সোনালী অতীত! সুন্দর! বড্ড সুন্দর!

টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া গর্জে উঠেছিলো; গর্জে উঠেছিলো দক্ষিণ আফ্রিকার পচেফস্ট্রমের সবুজ গালিচা। লাল – সবুজের দেশে উঠেছিলো খুশির জোয়ার। কোটি বাংলাদেশ ভক্তের চোখ বেয়ে পড়েছিলো অশ্রু; বিজয়ের অশ্রু। ১৯ এর হাত ধরে সেদিন রচিত হয়েছিলো ২০ এ বিশ্বজয়ের গল্প। আহ; সোনালী অতীত! সুন্দর; বড্ড সুন্দর।

১৯৯৭ এর আইসিসি ট্রফি, ১৯৯৯ এ পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়, ২০০৭ সালে বিশ্বকাপের মঞ্চে দক্ষিণ আফ্রিকা-ভারতের বিপক্ষে জয়, ঘরের মাঠে ইংল্যান্ড বধ, ২০১৫ বিশ্বকাপে সেরা সাফল্য বলেন আর ঘরের মাঠে পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশ বলেন। সবকিছু ছাপিয়ে সেদিন সেরা সাফল্য পেয়েছিলো বাংলাদেশ। সাফল্য পেয়েছিলো ওরা ১১ জন। ওরা জিতেছিলো স্বপ্নের সোনালী ট্রফি।

২০১৯ সালে এশিয়া কাপের ফাইনালে হার, হারের ক্ষত যে কতোটা কঠিন করে তুলেছিলো টগবগে যুবকদের সেটির দেখা মিলেছিলো ২০২০ আইসিসি বিশ্বকাপে। একটি হার যুবাদের কতো কঠিন করে তুলেছিলো তা দেখেছিলো ক্রিকেট বিশ্ব। ভারতের চোখে চোখ রেখে কথা বলা, আক্রমণাত্মক ভঙ্গি বলেন আর এগ্রেশন সবকিছুতেই যেনো নজর কেড়ে নিয়েছিলো শরিফুল-সাকিবরা। জয়- হৃদয়দের দূর্দান্ত ফিল্ডিংয়ে আরো একবার মুগ্ধ বাংলাদেশী সমর্থকরা।

প্রায় ২ বছরের বেশী সময় ধরে গড়ে উঠা দলটি যে এতোটা ভয়ংকর হয়ে উঠেছে তা হয়তো এশিয়া কাপ জয়ী ভারত স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। যেই বাংলাদেশ ভারতের বিপক্ষে চোখ তুলে কথা বলার সাহস দেখাতে পারতো না সেই বাংলাদেশ এখন মুখে আঙুল দিয়ে চুপে যেতে বলে সেই ভারতকে। এর থেকে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে? শরিফুল-সাকিবদের দূর্দান্ত এগ্রেশন কি এর আগে কখনো দেখেছিলো ক্রিকেটবিশ্ব? সবকিছুর উত্তর দিতে গেলে লিখতে হবে উপন্যাস, ঘাঁটতে হবে ইতিহাস। কিন্তু সেই ইতিহাস ঘেঁটে দেখলেই বা কি পেতাম! যুবারা যে ততোক্ষণে নতুন করে ইতিহাসের সৃষ্টি করেছিলো। আজ না হয় এক বছর আগের গড়া সেই নতুন ইতিহাস দেখেই কাটিয়ে দিই!

৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, স্বপ্নের ফাইনালে টস জিতে ফিল্ডিং নিয়ে চমকে দিয়েছিলেন আকবর আলী। ফাইনাল ম্যাচে টস জিতে ফিল্ডিং! অবাক হলেও এটাই ছিলো ভারতকে আটকে রাখার প্রথম কৌশল। কেননা এই ভারত রান তাড়ায় ছিলো বেশ পটু। তাইতো শুরুতেই পিছিয়ে দিয়ে ম্যাচ এগিয়ে যাবার জন্য মারিয়া বাংলাদেশের শুরুর আক্রমণটা ছিলো ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো।

টুর্নামেন্টে দূর্দান্ত খেলে যাওয়া জেসওয়ালের সামনে পড়েছিলো তরুণ পেসার শরিফুল! দূর্দান্ত বোলিংয়ের সাথে এগ্রেশন গুলো বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় সেই স্মৃতিতে।শরিফুলের সাথে সাকিব যেনো হয়ে উঠেছিলেন ভয়ংকর। ধারণ করেছিলেন রূঢ়মূর্তি, ঝাপিয়ে পড়েছিলেন জেসওয়াল-সাক্সেনার উপর। একেকটি বল ছুটে যাচ্ছিলো বুলেট গতিতে। বুলেট গতির বলগুলো ভালোভাবেই সামলে নিচ্ছিলেন তারা, কিন্তু শরিফুল – সাকিবের আগুনে এগ্রেশন তাদের মনে ধরিয়ে দিয়েছিলো কাঁপন; ভয়ংকর কাঁপন।

আগুনে বোলিংয়ে সাফল্য এসেছিলো অভিষেকের হাত ধরে। ফাইনালে সুযোগ পেয়ে নিজেকে চিনিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেদিন সাক্সেনাকে ক্যাচে পরিণত করে সাফল্য এনে দিয়েছিলেন আকবর বাহিনীকে। সাফল্যের খাতায় অভিষেকও নিজের নামটি লিখে ফেলেছিলেন ততক্ষণে!

