ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর: সেই কালো অধ্যায়

পরদিন ভোরের সময় রমনা থানায় নিয়ে ওসির রুমে তালাবদ্ধ করে রাখা হয় ১২ জন ফুটবলারকে। মোবাইল কিংবা ইন্টারনেটের যুগ না থাকলেও সকাল হওয়ার পর নানা মাধ্যমে খবরটি চারদিকে ছড়িয়ে পরে। সমর্থকরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজেদের প্রিয় তারকারা কেমন আঝেন সেই খোঁজ নিতে। অন্যদিকে এরপরই রমনা থানা থেকে খেলোয়াড়দের নিয়ে যাওয়া হয় শাহবাগের পুলিশ কন্ট্রোলরুমে। সেখানে তাদের পাশাপাশি অনেক সমর্থকও আটক ছিলো।

একজন খেলোয়াড়ের কাজ মাঠে খেলা। আর সেখানে কোন রাজনীতি স্পর্শ করতে পারেনা। খেলোয়াড়দের নিয়ে তাই সাধারনের শ্রদ্ধাটাও অন্য যে কোন পেশার মানুষের চেয়ে বেশিই থাকে। নতুন প্রজন্মের যারা ফুটবলার কিংবা ক্রিকেটার হতে চান তাদের কাছে পূর্বসূরীরা একেকজন নায়কের আসনে থাকেন।

কিন্তু মাঠে খেলার ঘটনায় কোন খেলোয়াড়ের জেল খাটার ঘটনা বোধহয় খুব একটা নেই। যা বাংলাদেশের ফুটবলে রয়েছে। ১৯৮২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ঘটে যাওয়া তেমনি ন্যাক্কারজনক ঘটনার কারণে কালো অধ্যায় হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে দেশের ফুটবলে। অনেকের কাছে দিনটাকে ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

৩৯ বছর আগের সেই দিনে তুমুল উত্তেজনা বিরাজ করছে ঢাকা শহরে। উত্তেজনা তো হবেই, ঢাকা ডার্বি বলে কথা। মাঠের লড়াইয়ে মুখোমুখি দুই চিরপ্রতিদ্বন্ধী ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ও ঢাকা আবাহনী লিমিটেড। ২২ জনের খেলার পাশাপাশি উত্তেজনাটা দর্শক গ্যালারীতেও পৌছে গিয়েছিলো।

আলোচিত সেই ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজার ১০ মিনিটি আগে বিতর্কিত গোল নিয়ে শুরু হয় মূল ঘটনার। রেফারি গোল না দেয়াতে খেলোয়াড় ও সমর্থকদের মাঝে চরম উত্তেজনাকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসেই ক্ষমতায় আসেন তৎকালীন সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ।

তখন আবাহনীর খেলোয়াড় ও সমর্থকদের সরকারবিরোধী হিসেবে মনে করা হতো। মাঠের উত্তেজনা শেষে ম্যাচের দিন রাতেই অনেক খেলোয়ার ও সমর্থকদের আটক করা হয়। খেলায় যে গণ্ডগোল হয়েছে তার একটা বক্তব্য দেওয়ার জন্য তাদের থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে সে সময় জানানো হয়। ক্লাব থেকে নিয়ে এসে আবাহনীর তিন শ্রীলঙ্কান খেলোয়াড়কেও আটক করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।

পরদিন ভোরের সময় রমনা থানায় নিয়ে ওসির রুমে তালাবদ্ধ করে রাখা হয় ১২ জন ফুটবলারকে। মোবাইল কিংবা ইন্টারনেটের যুগ না থাকলেও সকাল হওয়ার পর নানা মাধ্যমে খবরটি চারদিকে ছড়িয়ে পরে। সমর্থকরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজেদের প্রিয় তারকারা কেমন আঝেন সেই খোঁজ নিতে। অন্যদিকে এরপরই রমনা থানা থেকে খেলোয়াড়দের নিয়ে যাওয়া হয় শাহবাগের পুলিশ কন্ট্রোলরুমে। সেখানে তাদের পাশাপাশি অনেক সমর্থকও আটক ছিলো।

পরিস্থিতি খারাপ দেখে শ্রীলংকান খেলোয়াড়দের তাদের দূতাবাসের লোকজন এসে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। মিন্টো রোডের মার্শাল কোর্টে অনেকটা নীরবেই বাকিদের একটা কাঠগড়ায় দাড় করানো হয়। ঠিক বিপরীতের কাঠগড়ায় দাড়ানো রেফারি আবদুল আজিজ এবং দুই লাইন্সম্যান। রেফারি আজিজ খেলোয়াড়দের দোষী সাব্যস্ত করে বললেন, ‘স্যার ওরা আমাকে মেরেছে পাশাপাশি ওরা সাপোর্টারদের উসকে দিয়েছে গন্ডগোল করার জন্য।’

যদিও খেলোয়াড়রা এই বক্তব্য ভুল বলে সেই সময়ই জানায়। রেফারি আবদুল আজিজ আঙুল উচিঁয়ে দেখিয়ে দেয় কাজী মো: সালাউদ্দিন, আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু, কাজী আনোয়ার এবং গোলম রাব্বানী হেলালকে। তার দাবি এরাই মাঠে গন্ডগোল বাঁধিয়ে সেটি বাইরে ছড়িয়েছে। এরপর আনোয়ারকে এক বছর, হেলালকে ছয় মাস এবং সালাউদ্দিন ও চুন্নুকে একমাস করে জেল দেয় কোর্ট। অকস্মাৎ এই সিদ্বান্তে খেলোয়াড়রা ভেঙে পড়ে এজলাসেই কাঁদতে শুরু করেন। হয়তো এমনটি হবে তা তারা ঘুর্নাক্ষরেও চিন্তা করতে পারেননি।

