বেনজেমা যখন আমার ক্লাবে আসেন, আমার সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারের বয়স তখন মোটে মাস দুয়েক। সূর্যসেন হলে থাকি। জীবন, পেশা কিছু নিয়েই খুব সিরিয়াস নই।
আজ আমার ক্লাবে বেনজেমার শেষ দিন। সাংবাদিকতা শুরুর আগের দিনও জানতাম না, এটিই হবে আমার পেশা। এখন এই পেশায় ১৪ বছরের বেশি কাটিয়ে দিলাম। আমার ৯ বছর বয়সী ছেলে রাজপুত্তুর এখন বেনজেমার জার্সি গায়ে চাপিয়ে ফুটবল খেলতে যায়। বেনজেমার ক্লাব ছাড়ার খবরে তার মন ভার হয়ে যায়। আমার মেয়ে আড়াই বছর বয়সী মেয়ে রাজকন্যা কিছু না বুঝলেও ভাইয়ের সঙ্গে আধো আধো বোলে কণ্ঠ মেলায়, ‘asi asi asi, gana el madrid…’।
এই ১৪ বছরে আপনার জীবনও নানা মোড় পেরিয়ে গেছে। আপনার চারপাশ বদলে গেছে। অনেক চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে। বাস্তবতার নানা রঙ দেখে ফেলেছেন। কখনও তাতে নিজেকে রাঙিয়ে উঠেছেন। কখনও বর্ণহীন সময়ের সঙ্গে লড়াই করেছেন রঙিন প্রহরের আশায়। ঠিক বেনজেমার মতোই। এই এতগুলো বছরে কখনও আড়ালেই সুখ খুঁজেছেন। কখনও আপনিই হয়ে উঠেছেন অনেকের সুখের উৎস। আপনার পরিবারে, আপনার সমাজে, আপনার ক্যারিয়ারে জীবনে।
আমরা বেনজেমার সঙ্গেই বেড়ে উঠেছি… হাসি-কান্নায়, আক্ষেপ-পূর্ণতায়। তার সঙ্গে আমাদের, মানে রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদের সম্পর্কটা ছিল অদ্ভুত। আমরা তার ওপর রেগেছে। ক্ষেপেছি। চটেছি। ফুঁসেছি। আবার তাকে দেখে হেসেছি। ভালোবেসেছি। আপন করে নিয়েছি।
হ্যাঁ, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এটিই। তিনি আমাদের খুব আপন। একান্ত নিজস্ব কিছু।
তার প্রতি আমাদের হতাশাতেও মিশে ছিল আশার রেশ। আমাদের বিতৃষ্ণায় ছিল আকাঙ্ক্ষার প্রবল তেষ্টা। তাকে নিয়ে আমাদের দীর্ঘশ্বাসেও ছিল ভালোবাসার সুর।
তিনি নিশ্চয়ই এই ক্লাবের ভাষা বুঝতেন। আবেগটুকু অনুভব করতেন। তাই পড়ে থেকেছেন। আঁকড়ে রেখেছেন। লড়াই করেছেন। সুসময় আদায় করে নিয়েছেন। কিংবদন্তি হয়ে উঠেছেন।
তিনি নিশ্চিত করেছেন, একজন ডি স্টেফানো, একজন জেন্তো… রাউল, জিজু, হিয়েরো, কাসিয়াস, রামোস.. একজন ক্রিস্তিয়ানোর মতোই এই ক্লাবের ইতিহাস-অস্তিত্বে তিনি মিশে থাকবেন, দীপ্তিময় দিশা হয়ে থাকবেন।
তাকে সবচেয়ে ভালো বুঝতেন বুঝি জিজুই। সেই কবে তিনি বলেছিলেন, ‘বেনজেমা কি শুধুই নম্বর নাইন? সে তা পরিপূর্ণ ফুটবলার…!’ আমাদের মহানায়কের সেই কথাকে আমরা অনেকে তখন সংশয় আর উপহাসের ভ্রুকূটিতে বিদ্ধ করেছি। আমরা পাদপ্রদীপের আলোতেই চোখ রাখি। আমরা চোখ ধাঁধানো বিস্ময়ে তারকা দেখি। আড়াল থেকে সেই তারকাদের জ্বালানির উৎসদের নিয়ে ভাবতে বয়েই গেছে!
