সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজ পেজে আশরাফুল সেদিন একটা ছবি শেয়ার করলেন। ছবিটা হল, উঠতি বয়সের আশরাফুল তাকিয়ে আছেন শচীন টেন্ডুলকারের দিকে। ছবিটার বিবরণীতে এক লাইনে যা লিখেছেন তার বাংলা করলে দাঁড়ায়, সেই দিনগুলির কথা মনে পড়ে!
পড়ারই তো কথা। ছিলেন বাংলাদেশ দলের নির্ভরতার প্রতীক, এরপর করে বসলেন ঘৃণ্য এক কাজ আর এরপর ফিরে আসার পর বাংলাদেশ দলের চৌকাঠ মাড়াতেও দেখা যাচ্ছেনা আশরাফুলকে।
মোহাম্মদ আশরাফুল ইস্যুতে দেশের তাবৎ ক্রিকেট ফ্যানেরা এখন দুই ভাগে ভাগ হয়ে আছেন। এক ভাগ আশরাফুলের প্রত্যাবর্তন চান, আশরাফুল আবার জাতীয় দলে খেলুক এমনটা চান। মোটামুটি এমন চাওয়াতে এখনও তাঁরা আশরাফুলের পথ চেয়ে বসে আছেন তৃষ্ণার্ত কাকের মত। কোন তৃষ্ণার্ত কাক? ঐ যে ছোটবেলায় ‘কমপ্লিটিং স্টোরি’ তে লিখতে হত। তৃষ্ণার্ত কাকের গুটি গুটি পাথর ফেলে পানি খাওয়ার গল্পটা। আশরাফুল ফ্যানেরা তাই এখন এমন পানি দেখলেই পাথর ফেলতে চেষ্টা করেন। প্রতি ম্যাচেই আশা করেন, এই বুঝি এলো একখানা ভাল ইনিংস!
আশরাফুল ইস্যুতে দ্বিতীয় ভাগের মত হল তাঁরা আশরাফুলকে আর জাতীয় দলের ধারেকাছে দেখতে চান না। আশরাফুল ভাল খেলুক, খারাপ খেলুক, ক্রিকেট রেকর্ডের সব খেরোখাতা ছিঁড়ে ফেলুক কিংবা খেলুক জঘন্য ক্রিকেট, আশরাফুলকে আর তাঁরা চান না জাতীয় দলের চৌকাঠে।
ব্যাক্তিগতভাবে আমি নিজেও এই দুই দলের একটাতে তা বলতে কোন দ্বিধা নেই। আজকে আশরাফুলকে নিয়ে লিখতে বসার মূল কারণও এটা নয় যে আশরাফুল আবার জাতীয় দলে খেলবেন নাকি খেলবেন না সেটিও নয়, আবার এটিও নয় যে আশরাফুলকে আবার সুযোগ দেওয়া উচিত নাকি উচিত নয়।
আজকে লেখার মূল উদ্দেশ্য তাঁর তাড়না। দেখুন, ফিক্সিং ইস্যুতে শাস্তিমুক্ত হয়ে আবার দলে ফেরার নজির আছে বেশ কয়েকটাই। মারলন স্যামুয়েলস তো ফিক্সিং এর পর দলের অপরিহার্য সদস্য হিসেবে ম্যাচও খেলেছেন বেশ অনেকগুলোই। আশরাফুল মারলন স্যামুয়েলস থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন কিনা জানিনা, তবে দলে ফেরার জন্যে তাঁর তাড়না নজর কেড়ে বেশ।
ক্রিকেটের মূল শক্তি ফিটনেস। ফিট না থাকলে ক্রিকেটের বেসিক অনেক জিনিসেই সাবলীল হওয়া যায়না। চার কিংবা ছয় মারার জন্যে পায়ের ভর শিফট করতে, দ্রুত রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে প্রান্ত বদল করতে, বলকে বাউন্ডারি ছাড়া করতে, ফিটনেসের বিকল্প নেই কোথাওই। আশরাফুল এই ব্যাপারটাই বুঝেছেন বেশ ভালভাবেই। আজকাল যেখানে জুনিয়র অনেক খেলোয়াড়েরাই জিমে বেশি সময় দিতে চান না, আশরাফুল সেখানে এই বয়সেই ঘন্টার পর ঘন্টা জিমে সময় দিয়েছেন। আশরাফুলের থেকে এই ব্যাপারটা চাইলে উঠতি ক্রিকেটাররা শিখতেই পারেন, অবশ্যই দেখে!
আশরাফুলকে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি কাপে সুযোগ পেতে বিপ টেস্ট উতরাতে হত। মজার ব্যাপার হল, এই বয়সেও আশরাফুল বিসিবির বেঁধে দেওয়া বিপ টেস্ট উতরে গেছেন সাবলীলভাবেই। অনেক নামী ক্রিকেটার যেখানে বিপ টেস্ট উতরাতে ব্যার্থ হয়েছেন, নাসির হোসেনের মত এক সময়ের তারকা যেখানে বিপ টেস্টে পেয়েছেন ৮ এর নিচে, আশরাফুল সেখানে এই বয়সেই পেয়েছেন ১১ এর ওপরে!
