বিশ্বকাপের আগে তিনি যখন দল নিয়ে ভারতে যান, তখন ওয়ানডেতে তার নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা স্রেফ দুই ম্যাচের। হ্যাঁ, ভুল পড়ছেন না। মাত্র দুটি ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়াকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। সেই ম্যাচ দুটিও ছিল এক বছর আগে।
বিশ্বকাপের ঠিক আগে ভারতে ওয়ানডে সিরিজে আরও দুটি ম্যাচে নেতৃত্ব দিলেন। মানে, বিশ্বকাপ শুরুর সময় অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়কের অভিজ্ঞতা স্রেফ চার ম্যাচের।
অস্ট্রেলিয়ার মতো একটা ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের জন্য এটা একরকম অবিশ্বাস্য। সেই ১৯৭৯ বিশ্বকাপে কিম হিউজের ওয়ানডে অভিষেক হয়েছিল অস্ট্রেলিয়াকে নেতৃত্ব দিয়ে। সেটা বিশেষ পরিস্থিতির জন্য। এছাড়া এরকম ঘটনা অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে বিরল। এই আধুনিক যুগে এসে তো একরকম অকল্পনীয়।
কিন্তু এবারও পরিস্থিতিটা অনেকটা বিশেষ কিছুই হয়ে গিয়েছিল। গত বছরের সেপ্টেম্বরে অ্যারন ফিঞ্চ ওয়ানডে ক্রিকেটকে বিদায় বললেন। বিশ্বকাপের বাকি তখন মোটে এক বছর। এই সময়ে আর নতুন কাউকে অধিনায়ক করার ঝুঁকি নেয়নি অস্ট্রেলিয়া। টেস্ট অধিনায়কের কাঁধেই বাড়তি দায়িত্ব দেওয়া হয়, অনেকটা বাধ্য হয়েই।
তাঁর টেস্ট নেতৃত্বের কথাও একটু বলি। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের একনিষ্ট অনুসারী হিসেবে বলতে পারি, তাকে আমার ঠিক প্রথাগত ‘অস্ট্রেলিয়ান স্কিপার’ মনে হতো না। অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়কদের মতো ডাকাবুকো নন, নেতৃত্ব দিয়ে আবিষ্ট করা বা ‘Aura’ বলে যে ব্যাপার, তা নেই বলে মনে হতো।
এমনিতে ক্রিকেটার হিসেবে তাকে ভালো লাগত একদম তার অভিষেক থেকেই। ১৮ বছর বয়সে টেস্ট অভিষেকে ৭ উইকেট নেওয়ার পর ম্যাচের শেষ ইনিংসে ৩১০ রান তাড়ায় প্রচণ্ড স্নায়ুর চাপের মধ্যে ব্যাট হাতে যেভাবে দলকে জিতিয়েছিলেন, তাকে ভালো না বেসে উপায় ছিল না। কিন্তু সেই অভিষেকের পর তিনি টেস্ট খেলতে পারেননি সাড়ে ৫ বছর। ভাবা যায়!
সেই সময়টায় ক্যারিয়ারঘাতী ইনজুরি শঙ্কায় থাকা তরুণ ফাস্ট বোলারকে যেভাবে সামলেছে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট, যেভাবে তার শরীর পোক্ত করে তাকে ফেরানো হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট সিস্টেমের অসাধারণ পেশাদারিত্বের আরেকটি প্রমাণ সেটা।
যাই হোক, সেই কামিন্স পরে দলের মূল পেসার হয়ে উঠলেন। অধিনায়কত্ব পেলেন। সহজাত নেতা তাকে কখনোই সেভাবে মনে হয়নি। কিন্তু কার্যকর অধিনায়ক হওয়ার পথ বের করে নিলেন। দেশের মাঠে অ্যাশেজ জয় দিয়ে নেতৃত্বের অভিযান শুরু করলেন। পাকিস্তানে প্রায় অবিশ্বাস্য এক সিরিজ জিতলেন। আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ বা টেস্টের বিশ্বকাপ জিতে গেলেন।
