার পরিবর্তন হয়? সুরজিৎ সেনগুপ্ত নামে এক মহীয়ান বলতেন, মাঠ মাঠই। মাঠ নিজেই তার বিকল্প। খেলা তো শুধুই খেলা নয়। ফুটবলেও ফুটবল থাকে না, ক্রিকেটেও শুধু ক্রিকেট থাকে না। মেঘ ঘনানো কোনও একটা সময়ে ইডেনের হাইকোর্ট এন্ড থেকে একটা ফাস্ট বোলার যখন দিনের প্রথম বলটা করতে আসে তখন গঙ্গা থেকে চমৎকার হাওয়া দেয়। একটা ঝাপটা, এক চিলতে শরীর দোলানো বাতাস। যে বাতাসে বলটা মাঝপিচে ধাক্কা খেয়ে মোশন নিয়ে নরখাদকের মতো এগিয়ে যাবে শিকারের দিকে। কখনও ফস্কাবে, কখনও শিকার গ্রাস করবে। মাভৈ সেনানী, হৃদয় নিংড়ে সোচ্চার।

অথচ আমরা কথা বলছি ফুটবল নিয়ে। হাফপ্যান্টের খেলা নিয়ে। যে খেলাকে উচ্চবিত্তরা এখনও নিজের বলে ভাবতে পারেনি। মাটি ঘেঁষা, ঘাম ফেলা শ্রমিকের ফুটবলে কঠোর সাম্রাজ্যবাদ হাত বসিয়েছে। পুঁজিবাদের উত্তরোত্তর বিকাশ ঘটে গেছে ফুটবলে। অথচ এই ফুটবল ছিল আমজনতার খুব নিজস্ব। হতদরিদ্রগুলোর একটু নিজের মতোন করে পাওয়া সময়, বাংলায় যাকে রিল্যাক্সেশন বলা হয় আকছার। ফুটবলের নকশা বদলেছে, ধরণ বদলেছে, ডিফেন্ডার থেকে স্ট্রাইকারের পজিশন বদলেছে।

একজন কোচ, তিনি ১২০ গজের ঐ মাঠটাকে মাপতে যে ক’টা টুকরো করবেন, এবং বিলাসী নৃশংসতায় করে চলেওছেন— তার জো নেই! প্রথমে ভাঙলেন ১৫ টুকরোয়, তারপর ২৫, তারপর ৩৫… চলছে তাঁদের খননকার্য। সিদ্ধ হলে পরে চক ডাস্টার উঠে আসে হাতে। গোল গোল ফ্রেমে ভরে যায় ঐ খেতে না পাওয়া বাচ্চাগুলোর একটুকরো আনন্দের, ভালবাসার মাঠখানি। কথা হয়, সেই নাকি পারে ফুটবলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। যুদ্ধ। বিরুদ্ধতার বারুদ জমেছে শরীরের সবকটা ভাঁজে। তাকে রুখতে হবে। ইংরেজরা বলল ডিফেন্স। পর্তুগিজ হার্মাদরা বলল ডিফেসা। সেটাই স্প্যানিশরা একটু পাল্টে নিল ডিফেন্সা নামে। কখনও পাঁচ ডিফেন্ডার, কখনও তিন, চার, দুই। হারবার্ট চ্যাপম্যান বলে একটা লোক বললেন ঐ এগারোটা ছেলে খেলবে ২-৩-৫ এ! মহাভারত পড়েছ, খোকা? দ্রোণকে মনে পড়ে, কিংবা নিদেনপক্ষে দ্রুপদনন্দন ধৃষ্টদ্যুম্নকে!

ছেলেবেলার মহাভারত যা ছিল ব্যুহ, ফুটবলে সেটাই হয়ে গেল ছক। অথচ এইসব ছকের কোনও নাম নেই। ৪-৩-৩ অ্যাটাকিং ফর্মেশনকে কেউ চক্রব্যুহ বলে বসে না ভুল করেও! কিংবা ৫-৩-২কে বজ্রব্যুহ। কিংবা ৪-২-৩-১কে সর্বতোভদ্র ব্যুহ! এ তো ব্যুহই। মেসি তো অর্জুন, আর হাতেম বেন আরফা অভিমন্যু। মেসি জানেন চক্রব্যুহে ঢুকে বেরিয়ে আসার পথ। ৪-৩-৩ এ অ্যাটাকিং চক্র কখন চুপিসাড়ে বদমায়েশি করে ৬-৩-১ এ নেমে এসে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে একটা প্লেয়ারকে, তা বুঝতে না বুঝতেই ছেঁকে ধরেছে ডিফেন্ডাররা। যেন এক একটা নরমাংসলোভী সন্ত্রাসী! মেসি সেখানে দুর্দমনীয় হয়ে জয়দ্রথ বধ করছেন। গিলেরমো ওচোয়া আসলে নাকি ছিলেন স্বয়ং জয়দ্রথ!