কিন্তু জিজু বা অন্য কোচরা রত্ন চিনতেন। তাই যত্ন করতে ভুল করেননি।
শুধু কি আমাদেরই বোঝার ভুল? বেনজেমা তো সত্যিকার অর্থেও হতাশ কম করেননি। আমাদের চেয়েও বেশি হতাশ ছিলেন নিশ্চয়ই তিনি নিজে। আগুনে পুড়ে তাই খাঁটি হয়েছেন।
ক্রিস্তিয়ানো চলে যাওয়ার পর বেনজেমা খুব শান্ত কণ্ঠেই বলেছিলেন, ‘দায়িত্ব এখন আমার..।’ আমরা ভরসা করতে পারিনি, আশা করেছি শুধু। তিনি কথাকে কাজে রূপ দিয়েছেন আমাদের আনন্দময় বিস্ময় হয়ে। আমাদের প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, স্বপ্নের রঙ কত সুন্দর।
এই যে আমার ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোল, সবচেয়ে বেশি ট্রফি, সবচেয়ে বেশি অ্যাসিস্ট, গৌরবে আর সৌরভে ঝলমল আরও সংব সংখ্যা, এসব হয়ত যুগ যুগ ধরে স্বাক্ষ্য দেবে তার হয়ে। তবে আমরা যারা এই ১৪ বছরে ভ্রমণে তার সঙ্গী ছিলাম, আমরা জানি, তার ক্যারিয়ারটা আরও বেশি কিছু। বেনজেমা মানে হার না মানা মানসিকতা। হাল না ছাড়া। ক্লাবকে হৃদয়ে ধারণ করা। সব ধরনের ইগো, ব্যক্তি ভাবনাকে পাশে সরিয়ে ক্লাবের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া।
বেনজেমা মানে সেই ভাঙা আঙুলের ব্যান্ডেজ। গত সাড়ে তিন বছর ধরে প্রতিটি ম্যাচে ওই ব্যান্ডেজ জানিয়ে দেয়, বেনজেমা মানে নিবেদন, একদম নিখাদ, অটুট, শতভাগের বেশি।
তিনি এই ক্লাব থেকেই অবসরে যেতে চেয়েছিলেন। আমরাও চেয়েছিলাম এখানেই তিনি থাকবেন। তবে আমার ক্লাব তো বিদায়ী বিবৃতিতে একদম নিখুঁত ভাবেই বলে দিয়েছে, ‘রিয়াল মাদ্রিদে বেনজেমার ক্যারিয়ার সদাচারণ ও পেশাদারিত্বের উজ্জ্বল উদাহরণ। ক্লাবের মূল্যবোধকে সে সব সময় প্রতিনিধিত্ব করেছে। নিজের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকার সে অর্জন করে নিয়েছে…’
অবশ্যই এবং অবশ্যই তিনি তা অর্জন করেছেন। যুগে যুগে এভাবে অনেককেই যেতে হয়েছে। যিনি হয়ে উঠেছিলেন ক্লাবের প্রতীক, সেই রাউল থেকে শুরু করে আরও অনেকে, যাদেরকে ছাড়া রিয়ালকে কখনও চিন্তাও করতে পারতাম না, তারাও অনেকে গিয়েছেন। যেতে হয়। সম্পর্ক, সুখস্মৃতি আর উষ্ণতা রয়ে যায়।
কিছু ভালোবাসা হারিয়ে যায় নীরবে, নিঃশব্দে। কিছু রয়ে যায় তরতাজা হয়ে। আজ বেনজেমা যেমন বলেছেন, ‘আমি সব সময়ই রিয়ালের খেলা দেখব ও সমর্থন করব।’ আমার ক্লাব, আমরাও বেনজেমার প্রতি চিরঋণী থাকব।
– ফেসবুক থেকে