অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সবশেষ সিরিজে অ্যাডিলেডে ৩৬ রানে অলআউট হবার পর রাহানের নেতৃত্বেই ওই সিরিজে ঘুরে দাঁড়ায় ভারত। সবশেষ দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে প্রথম টেস্টে হারের পর জোহানেসবার্গে ইনজুরির কারণে খেলতে পারেননি বিরাট। ওই ম্যাচেই জয় পায় ভারত।
শেষ টেস্টে ফিরে মাঠে শক্তি, আর আগ্রাসী মনোভাব দেখালেও হেরে যায় ভারত। অধিনায়ক হবার পর থেকেই ম্যাচে জয়ের জন্য বিরাট যতটা কৃতিত্ব পেয়েছেন তার চেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছেন ম্যাচ হারলে। সব ফরম্যাটেই কোহলির অধিনায়কত্ব রেকর্ড ভারতের যেকোনো অধিনায়কের চেয়েই বেশ এগিয়ে। অবশ্য ভারতের সবচেয়ে সেরা দলটিও যে বিরাটের অধীনেই খেলেছে।
অধিনায়ক হিসেবে বিরাটের প্রথম টেস্টটা যদি দেখি। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অধিনায়ক হিসেবে অভিষেকেই কিছু আক্রমণাত্মক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে ড্রপ করে লেগ স্পিনার কারান শর্মাকে অভিষেক করান বিরাট। কারণ তাঁর মনে হয়েছিলো অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ফিঙ্গার স্পিনারের চেয়ে রিস্ট স্পিনারই বেশি সুবিধা করতে পারবে। তবে ওই টেস্টে হেরে যায় ভারত। একই সাথে বেশ বাজে পারফরম্যান্সই দেখান কারান। ৫ এর উপর ওভারপ্রতি রান দিয়ে ওই টেস্টে মাত্র ৩ উইকেট পান কুরান।
শেষদিনে একপ্রান্তে ভারতীয় ব্যাটাররা অজি বোলারদের সামনে আসা যাওয়ার মিছিলে থাকলেও একাই লড়াই করেন বিরাট। বিরাটের ১১৫ রানের দুর্দান্ত ইনিংসের পরেও বাকিদের ব্যর্থতায় মাত্র ৪৮ রানে হেরে যায় ভারত। চা-বিরতি পর্যন্ত ২০৫ রানে ভারতের ছিলো ২ উইকেট। শেষ সেশনে ১৫৯ রান প্রয়োজন হলেও বাকিরা উইকেট দিতে থাকলেও ড্র’য়ের কথা চিন্তা না করে ঝুঁকি নিয়ে জয়ের জন্যই মেরে খেলছিলেন বিরাট। সেই টেস্টে হেরে যায় ভারত। আর কারান শর্মাও বাদ পড়েন দল থেকে। কোহলির জয়ের আকাঙ্ক্ষা সেই ম্যাচে ভারতকে এনে দিয়েছিলো পরাজয়।
তবে অ্যাডিলেডে অধিনায়ক হিসেবে নিজের অভিষেক টেস্টে দেখিয়েছিলেন তিনি টেস্ট জয়ের তাড়নায় সবসময়ই হারের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত।
২০১৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেন্ট লুসিয়া টেস্টে দ্রুত রান তোলার জন্য চেতেশ্বর পুজারার বদলি ভারত দলে নেয় রোহিত শর্মাকে। আবহাওয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী টেস্টের অনেকটা সময়ই বৃষ্টি হবার আশংকা ছিলো! যার জন্যই রোহিতকে নেওয়া। ওই টেস্টে ২৩৭ রানের বিশাল জয় পায় ভারত। যদিও প্রত্যাশা অনুযায়ী খেলতে পারেননি রোহিত।
বাজে ফর্মের কারণে শুধু পুজারাই নয় ২০১৭-১৭ দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে বাদ পড়েছিলেন আজিঙ্কা রাহানেও। তবে সেই রাহানে-পুজারার উপরই বিরাট অধিনায়ক হিসেবে শেষ এক বছরে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস দেখিয়েছেন। দু’জনই ছিলেন ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে ফর্মে। তবে অধিনায়ক দু’জনকেই সুযোগ দিয়েছিলেন লম্বা সময়।
এর মাধ্যমে দুইটা জিনিস প্রকাশ পায়। হয়তো এটি বিরাটের আবেগপ্রবণতা নয়তো কঠিন মূহুর্তে দু’জনেই বেশ কয়েকবার ব্যাট হাতে নিজেদের প্রমাণ করেছেন।