এরপর রকিবুল, সাকিব, হৃদয়দের ইকোনমিক বোলিংয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানোর সুযোগ না পেলেও দলকে ভালোভাবেই এগিয়ে নিচ্ছিলেন সাবলীল খেলে যাওয়া জেসওয়াল। কিন্তু আগুনে এগ্রেশনে কতক্ষণই বা সাবলীল থাকতে পেরেছিলেন তারা? বেশিক্ষণ না। ব্যক্তিগত ৮৮ রানে জেসওয়ালকে পকেটে পুড়ে আগুনে বোলিংয়ের নতুন শুরু করেছিলেন শরিফুল।

এরপর সবদিক থেকে বুলেট গতিতে ছুটে আসছিলো একেকটি আগুনের গোলা। যেটির সামনে মাথা তুলে দাঁড়ানোর শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলো ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা। আর শক্তি পাবেই বা কি করে? এগ্রেশনের সাথে একেকটি সেলিব্রেশন যেনো নতুন বাংলাদেশের জন্ম দিচ্ছিলো সেদিন। চোখে চোখ রাঙ্গিয়ে ভারতীয়দের পকেটে পুড়ে ঘায়েল করছিলো শরিফুল-সাকিব-অভিষেকরা!

যেই ভারত স্বপ্ন দেখছিলো ২০০+ রান করার। সেই ভারতের শিবিরে একের পর এক পেরেক ঠুকিয়ে ১৭৭ এ আটকে রাখা তো কোন অংশেই কম ছিলোনা। কম ছিলোনা আকবরের ঠান্ডা মাথার ক্যাপ্টেন্সিরও!

বিশ্বজয় করতে বাংলাদেশের সামনে লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ১৭৮ রানের। পতিপক্ষ ভারত বলেই ভয়টা ছিলো একটু বেশিই। শরিফুল-সাকিবদের আগুনে অ্যাগ্রেশন কি ভুলে গিয়েছিলো কার্তিক – আকাশরা? রকিবুলের সেলিব্রেশন কি ভুলে গিয়েছিলো রাভি বিষ্ণই! উত্তর এলো ‘না’? ঠিক সেই মূহুর্তে অন্যরকম একটা ভয় কাজ করছিলো সবার মাঝে। কিন্তু দূর্দান্ত বাংলাদেশ কি ছেড়ে কথা বলেছিলো সেদিন? তামিম- ইমন- জয়-হৃদয়রা কি হাত গুটিয়ে বসে ছিলো? আকবর আলী-শামীমরা মুখ বন্ধ করে চুপচাপ ভারতীয় বোলারদের তাণ্ডব দেখেছিলো? উত্তরে ভেসে এসেছিলো বিজয়ের হাসি।

শুরুটা হয়ছিলো ভারতীয় বোলারদের চোখে চোখ রেখে লড়াই করে যুদ্ধে জয়ী সেনাদের মতোই। ৫০ রানের উড়ন্ত সূচনার পর ঘটেছিলো তামিমের বিদায়! ঐ যে বলেছিলাম রাভি বিষ্ণই কি রকিবুলের সেলিব্রেশন ভুলে যাবে! যায়নি, তাইতো তামিমকে নিজের প্রথম শিকারে পরিণত করে টাইগার শিবিরে প্রথম পেরেক ঠুকিয়ে দিলেন। এতেই কি শেষ? না, ৫০/০ থেকে ৫০/১ এরপর, ১৪ রানের মাঝে ৪ ব্যাটসম্যান সাজঘরে। পুরো সিরিজে দারুণ খেলে আসা জয়-হৃদয় ফাইনালে ছিলেন সুপার ফ্লপ। ততোক্ষণে সব আলো কেড়ে নিয়েছিলো গুগলি বোলার রাভি বিষ্ণয়!

কিন্তু এরপর যা হয়েছিলো তা কি মেনে নেওয়ার মতো ছিলো? না ছিলোনা। কথায় আছে বিপদ আসলে না কি চারদিক থেকে তেড়ে আসে। সেটিরই পুনরাবৃত্তি ঘটেছিলো টাইগার শিবিরে। দলকে বিপদের মুখে ফেলে রিটায়ার্ড আউট হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন ইনফর্ম ইমন। ভয়টা যে তখন ঘিরে নিয়েছিলো বাংলাদেশের কোটি সমর্থকদের। কিন্তু….