ইংল্যান্ডের মাঠে অ্যাশেজে বাজবলের চ্যালেঞ্জকে নিজেদের ঘরানা দিয়েই পাল্টা জবাব দিয়ে দলকে ২-০তে এগিয়ে নিলেন। দারুণ ব্যাপার। কিন্তু অ্যাশেজ ধরে রাখলেও শেষ পর্যন্ত সিরিজ জিততে পারলেন না।
অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের সমর্থক হিসেবে আমার মন রাঙাতে শুরু করেছিলেন তিনি, কিন্তু মন ভরাতে পারছিলেন না। টেস্টে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া, ফাস্ট বোলারের শরীরটার যত্ন নেওয়া, চোট-বিশ্রাম-বিরতি, সব মিলিয়ে ওয়ানডে অধিনায়ক হলেও ওয়ানডে খেলাই হয়ে উঠছিল না তার। এজন্যই স্রেফ চার ম্যাচের নেতৃত্বের অভিজ্ঞতায় বিশ্বকাপে পা।
বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচের পর দলটাকে মনে হলো ছন্নছাড়া। কত কত ঘাটতি আর দুর্বলতা যে কতজনের চোখে পড়ল! সেই দলই জয়রথে চেপে সেমি-ফাইনালে পৌঁছে গেল। দলটাকে গুছিয়ে তোলায় তার নিশ্চয়ই বড় কৃতিত্ব ছিল।
কিন্তু আমি তো অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক খুঁজছিলাম! যার নেতৃত্ব আলাদা করে চোখে পড়বে, দলের পারফরস্যান্স আর শরীরী ভাষায় যে নেতৃত্বের ছাপ থাকবে। অস্ট্রেলিয়া দল মানে যতটা তাদের ক্রিকেট সিস্টেমের দল, ততটাই অধিনায়কের দল। অধিনায়কের চরিত্রের প্রভাব পুরোপুরি থাকে দলে। সেটাই পাচ্ছিলাম না।
অ্যালান বোর্ডারের অস্ট্রেলিয়া, মার্ক টেইলরের অস্ট্রেলিয়া, স্টিভ ওয়াহর অস্ট্রেলিয়া, রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়া, মাইকেল ক্লার্কের অস্ট্রেলিয়া, এমনকি স্টিভেন স্মিথের অস্ট্রেলিয়া ছিল। কামিন্সের অস্ট্রেলিয়া বলতে পারছিলাম না। বিশ্বকাপে তার ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সও প্রত্যাশার ধারেকাছে ছিল না। হয়তো এটাও একটা কারণ।
সেমি-ফাইনাল ও ফাইনালে তিনি কষে চাপড় মারলেন যেন। গাল হাতাতে হাতাতে আনন্দময় বিস্ময় নিয়ে দেখলাম অধিনায়ক কাকে বলে। সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং সময়েই সবচেয়ে কঠিন কাজগুলো এত অনায়াসে করলেন তিনি! বোলিং পরিবর্তন, মাঠ সাজানো থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি সিদ্ধান্ত এতটা নিখুঁত।
আপনার মনে হতে পারে ওসব ‘ফাটকা।’ আসলে ফাটকার পেছনেও থাকে টোটকা, ক্রিকেটীয় ভাবনা, মেধা, দূরদর্শিতা আর পরিকল্পনার ফসল। ফাইনালে তিনি যা করলেন, আমার চোখে তা অধিনায়কত্বের মাস্টারক্লাস। যুগে যুগে যে কোনো অধিনায়ক… আবারও বলছি, যে কোনো অধিনায়কের জন্য চিরকালীন উদাহরণ হয়ে থাকবে তা।
একদম টসের সিদ্ধান্ত থেকে শুরু। তিনি যখন ফিল্ডিং নিলেন, অনেকেরই চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। পরে খবর দেখে জানতে পেরেছি, হাজার হাজার মাইল দূরে বসে অ্যালান বোর্ডার মাথা নেড়ে বলছেন, “যত কিছুই হোক, এরকম ফাইনালে কেউ টস জিতে আগে বোলিং করে নাকি!