অনেকটা তড়িঘরি করে সেদিন রাত দেড়টার দিকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেখানেই দুই রাত কাটানোর পর তাদেরকে নতুন করে তালিকাভুক্ত করা হয়। সেদিন তাদের জানানো হয় নিরাপত্তার জন্য তাদেরকে দ্রæতই অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হবে। চুন্নু এবং সালাউদ্দিনকে যশোর এবং আনোয়ার ও হেলালকে রাজশাহী কারাগারে স্থানান্তর করার সিদ্বান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়বে। সেদিন রাত ১০টার পর ট্রেন ও রিক্সায় করে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় কমলাপুর স্টেশনে।

সেই সময় পনের হাজারেরও বেশি দর্শক-সমর্থক জড়ো হয়ে যায় কমলাপুর স্টেশনে। সেখানেই ফটো সাংবাদিক মোহাম্মদ আলম তোলেন চারজনের হাতকড়া পরা সেই বিখ্যাত আর ঐতিহাসিক ছবিটি। পরদিন ছবিটি ইত্তেফাক পত্রিকায় ছাপা হলে চারিদিক থেকে নিন্দা আর ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। আর ঐ ছবি পত্রিকায় প্রকাশের পর আরো সাংঘাতিক হয়ে উঠে পরিস্থিতি। ১৭ দিন পর সর্ব মহলের আন্দোলনের মুখে চার খেলোয়াড়কেই ছাড়তে বাধ্য হয় তৎকালীন সামরিক সরকার।

যশোর থেকে চুন্নু ও সালাউদ্দিনকে নিয়ে রাজশাহী গিয়ে আনোয়ার ও হেলালকে নিয়ে পরদিন ঢাকা ফেরেন আবাহনী কর্মকর্তারা। সে সময় ফুটবল উন্মাদনার দিক দিয়ে দেখলে সেটি দারুণ একটা সময় ছিল বলতে হবে। কাজী সালাউদ্দিনের মতো তারকা তখনো মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, আশরাফউদ্দিন চুন্নুর মতো উইঙ্গার পেয়ে গেছে বাংলাদেশের ফুটবল। যা অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল জনপ্রিয় খেলাটিকে।

পাশাপাশি খুরশিদ বাবুল, আশীষ ভদ্র, মোহাম্মদ মহসিন, আনোয়ারুল হক হেলাল, আনোয়ার গোসেনের মতো ফুটবলাররাও সারা দেশে তখন নায়কের আসনে। সেই নায়কদেরই রাস্তায় হাতকড়া পরিয়ে ঘোরানো, সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে জেলে ছুড়ে ফেলা যেন ফুটবলকে কলঙ্কিত করাই নামান্তর! প্রায় চার দশক আগে আবাহনী-মোহামেডানের একটি ম্যাচকে কেন্দ্র করে শহরে আগুন জ্বলেছিল, তার বলি হয়েছিলেন ফুটবলাররা। রাজনীতিতে ক্ষমতা দখল করে স্বৈরশাসক এরশাদ ক্ষমতা নিয়েই মার্শাল ল জারি করেছেন।

যে ফুটবলাররা তখন সাধারণ মানুষের সব আনন্দ, উত্তেজনার উৎস, তাদের আদর্শ আর নায়ক, সেই ফুটবলারদের হাতে হাতকড়া পরিয়ে, তাঁদের জেলে পুরে এরশাদ জনগণকে ভয় পাইয়ে দিতে চেয়েছিল। এটা ছিল স্রেফ তাঁর স্টান্টবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। সেদিনের ঘটনার বর্ননা দিতে গিয়ে গোলাম রব্বানী হেলাল বলেছিলেন, ’ওদেরই যখন এই অবস্থা, আমরা আর কী করব! সেই সময় চার্জশিটের কথাগুলো আমার পরিষ্কার মনে আছে, মাঠের ঘটনাটাকে বলা হয়েছিল ’বর্তমান সরকার উৎখাতের প্রথম পদক্ষেপ।’

এই ঘটনার বিষয়ে গুঞ্জন আছে অনেকটা এরকম, ১৯৮২ সালের এশিয়া কাপে মনোয়ার হোসেন নান্নুকে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়াটা আবাহনীর খেলোয়াড়রা মেনে নেননি বলে তৎকালীন ক্রীড়া পরিষদ চেয়ারম্যান এরশাদ তাঁর শোধ তুলেছিলেন চার ফুটবলারকে জেলে পাঠিয়ে।

কেউ কেউ তখনকার বাফুফে সাধারণ সম্পাদক মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদকেও দায়ী করেন দেশের ফুটবলের এ কলঙ্কের জন্য। এর মাধ্যমে আবাহনী ক্লাব ও খেলোয়াড়দের প্রতি তাঁর বিদ্বেষের প্রকাশ ঘটিয়েছেন বলে জোর গুঞ্জন রয়েছে। কারণ যা-ই হোক, ইতিহাসের পাতা থেকে এ কলঙ্কের দাগ আর কোনভাবেই মোছা যাবে না। ২১ সেপ্টেম্বর এলেই এক টুকরো কলঙ্কের মেঘ দেশের ফুটবলের আকাশে-বাতাসে উড়ে বেড়ায়।

যদিও পরে সবকিছুই স্বাভাবিক হয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে ফুটবলার হিসেবে কাজী সালাহউদ্দিন অবসর নিলে প্রেসিডেন্ট এরশাদ তাকে বঙ্গভবনে রাজকীয় মর্যাদায় লালগালিচা সংবর্ধনা দিয়েছিলেন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...