গ্রেটনেসের মহামিলন

ব্যোমকেশ এর সীমন্ত হীরা গল্পে অজিত যখন প্রশ্ন করে যে – ব্যোমকেশ কিভাবে নিশ্চিত হল যে ওই প্লাস্টার অফ প্যারিসের মূর্তির ভিতরেই হীরেটা আছে? যদি না থাকতো? তখন ব্যোমকেশ উত্তর দিয়েছিল – তাহলে বুঝতাম পৃথিবীতে সত্য বলে কোনো বস্তু নেই। একেকটা এমন সময় আসে। যখন মনে হয়, এটাই ভবিতব্য। ডেস্টিনি।

এবারের বিশ্বকাপ মেসির হাতে ওঠাও যেন এমনই ভবিতব্য ছিল। ক্লাব ফুটবল, ব্যক্তিগত অর্জন, কোপা আমেরিকা সব হয়ে গিয়েও অধরা থেকে গেছিল সবচেয়ে দামী ট্রফিটাই! বিশ্বকাপ।

বিশ্বকাপ না জিততে পারেননি মানে পেলে, ম্যারাডোনা, জিদান রোনালদোর সাথে এক পংক্তিতে বসতে পারবেন না, সে যতই বড় ফুটবলার হন। ক্রুয়েফ, জিকো, ইউসেবিও, ফিগো বা ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোদের সঙ্গেই তাঁর নাম উচ্চারিত হবে। দুরন্ত ফুটবলার কিন্তু কোনোদিন বিশ্বকাপ জেতেননি।

কিন্তু, মেসির হাতে বিশ্বকাপ না ওঠা আর শচীন টেন্ডুলকারের হাতে ক্রিকেট বিশ্বকাপ না ওঠা হয়তো সমার্থক হয়ে যেত ক্রীড়া প্রেমীদের কাছে, যেখানে কাপ না পাওয়া – খেলোয়াড়ের থেকে কাপের গরিমা ক্ষুণ্ণ করে বেশি!। প্রথমেই পেনাল্টি থেকে গোল করে এবং তারপরে ছোট্ট পায়ের কাজে প্রতি আক্রমণ থেকে দ্বিতীয় গোল পেয়ে মেসি এবং আর্জেন্টিনা ৯০ মিনিটেই ’৯৮ এর পরে সবচেয়ে একপেশে ফাইনাল জিতবে বলে মনে হয়েছিল।

কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে এলেন প্রথমার্ধে গা-ও না ঘামাতে পারা কিলিয়ান এমবাপ্পে। মেসি রোনালদো উত্তর যুগে যিনি ফুটবল দুনিয়া মাতাবেন বলে সকলেই এক প্রকার নিশ্চিত। দেড় মিনিটের মধ্যে দু গোল করে মেসির পার্টি নষ্ট করেই ছাড়বেন এমন ইঙ্গিত দিয়ে ম্যাচ নিয়ে গেলেন অতিরিক্ত সময়ে।

মেসি আবারও সুযোগ পেলেন, তাঁর মত প্লেয়ার জীবনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের এত কাছে এসে গোল মিস করবেন না, করেনওনি। কিন্তু হার না মানা নাছোড় মনোভাব দেখিয়ে ফ্রান্স প্রতি আক্রমণ থেকে পেনাল্টি আদায় করে ছাড়লো এবং আবার পেনাল্টি থেকে গোল করে ম্যাচ টাইব্রেকারে নিয়ে গেলেন কিলিয়ান এমবাপ্পে।

কিন্তু ঐ যে, ডেস্টিনি। আজকে তো কাপ মেসির হাতেই ওঠার ছিল। তাই মার্টিনেজ দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন অতিরিক্ত সময়ের শেষ মিনিটে, যখন নিশ্চিত গোল না বাঁচালে বিশ্বকাপ ওখানেই প্যারিস রওনা হত পরপর দ্বিতীয় বারের মত। টাইব্রেকারে আবার বাঁচালেন আরেকটা শট, ফ্রান্সও মারলো আরেকটা বাইরে। আর্জেন্টিনা কোনো মিস করল না।

কিন্তু পেনাল্টি শুট আউটেও মিস করলেন না এমবাপ্পে এবং মেসিও! তাঁরা তো আজকে কোনো ভুল করতে পারতেন না। ফুটবল দেবতা আজকে প্রবীণ ও নবীন দুই বিশ্বসেরার মহারণ দেখতে চেয়েছিলেন। আর আমরাও দুচোখ ভরে দেখে নিলাম সেই তুল্যমূল্য লড়াই।

২০১১ বিশ্বকাপ ফাইনালে অসাধারণ সেঞ্চুরি করেও বিজিত দলের সদস্য হিসেবে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল মাহেলা জয়বর্ধনে কে। আজ পর্যন্ত এটিই একমাত্র উদাহরণ, ফাইনালে সেঞ্চুরি করেও হারার। এমবাপ্পে হ্যাটট্রিক করেও পরাজিত দলের সদস্য হিসেবে মাঠ ছাড়লেন; গোল্ডেন বুট তাঁর সেই হতাশায় প্রলেপ দিতে পারেনি। ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাসে এটিই একমাত্র উদাহরণ হয়ে থাকল এখনও অবধি।

মেসি বিশ্বসেরা হয়েই শেষ করলেন। এমবাপ্পে আগেই বিশ্বসেরা হয়েছেন। কিন্তু তাঁর লড়াই ফুটবলের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। ভবিষ্যতে তিনি আবার বিশ্বকাপ জিতবেন কিনা সময় বলবে, কিন্তু আগামী দশক জুড়ে তিনি আমাদের মাতিয়ে রাখবেন, তাতে বোধ হয় খুব একটা সন্দেহ নেই।

মেসি অবসর নেবার পরে তাঁকে আমরা মিস করবো; তবে পরবর্তী প্রজন্ম কিন্তু এসে গেছে। এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান। ফ্রান্স হেরেছে, এমবাপ্পে হেরেছেন, কিন্তু তাঁর মাথা উঁচুই থাকবে, আপামর ফুটবলপ্রেমীর হৃদয়ে তাঁর এই পারফরম্যান্স থেকে যাবে চিরকাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link