কিংবা ধরা যাক ৪-২-৩-১ এর মতো ব্যুহ। জুয়ানমা লিলো কী যে এক ধাঁধা বের করলেন। কেউ জানলই না ওটা আসলে ৪-৪-২ এরই ভেতরে লুকিয়ে থাকা ঘটোৎকচ। এখন শেল হয়ে বেরিয়ে এসে হুঙ্কার দিচ্ছে। চারটে ডিফেন্ডারকে নিয়ে যখন শুরু করছে, সবাই ধরেই নিচ্ছে যদি আক্রমণ করি তবে নিজেদের অর্ধে নামতে নামতেই সময় বেরিয়ে যাবে। বিপক্ষ ধরতে পারল না, ৪‌-এর মাঝে দুটো শূন্যস্থানে ২-এর দুটো প্লেয়ার ঢুকে সেটাকে বদলে দিচ্ছে ৬-২-২ তে। কিংবা ৬-৩-১, কিংবা ৬-৪-‌০।

শক্তের ভক্ত প্রবাদকে জোরালোতম করার দিকে এগোনো পন্থীদের এই পর্যায়ে এসে ধাঁধায় ফেলে দেওয়ার মোক্ষম অস্ত্র। আমাদের চোখের সামনে এই অস্ত্রে বধ হচ্ছেন তাবড় মহারথীরা। কৌরব যেমন যুযুৎসুর মতো বহু ভাই হারালেন, বধ হলেন, তেমনি পাণ্ডবদের পক্ষে ইরাবন্দ বিন্দের মতো যোদ্ধারা হেরে বসলেন। ডুয়েল, লাগাতার ডুয়েল। ফুটবল আর মহাভারত ঠিক এইখানে এসে মিশে যাচ্ছে। মিশে যাচ্ছে তার গঠনে, কাঠামোয়, বিন্যাসে। একের পর এক সারণি তৈরি করে ফেলছে দুঁদে সব মানব মস্তিষ্ক। এর মধ্যে সর্ববৃহৎ পরিসর নিয়ে বসে আছে আর্জেন্টিনা বলে একটা দেশ। যে দেশের মানুষ প্রতিবাদ করতে জানে, একটা ফুটবল দলের অতিবিস্ময়কর পরাজয় দেখলে পরেরদিনই কোচের গৃহে ইঁট ছোঁড়ে।

আগুনের আঁচকে লেলিহানে পরিণত করতে তারা অনেকদিন আগে শিখে গেছে। অপরদিকে ব্রাজিল যেন নিজেই নিজের দস্যু। দস্তুরমতো বিবর্ণবাদকে সঙ্গ করে চলেছে নগরে, প্রান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে। ব্রাজিল নিজে একটুকরো হস্তিনাপুর। শান্তনুর রাজ্যে আনন্দময় প্রজাদের বাস। কিংবা নগরের একটু দূরে আমোদে মেতে থাকা অনেক সৈন্যদের আড্ডা। হস্তিনাপুরে নাকি এককালে খুব সুন্দরের বসবাস ছিল। গ্যারিঞ্চা, পেলে, জালমা স্যান্টোস, জিকো, সক্রেটিস, রোনালদিনহো, নেইমার – এইসব নামে ডাকা হতো তাকে। তার বিবিধ নাম, বিবিধ পরিচয়। তবে একটু খুঁজলে, হস্তিনাপুরের আসল নামের সন্ধান মেলে। সে নামটা হল রোনালদো নাজারিও ডি লিমা।

৩-৩-১-৩। গোলকিপারকে সেনাধক্ষ্য ধরলে তার রক্ষাকর্তা হিসেবে সামনে তিন ডিফেন্ডার, তিন সেন্ট্রাল অথবা ডিফেন্সিভ, অথবা সেন্ট্রাল ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার, একজন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার এবং দু’পাশে দুটো উইংকে নিয়ে একজন সেন্টার ফরোয়ার্ড। অতি দ্রুত খেলা খেলতে হবে। চোখের পলকে ধরে ফেলতে হবে বিপক্ষের স্ট্রেন্থ, দুর্বলতা। তবেই অর্ধেক জয় সম্পন্ন, অথচ এই বিষয়ে ডাহা ফেল করলে এই ব্যুহের ব্যবহারিক প্রয়োগ হিসেবে রীতিমতো সন্দেহ করতে হয়।

এ যুগ তো বটেই, মহাভারতে দ্রোণ এমন ব্যুহ রচনা করলে আগামী সূর্যোদয়ের আগেই তিনি সৈন্যদল থেকে বরখাস্ত হতেন। এবং খেতেন দুর্যোধনের ধমক। অথচ দুর্যোধন জানতেও পারতেন না, কী অতি উজ্জ্বল শলাকাকে তিনি সাজঘরে ফেলে আসতেন। কারণ এ বিদ্যা তিনি দ্রোণের কাছে শেখেননি, দ্রোণ শেখাননি। তিনি নিজে শিখেছেন মায়াবলে, শিখেছেন দৈববলে। আর্জেন্টিনা দেশের এক ভদ্রলোক, নাম মার্সেলো বিয়েলসা— এ নামটা তাঁর সামাজিক পরিসরে, পাসপোর্টে, ভিসায়। আসলে তাঁর নাম দ্রোণাচার্য।