সেদিন আমাদের যে একজন আকবর ছিলেন; ছিলেন বাংলাদেশের রক্ষক হিসেবে। এই মানুষটি বিপদের মুখে দলকে রক্ষা করেছেন বহুবার। সেদিও পেরেছিলেন, তবে! সেদিন আকবর একা ছিলেন না; সাথে ছিলো কোটি ভক্তের থেকে পাওয়া সাহস।

মাঝপথে ভেঙে পড়া দলটিকে টেনে তুলতে শামীমকে সাথে পেয়েছিলেন কাপ্তান আকবর। লম্বা রেসে পা দিয়েছিলেন শামীম-আকবর। কিন্তু, লম্বা রাস্তায় পাড়ি দিতে গিয়ে খেয় হারিয়ে ফেলেছিলেন শামীম। দলকে আরো একবার বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশের সংগ্রহ তখন ৮৫/৫!! এরপর দলীয় ১০২ রানে অভিষেক ফিরে গেলে বাংলাদেশের ভক্তরা আরো একটি ফাইনাল হারের তীক্ষ্ণ স্বাদ গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু কথায় আছে।

ভাগ্য সবসময় সাহসীদের পক্ষে থাকে!

এই কথাটার বাস্তব প্রমাণ হয়ে এসেছিলেন ইনজুরিতে থাকা ইমন। তাকে বীরের বেশে দেখতে মুখিয়ে ছিলো পুরো ক্রিকেটবিশ্ব। তিনি কি পেরেছিলেন? হ্যাঁ। আচ্ছা, যাদের মনে সাহস থাকে তারা কি হেরে যেতে পারে? না পারেনা। তাইতো আকবরকে সাথে নিয়ে আঘাত প্রাপ্ত সেনার মতো জ্বলে উঠেছিলেন ইমন। আকবরকে সাথে নিয়ে গড়েছিলেন ৪১ রানের গেম চেইঞ্জিং জুটি। এরপর যা হলো সেটা শুধু আকবরকে নিয়েই। ইতিহাস যে ডাকছিলো আকবরকে।

ক্যাপ্টেনের কাঁধে ছিলো গুরু দায়িত্ব! পেরেছিলেন কি আকবর? হ্যাঁ, দিনশেষে পেরেছিলেন আকবর। এশিয়া কাপে ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে হেরে গিয়ে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠেছিলেন আকবর! যার বাস্তব প্রমাণ দেখিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বকাপের ফাইনালে। কি দূর্দান্ত ব্যাটিং; আহ টাইমিং! আর দূর্দান্ত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে দলকে কিভাবে এগিয়ে নিতে হয় তা হয়তো আকবরকে দেখলেই বোঝা যাবে।

রকিবুল-আকবর যখন ঠান্ডা মাথায় দলকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন তখন বৃষ্টি দিয়েছিলো হানা। ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলো সবার মাঝে। তাহলে কি আরো একবার খুব কাছে গিয়ে হারতে হয়েছিলো? আরো একবার ‘আমরা এইসবে অভস্ত্য’ লিখে স্ট্যাটাস দিতে হয়েছিলো? নাকি বীরের বেশে একটি জয় উদযাপন করেছিলাম আমরা? উত্তর গুলো জানতে থাকি।

বৃষ্টি বাঁধাই বাংলাদেশ তখনো ছিলো এগিয়ে। খেলা না গড়ালে জিতবে ১৮ রানে, কিন্তু হঠাৎ করে বৃষ্টি থেমেছিলো; বাংলাদেশের সামনে লক্ষ্য দাঁড়িয়েছিলো ৩০ বলে ৭ রানের! এ যেনো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো।

বৃষ্টির পর মাঠে নেমেই বাউন্ডারি এসেছিলো রকিবুলের ব্যাটে। বাংলাদেশের কোটি ভক্ত তখন উদযাপনের অপেক্ষায় নিজেদের প্রস্তুত করছিলেন। এরপর দৌড়ে এক রান নিতেই বাধভাঙা উল্লাসে ভরে গেলো পুরো মাঠ। চারদিক থেকে আওয়াজ আসছিলো বাংলাদেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ বলে!

ততোক্ষণে বাংলাদেশ ভরে গেছে আনন্দের মিছিলে। যেই মা বাবা সন্তানদের খেলার জন্য বকা দিতেন সেদিন তারা হয়েছিলো চ্যাম্পিয়ন মা-বাবা। যেই শিক্ষক গুলো খেলার জন্য বকা দিতেন ছাত্রদের সেদিন থেকে তারাও বুক চিতিয়ে বলতে পেরেছে তৌহিদ -আকবরদের শিক্ষক আমি; আমি একজন চ্যাম্পিয়নকে গড়ে তোলার কারিগর! মাঠে খেলতে না দেওয়া মানুষগুলোও হয়তো সেদিন আড়ালে বসে আফসোস করে বলেছিলো – ‘এসো আকবর – হৃদয়; তোমরা আমার জায়গাটা রঙিন করে যাও!’

তিলে তিলে গড়ে উঠা দলটি যখন আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলো, তখন এই দলকটাকে নিয়ে আনন্দে মেতে উঠেছিলো পুরো ক্রিকেটবিশ্ব! ক্রিকেটবোদ্ধাও সেদিন গুণগান গেয়েছিলো আকবর-হৃদয়দের। দিনশেষে যেই মানুষ গুলোর জন্য আমরা হয়েছিলাম চ্যাম্পিয়ন তাদের জানাই লাখো সালাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link