দেশদ্রোহী বলতে পারেন, কিন্তু…

সেই কোন ছেলেবেলায় ঠাকুমা গল্প বলতেন, সন্ধ্যে বাড়লে চাঁদের বুড়ির চরকা কাটার গল্প। আকাশে আঙুল দিয়ে দেখাতেন পূর্ণিমার চাঁদ। তার সোনালি শরীরে কালো কালো দাগ। তার বুকে জমে থাকা ক্ষত, সে ব্যথা বুঝিনি কোনোদিন।

রান্নায় সামান্য নুন দিলে নাকি মিষ্টির স্বাদ বাড়ে। সোনার আংটিতে খাদ না থাকলে যে সে মজবুত হয় না। আগুনে না পুড়লে নিখাদ সোনা পায় না জহুরি – ম্যানচেস্টার থেকে এজব্যাস্টনের পিচে ল্যাটেরাল আগুনে সুইংগুলো উইকেটের বুক চিড়ে বেরিয়ে গেলে মনে হয় সেই আগুনে পেসের ভেতর জমে আছে ব্যথা। এক আহত শিল্পীর জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া পাঁচটা বছর।

নতুন বলটা স্কিড করে আগুনের মতো ছুটে যাচ্ছে ব্যাটসম্যানের দিকে। পরের বলটা সেন্ট্রাল পিচ পেয়ে গোঁত্তা খেয়ে আছড়ে পড়ছে পায়ে। আউটসুইংটা ব্লক করতে গেলে কড়া আউটসাইড এজে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে ফিরে যাচ্ছে তাবড় তাবড় ব্যাটসম্যান। বাঁ হাতে সিমটা শক্ত করে ধরে দৌড় শুরু করছেন মোহাম্মদ আমির।

মনে পড়ছে ছেলেবেলায় টিভির সামনে বসে ওয়াসিম আকরামের বোলিং স্টাইল নকল করে লাগাতার প্র্যাকটিস চালিয়ে যাওয়া। মনে পড়ছে বাড়িতে ওয়াসিমের ছবি এনে টাঙিয়ে রাখার দিনগুলো। মাত্র ১১ বছর বয়সে স্বপ্নের নায়ক ওয়াসিম যখন ক্যাম্প থেকে তুলে নিয়ে এল ওকে তখন মুখ ফুঁটে কিছু বলতে পারেনি। পাকিস্তান বোর্ডের কাছে তাঁর স্বপ্নের নায়ক সওয়াল করলো তার হয়ে। ওয়াসিম জোড় গলায় জানিয়ে দিলেন পাকিস্তান পেস বোলিং ঐতিহ্যের যোগ্য উত্তরাধিকারী এই ছেলেটাই। অভিষেক হয়ে গেল জাতীয় দলে মাত্র ১৬ বছর বয়সে।

ওভার দ্য উইকেট অনেকটা দৌড়ে এসেছেন আমির। ব্যাটসম্যানের চোখে চোখ রাখলে বুকের ভেতরটা কেমন ডুকরে ওঠে। ১৮ বছর বয়সের একটা ঘৃণ্য অপরাধ মাথার ওপর থেকে সরিয়ে দিল তাঁর আদর্শ ওয়াসিম আকরামের হাত। ক্রিকেট দুনিয়া ধিক্কার ছুঁড়ে দিল তার গগনচুম্বী প্রতিভার দিকে। অন্যায় আর পাপের আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল ক্যারিয়ারের সোনালি সময়টা।

পপিং ক্রিজের প্রায় কাছে পৌঁছোতেই মনে পড়ে ইমরান খানের সেই কথাটা। ওভারের শেষ বল না হওয়া অবধি একজন পেসারের হাল ছাড়তে নেই, দুটো ওভার বাউন্ডারির পরের বলে ছিটকে দিতে হয় ব্যাটসম্যানের স্টাম্প – এখানেই একজন বোলারের জীবনের সর্বস্ব পণ লড়াই- সর্বশক্তি দিয়ে ফের একবার ইনসুইংটা ছুঁড়ে দিলেন আমির।

ব্যাট আর প্যাডের মাঝখান দিয়ে সাদা বলটা ছিটকে দিল স্টাম্প – আইসিসির হালফিলের সর্বত্র পাটা ব্যাটিং উইকেটে শয়ে শয়ে হারিয়ে যাওয়া পেস বোলারের হয়ে জবাব দিলেন আমির। পৃথিবীর যেকোনো উইকেটে বলকে সুইং করানোর শিক্ষা তাঁকে দিয়েছেন ওয়াসিম স্যার!

ক্রিকেট অন্যায়কে মাফ করে না কখনো। কর্ণের মতো নায়ক থেকে ট্র‍্যাজিক নায়ক হয়ে যেতে হয় জীবনের পাশাখেলায়ভ আমির জানেন আজকের সবকটা আগুনে বলের মধ্যে সে ভরে দেয় তার এতদিনের কান্নাভ ঘরের বন্ধ দরজার ভেতর থাকা অপরাধবোধ। ওই হাত থেকে ছাড়া বল আর উইকেট ছিটকে দেবার মাঝের সময়ে ব্যাটসম্যানের অসহায় চাউনি- তাঁর বিনিদ্র সাধনা!

পাঁচটা বছর না হারালে হয়ত দ্বিতীয় ওয়াসিম আকরামকে পেয়ে যেত বিশ্ব। কিন্তু ক্রিকেট ঈশ্বর যে অপরাধের হিসেব বাকি রাখেন না তাই দ্বিতীয় ওয়াসিম নয়, প্রথম আমির হিসেবে বিশ্বের কাছে নিয়ে এল এই প্রতিভাকে।

বাড়িতে বসে ওয়াসিম-ইরফানের পর কোনো বাঁ-হাতি পেসারকে দেখে হাততালি দিচ্ছি বারবার, দেশদ্রোহী বলতে পারেন, কিন্তু যা সুন্দর তাঁর সৌন্দর্য কিন্তু করাচি হোক বা কলকাতা, শুধু শঙখনাদ হয়ে ফিরে আসে, কখনো বোমার শব্দ হয় না, হতে পারে না, এখানেই সমস্ত যুদ্ধের শেষে ক্রিকেটের জিতে যাওয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link