ফুটবল আসলে খুব সহজ খেলা। গোলকিপার থেকে গোল বলটা পা দিয়ে পাস করে দাও ডিফেন্ডারকে, ডিফেন্ডার পাস করবে মিডফিল্ডারকে, মিডফিল্ডার স্ট্রাইকারকে, স্ট্রাইকা গোলে বল ঠেলে দেবে। আসলে ফুটবলকে ভাগ করা যায় তিনটে বাক্সে। সহজ ফুটবল, এই বলের আদানপ্রদানে বিরুদ্ধপক্ষ বাধার সৃষ্টি করলে তাদের এড়িয়ে চোখের নিমেষে নিজের দলের প্লেয়ারকে একটা গ্যাপ খুঁজে, শূন্যস্থান খুঁজে সেখানে তার জন্য বল সাজিয়ে দেওয়া। এখনকার দিনে যাকে বলা হয় ‘স্পেস’। জীবনে, ফুটবলেও। মহাভারতেও।

এই স্পেস খুঁজে পাননি বলেই অর্জুন মহামানব, দেবভব তুঃ নন। সাত্যকির মতোই এক ছাত্র, এক শিক্ষানবীশ। স্পেসের ব্যবহারকে শুরুতে কেউ জোরদার করেনি, নিজের করে নেয়নি। দিন যত এগিয়েছে সামনে, ফুটবলকে ভেঙে ভেঙে তৈরি করা হয়েছে, দেখানো হয়েছে স্পেসের গুরুত্ব কতখানি। ৪-৩-৩ এ যখন নিচ থেকে দুটো মিডফিল্ডার ওপরে উঠে আসছে বল নিয়ে, তখন অনেকটা ওয়াইডে সরে যাচ্ছে দুটো উইঙ্গার। একটা ত্রিভুজ তৈরি করছে মাঠের দুটো পাশে। বিপক্ষ আসলে একজনের বিরুদ্ধে দু’জন পরিস্থিতির সৃষ্টিদায়ী এই স্পেস, এই শূন্যস্থান। যা ভরাট হওয়ার নয়। ভ্যাকুয়াম কখনও কোনও কিছু দিয়েই ভরাট করা যায় না। কিংবা ৪-৩-২-১।

বিদেশীরা একে বলেন ‘ক্রিশমাস ফর্মেশন’। এখানেও একের বিরুদ্ধে দুই হয় বটে, কিন্তু সে আবাদে সোনা ফলানোর জন্য নিচে নেমে এসে আক্রমণ গঠনে সাহায্য করেন একজন সেন্টার ফরোয়ার্ড। এখানে তিনি কিন্তু স্ট্রাইকার নন। অর্থাৎ যুদ্ধে জয়ী হতে দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেনাটাকেও প্রয়োজনে পিছু হঠতে হয়। পিছু হঠতে হঠতে হঠাৎ বিপক্ষ দেখতে পায় দু’পাশ থেকে দুটো উইং টাচলাইন ধরে উঠে এসেছে এবং সামনে ছ’গজের বক্সে দুজন প্লেয়ার ঢুকে পড়েছে।তখন সাদা পতাকা দেখিয়ে আত্মসমর্পণ বিনা আর উপায় কী!

এই আমাদের ফুটবল। এই আমাদের আত্মনির্ভরতা, আমাদের প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষর। ফল্গুধারার মতো যা বয়ে চলেছে বিভিন্ন শাখায়। কখনও ফুটবলে, কখনও হকিতে, কখনও আরও বিবিধ আসরে-বাসরে। অথচ আমরা জেনেছি এর প্রথম বাস মহাভারতের অনেকটা অন্তরজুড়ে। কুরুক্ষেত্রে যা বিস্তার, বিস্তীর্ণ প্রান্তর জুড়ে কত প্লেয়ার খেলে যাচ্ছে ব্যুহ মেনে। প্রতিদিন কেউ হারছে, জিতছে। সময়ের বদলে ফুটবল তার নিজের দলিল বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে ফুটবলের নিজস্ব ফর্মেশন, বিল্ড আপ প্লেয়িংয়ের রীতিকে আপন করে নিয়ে বহু দল মন দিচ্ছে প্রেসিংকে কী করে আরও, আরও জোরকদমে শক্তিশালী করে তোলা যায়। ফুটবল পাল্টাচ্ছে, পাল্টাচ্ছি আমরাও। আমাদের শ্রমের পরিশ্রম আমরা এত এত বিলিয়নের মাংস খাওয়া শেয়ালগুলোর হাতে তুলে দিয়েছি অনেককাল আগে। আজ আমাদের আর আক্ষেপের কোনও সুস্থ পরিবেশ নেই।

ঠিক এই সময়ে, জোরে কোথাও ঝড় ওঠে। একটা ছবি মনের কোনাচে আন্দোলিত হয়। একদিন কাকা, ওজিল, মদ্রিচ আমাদের জন্য খেলতো। সব পেয়েছির জগতকে চাক্ষুষ করা তিন মহারথীর একজনকেও, রাতের অন্ধকারের আড়ালে কি আমরা কর্ণ বলে ডাকতে পারি না!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link