এবারে পাঁচ বোলিং কম্বিনেশনের ব্যাপারে আলোচনা করা যাক। পাঁচ বোলার খেলানো নিয়েও বেশ সমালোনার মুখে পড়েন বিরাট। ২০১৪-১৫ অস্ট্রেলিয়া সফরের পরে প্রথম দুই টেস্টেই পাঁচ বোলার খেলিয়েছিলেন বিরাট। ততদিনে ধোনির টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ। এরপর ফতুল্লায় বাংলাদেশের বিপক্ষে তিন পেসার ও দুই স্পিনার নিয়ে নামেন বিরাট। পরের শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে গল টেস্টে মাত্র দুই পেসার ও তিন স্পিনারকে খেলান তিনি। ওই দুই টেস্টের আগে অশ্বিন কখনোই ৮ এর উপরের পজিশনে ব্যাটিংয়ের সুযোগ পাননি। ধোনি দলে না থাকায় পাঁচ বোলারই ব্যাটিংয়ে নামতো ঋদ্ধিমান সাহার পর।
ওই গল টেস্টে জয়ের কাছে গিয়েও দীনেশ চান্দিমালের অবিশ্বাস্য এক ইনিংসে পরাজিত হয় ভারত। পরের টেস্টে ব্যাটিং ডেপথ বাড়াতে হরভজন সিংকে বাদ দিয়ে স্টুয়ার্ট বিনিকে নিয়ে দল সাজান বিরাট। ওই টেস্টে বিরাটের অধিনায়কত্বে দারুন এক জয় পায় ভারত। মূলত ব্যাটিং অপরাউন্ডার নিয়ে দলকে ব্যালেন্স করেন তিনি। এরপর এই ব্যাটিং অলরাউন্ডারের জায়গা পান রবীন্দ্র জাদেজা। এবং বর্তমানে ৭ ও ৮ নং পজিশনে রবিচন্দ্রন অশ্বিন ও শার্দুল ঠাকুর খেলায় বোলিং অপশনের সাথে সাথে ব্যাটিং ডেপথও পাচ্ছে ভারত।
শুধু বিরাটই নয় কোচ হিসেবে রবী শ্রাস্ত্রী, অনিল কম্বলে প্রত্যেকেই পাঁচ বোলারকে খেলানোর চেষ্টা করতেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩৬ রানে অলআউটের পর বিরাট কোহলির জায়গায় রাহানে নিয়েছিলেন রবীন্দ্র জাদেজাকে! স্পেশালিষ্ট ব্যাটারের জায়গায় নিলেন অলরাউন্ডার। এর আগে অনিল কুম্বলের অধীনে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হোম সিরিজে ধর্মশালায় কোহলির ইনজুরিতে চায়নাম্যান কুলদীপ যাদবকে দলে নিয়েছিলো ভারত!
কোহলি হয়তো সঠিক সময়েই দায়িত্ব হস্তান্তর করেছে। বেশ কিছু তরুন ক্রিকেটার এখন ভারত দলে। অশ্বিন, জাদেজা, ইশান্ত, উমেশ যাদব, মোহাম্মদ শামিরা তাঁদের ক্যারিয়ারের শুরুর ঘাটতিটা কাটিয়েছিলেন ধোনির অধীনেই! যার কারণে বিরাট পেয়েছিলেন অসাধারণ একটি দল।
অবশ্য বিরাট এবং রবি শাস্ত্রীর অধীনের বোলারদের ফিটনেস লেভেল ছিলো দুর্দান্ত। আগে যেখানে এক স্পেলের বেশি নিজের সেরা রিদমে বল করতে পারতো না পেসাররা, সেখানে দিনে একাধিক স্পেলে সেরা রিদমেই বল করতে পারেন তারা। ২০১৪ পর্যন্ত ইশান্ত ৬১ টেস্টে ৩৭.৩০ গড়ে উইকেট নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে কোহলির নেতৃত্বে ৪৪ টেস্টে তাঁর গড় ছিলো ২৫.০১। ইনস্যুইং, ফুলার, লাইন-লেন্থ সবকিছুর উন্নতি ছিলো চোখে পড়ার মতো।
এছাড়া জাসপ্রতি বুমরাহ, মোহাম্মদ সিরাজদেরও ক্যারিয়ার শুরু বিরাটের অধীনেই। তাদেরকে নিজেদের সেরাটা দিতে সবসময়ই পরামর্শ দিয়েছেন বিরাট। দলের জয়ে কিংবা একজন খেলোয়াড়ের উন্নতিতে অধিনায়কের একার সাফল্য নিশ্চয়ই থাকে না। একটা সিদ্ধান্ত সফল হলে সেটা দলের জন্যই সাফল্য। তবে ব্যাটার এবং অধিনায়ক হিসেবে কোহলি যে আগ্রাসী ভূমিকায় ছিলেন। ভারতীয় দলের সবচেয়ে বড় পাওয়ার সেন্টার যেন তিনি।
কোহলির নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য্য ছিল মূল ভূমিকাটার চেয়েও বিরাট কোনো কিছু। তিনি নিজের আগ্রাসী মনোভাবটা বানিজ্যের এই ক্রিকেট দুনিয়ায় এমন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যেটা আগে ছিল অকল্পনীয়। এমনকি মাঠে শচীন টেন্ডুলকার কি করতেন – সেটা খোঁজার জন্য কোনো নির্দিষ্ট ক্যামেরা দায়বদ্ধ ছিল না। কিন্তু, কোহলির ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছিল। মাঠে তাঁর হাঁটাচলা, কপালের ভাঁজ, ভ্রুর সংকোচন, ক্ষোভ-উল্লাস, প্রতিপক্ষের গ্যালারিকে চুপ করতে ঠোঁটে ওঠা আঙুল, কানখাড়া করে শোনা ভারতীয় গ্যালারির গর্জন – সবই অনুসরণ করতো ক্যামেরা। এসবই কোহলিকে অনন্য করেছি, যার নজীর ক্রিকেটের বুকে আগে কখনো ছিল না। ভবিষ্যতেও আসবে কি না সন্দেহ!
– ইএসপিএন ক্রিকইনফো অবলম্বনে