সত্যি কথা বলতে, তাড়না না থাকলে, স্বপ্ন না থাকলে এগুলো সম্ভব হয়না । আশরাফুলকে আপনি জাতীয় দলে আর নাই চাইতে পারেন, আশরাফুল হয়তো সত্যিই আর কখনও জাতীয় দলে নাও খেলতে পারেন, কিন্তু এই বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যের পেছনে আশরাফুলের ছোটা, এই ব্যাপারটা সত্যিই মুগ্ধ হবার মত।
এই স্বপ্ন আর লক্ষ্যের পেছনে আশরাফুল ছুটে যাচ্ছেন অনেক আগে থেকেই। নিষেধাজ্ঞা মুক্ত হবার পর তিনি ঢাকা প্রিমিয়ার লীগ খেলেছিলেন, রান পেয়েছিলেন। সেসময়ও একবার জাতীয় দলে খেলার ডাক উঠেছিল। তবে সেই সময় রান পেলেও আশরাফুলের জন্যে কাজটা সহজ ছিল না, কারণ তিনি আসলে তখন ফিটই ছিলেন না।
আশরাফুলের এখন যে বয়স, সেই বয়সের প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেটাররা অনেকেই রান করেন এসব ফিটনেস ছাড়াই। তবে আর যাই হোক, আশরাফুল তো আর এখন সত্যি বলতে ‘প্রতিষ্ঠিত’ নন। সে কারণে তাকে ফিটনেসে ছাড় দেওয়া হবে, এমনটা ভাবা বোকামিই । এটা আশরাফুলও জানতেন। তাই তিনি কাজ করেছেন তাঁর ফিটনেস নিয়ে!
আবার, আশরাফুল বিসিবির চুক্তিভুক্ত খেলোয়াড় নন। তাই অনুশীলনের জন্যে বিসিবির সুযোগ সুবিধা তিনি পান না। তা না পেলে কি হবে, ব্যাক্তিগতভাবে অনুশীলনের ব্যাবস্থাও আশরাফুল করেছিলেন। শোনা যায়, বাড়ি থেকে বেশ দূরে একটা ক্রিকেট ক্লাবে নিয়মিত অনুশীলন করেছেন আশরাফুল। সেই অনুশীলন মাঠে ব্যাগ প্যাড নিয়ে নিয়মিতই তাকে যেতে হত, ঝক্কি পোহাতে পোহাতেই। এই গল্পগুলোতে আশরাফুলের কামব্যাক না হোক, দৃঢ়তার বীণা ঠিকই বাজে।
আশরাফুলকে নোটিশ করতে হলে আরেকটা ব্যাপারও দেখতে হবে। তিনি ফিরেই ডিপিএলে পারফর্ম করেছিলেন, এরপর নির্বাচকদের সুনজর দূর, নজরেই পড়েননি। আবার, ঘরোয়াতেও যে সব টুর্নামেন্টে ডাক পেয়েছেন এমনও। যে কয়টাতে পেয়েছেন, সব গুলোতেই রানের ফোয়ারা ছুটিয়েছেন এমনও কিন্তু নেই। ক্যারিয়ারের এই পড়ন্ত বেলায় এসে এমন অগোছালো কিছু কারো সাথে ঘটলে তাঁর আপসেট হওয়াটা কিন্তু স্বাভাবিকই ছিল, অথচ আশরাফুল আপসেট হননি। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে গেছেন। আজ না হোক কাল, এ ম্যাচ না হোক পরের ম্যাচ, এই টুর্নামেন্ট না হোক পরেরটায় – একদিন!
আশরাফুল বলেছেন, তিনি এই ফেরার স্বপ্নটা দেখেন তাঁর সমর্থকদের জন্যে। এই যে সমর্থকেরা তাঁকে এখনও চায়, এই ব্যাপারটিই নাকি তাঁকে আশা যোগায়। রূপঙ্কর বাগচী তাঁর একটি গানে বলেছিলেন, ‘যদি এক মুহুর্তের জন্যেও আমায় চাও, সেটাই সত্যি।’ আশরাফুল কি তাঁর সমর্থকদের সেই সত্যির ভিত্ততেই এত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই দৃঢ়তা, এই মানসিকতাই আশরাফুলকে নিয়ে কথা বলার জন্যে এই মুহুর্তে যথেষ্ট। আশরাফুল ফিরবেন নাকি ফিরবেন না সেই আলোচনা মূলতবি রাখলাম, আপাতত আশরাফুল যে ফিরতে চান, সেই ফেরার জন্যে যে তাড়না তাঁর, সেজন্যে মোহাম্মদ আশরাফুলকে কুর্নিশ!