কিন্তু কামিন্স নিজের কাছে ছিলেন পরিষ্কার। উইকেট প্রথম ইনিংসে একটু মন্থর থাকবে, দ্বিতীয় ইনিংসে শিশির পড়বে, বল দারুণভাবে ব্যাটে আসবে। শুধু কৃত্রিম আলোয় শুরুর কয়েক ওভারের সুইং সামলে নিতে হবে। এই তো।
পরিকল্পনা এক ব্যাপার, বাস্তবায়ন করা ভিন্ন ব্যাপার। আগে বোলিং নেওয়ার পর তাকে এবং তার দলকে অনেক কিছুই ঠিকঠাক করতে হতো। অনেক অনেক কিছু। দিনটি এরকম, প্রায় সবকিছুই তারা পারলেন।
এরকম বড় ম্যাচে চাপের মধ্যে বোলিং পরিবর্তন আর মাঠ সাজানো এতটা নিখুঁত আমি নিকট অতীতে কোনো অধিনায়কের মধ্যে দেখিনি। বিশেষ করে, মাঝের ওভারগুলোয় তার বোলিং পরিবর্তন ছিল অবিশ্বাস্য। বিরাট কোহলি ও লোকেশ রাহুল ১৬ ওভারের বেশি সময় বাউন্ডারি মারতে পারলেন না, পরে রাহুল-জাদেজা-সুরিয়াকুমার টানা ১২ ওভার বাউন্ডারি মারতে পারলেন না – এসব তো আর এমনিই নয়! তারা জুটি গড়ে তুললেও তাদেরকে স্বস্তি পেতে দেননি বা মানসিকভাবে থিতু হতে দেননি অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক, বোলিং পরিবর্তনগুলো এরকমই ছিল।
হ্যাঁ, গোটা দলের ফিল্ডিংও তাতে বড় ভূমিকা রেখেছে। তবে এটা তো অস্ট্রেলিয়ার কাছে প্রত্যাশিতই! আর ফিল্ডিংয়ে বোলার আর ব্যাটসম্যান বুঝে বিভিন্ন পজিশনের অ্যাঙ্গেলগুলো যেভাবে আটকে দিয়েছেন অধিনায়ক, সেটাও একটা মাস্টারক্লাস।
বাকি ছিল নিজের বোলিং। সেরাটা তুলে রেখেছিলেন ফাইনালের জন্য। শ্রেয়াস আইয়ারকে আউট করা অসাধারণ সেই ডেলিভারি – এরপর কোহলির উইকেট। মনে হতে পারে, শরীর থেকে দূরে আলগাভাবে ব্যাট পেতে দিয়ে বল স্টাম্পে টেনে এনেছেন কোহলি। সেটাই সত্যি। তবে এই মন্থর উইকেটে বুক সমান উচ্চতায় বল তোলার যে বাড়তি এফোর্ট, লেংথ একদম ঠিক রাখা, এই কৃতিত্ব তো বোলারের।
সব মিলিয়ে ফাইনালটা ট্রাভিস হেডের ম্যাচ অবশ্যই। তবে অস্ট্রেলিয়ার জয়ের প্রতিটি পরতে পরতে ছিল অধিনায়কের ছাপ। যে অধিনায়ককেই খুঁজছিলাম!
ফাইনালের আগের দিন ১ লাখ ৩২ হাজার দর্শকের চাপ প্রসঙ্গে যখন তিনি বলেছিলেন, ‘এত বড় সংখ্যক দর্শককে চুপ করিয়ে দেওয়ার মতো তৃপ্তিদায়ক কিছু তো আর খেলাধুলায় নেই’ – তখন ভাবছিলাম, এই তো, সত্যিকারের অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়কের মতো কথা। কিন্তু তিনি অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক হতে পারবেন তো? সত্যিই সংশয়টা আমার ছিল, ভীষণরকম ছিল।
কিন্তু ওটা বলে তিনি সম্ভবত নিজেকেও চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তেতে ওঠার তেল ছিল ওটা কিংবা জ্বলে ওঠার বারুদ। তিনি বললেন এবং প্রচণ্ড তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় দিনটায়, প্রচণ্ড চাপের একেকটি মুহূর্তে তা করে দেখালেন। একবার নয়, বার বার।
তিনি অবশ্যই বেনো বা বোর্ডার নন, টেইলর বা ওয়াহ নন, পান্টার-ক্লার্ক নন। তবে তিনি কামিন্স, নেতৃত্বের এই ছোট্ট পথচলায়ই অস্ট্রেলিয়ার সফলতম অধিনায়কদের একজন।
১৯৮৭ বা ১৯৯৯ বিশ্বকাপের শিরোপা জয় অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের চিরায়ত লোকগাঁথার অংশ। এখন সেখানে সগৌরব উপস্থিতি ২০২৩ বিশ্বকাপের। একটু গভীরে গিয়ে, পারিপার্শ্বিকতা ও সব ভেবে এটিকেই সেরা গল্প বললে, আমি হয়তো দ্বিমত খুব একটা করব না। প্যাট্রিক জেমস কামিন্স – অমরত্বের প্রত্যাশা নেই, কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের তাড়না আছে।
– ফেসবুক থেকে