কিংস্টন থেকে জর্জটাউন কিংবা গায়ানা, ক্যারিবিয়ানদের ক্রিকেটে এখন চলছে মহোৎসব। কেনই বা হবে না? দু’বারের বিশ্বকাপজয়ী দলটা শেষ বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতেই ব্যর্থ হয়েছে। সেখান থেকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে তাদেরই মাঠে হারানোর উপাখ্যান। এমনটা তো শেষ দেখা গিয়েছিল ২ যুগ পেরিয়ে ২৭ বছর আগের গল্পে।
২৭ বছর আগে মেলবোর্নে হওয়া সে টেস্ট ম্যাচটি জিতিয়েছিলেন ব্রায়ান লারা আর কার্ল হুপার। ১০ উইকেটের পাওয়া সে ম্যাচে লারা করেছিলেন শতক আর হুপার অর্ধশতক। এবার অজি দূর্গে অজিবধের নায়ক শ্যামার জোসেফ। যিনি দ্বিতীয় ইনিংসে ৬৮ রানে ৭ উইকেট নিয়ে গ্যাবায় লিখেছে ইতিহাস।
জশ হ্যাজলউডের স্টাম্প উড়িয়ে দিয়ে তাঁর দিগ্বিদিক দৌড়ানোর দৃশ্যটা উইন্ডিজদের উচ্ছ্বাসে ভাসিয়েছে, আবেগ কাদিয়েছে। কত বছরের সে অপেক্ষা। ২৭ টা বছর। শেষ যখন অজি দূর্গে জয় এসেছে, তখন শ্যামারের জন্মই হয়নি। তাই জন্মের পরে অস্ট্রেলিয়াকে চোখ রাঙানোর দৃশ্যও দেখা হয়নি তরুণ এ পেসারের। তবে এবার শুধু চোখ রাঙালেনই না, টান টান উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচটা জিতেও নিলেন। আর জিতেই দিলেন ভৌ দৌড়।
এত বছর পর অস্ট্রেলিয়ায় আরেকটি জয় তাই আবেগে ভাসিয়েছে লারা, কার্ল হুপারদেরও। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ঐতিহাসিক জয়ের পর ফক্স স্পোর্টসের ধারাভাষ্যকক্ষেই কেঁদে ফেলেন ব্রায়ান লারা। আর এবিসি রেডিওতে ধারাবিবরণী দেওয়া কার্ল হুপারেরও গলা ধরে আসছিল জয়ের মূহূর্তে। ৮ রানে পাওয়া। স্নায়ুরূদ্ধ করে দেওয়ার মতো দৃশ্যপট। সেখান থেকে জয়ের স্বাদ পাওয়াটা তো আক্ষরিক অর্থেই স্বাভাবিক থাকে না।
অথচ এ ম্যাচ জয়ের নায়ক শ্যামার জোসেফের এই টেস্টে আর বলই করার কথা ছিল না। মিশেল স্টার্কের করা এক ইয়র্কার সরাসরি জুতোয় এসে লাগে শ্যামারের। আর তাতেই মাঠ ছাড়তে হয় তাঁকে। ইনিংসের বাকি সময়েও আর ব্যাটিংয়ে নামতে পারেননি তিনি। সবাই ধরেই নিয়েছিল বোলিংটাও হয়তো আর করতে পারবেন না শ্যামার।
কিন্তু সব শঙ্কা কাটিয়ে শ্যামার ফিরলেন। শঙ্কাকে নিয়ে গেলেন সম্ভাবনার দুয়ারে। ফিরলেন বিজয়ীর বেশে, নায়কোচিত রূপে। তবে দৃশ্যপটটা নিশ্চয়ই শ্যামারের অনুকূলে ছিল না। বরং সেটি তিনি নিজের আনুকূল্যে নিয়ে এসেছেন। গ্রিনকে বোল্ড করে যখন প্রথম উইকেট নিলেন, অস্ট্রেলিয়ার জিততে প্রয়োজন আর ১০৩ রান। তখনো আছে ৭ উইকেট। অজিদের কাছে জয়টাই তখন অনুমেয় ব্যাপার।
কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে এরপর, একাই ম্যাচের রঙ বদলে দিতে শুরু করলেন শামার। পদারুণ এক ইয়র্কারে বোল্ড করেন ট্রাভিস হেডকে। এরপর একে একে ফিরিয়ে দিয়েছেন মিশেল মার্শ, ক্যারি, স্টার্ক, কামিন্স ও হ্যাজলউডকে। শেষটাও হয়েছে তাঁরই ছোঁড়া এক গোলাতে হ্যাজলউডের স্ট্যাম্প ছত্রখান হওয়ার দৃশ্যে। যে দৃশ্যে শামার ছুটেছেন উদ্দেশ্যহীন ভাবে, আর উল্লাসে তাঁকে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করেছে তাঁর সতীর্থরা।
ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় টেস্টেই ইনিংসে ৭ উইকেট। এর আগে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ৭ উইকেট নেওয়ার কীর্তিই তো ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাত্র তিনজন বোলারের। ১৯৫৬ সালে জেরি গোমেজকে দিয়ে শুরু। এরপর ১৯৭৫ সালে অ্যান্ডি রবার্টস ও ১৯৯৩ সালে কার্টলি অ্যামব্রোস নেন ৭ উইকেট। ছোট্ট এই তালিকাটায় এবার নাম লেখালেন শামার জোসেফও।
বছরখানেক আগেও নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করতেন শ্যামার জোসেফ। বারাকার নামক প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে খেলার আগে খুব বেশি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটও ম্যাচ খেলা হয়নি তাঁর। কিন্তু এক গ্যাবা টেস্টেই ভাগ্যবদল হয়ে গেল শ্যামার জোসেফের।
লিখলেন এক রূপকথার গল্প। যে গল্পে বাস্তবিক অর্থেই নায়ক তিনি। কে জানে, গ্যাবার এ নায়ক একদিন নিজের নায়কোচিত রূপ দেখাবে প্রতিটি জায়গায়। পাল্টে দিবেন ধুঁকতে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজের গল্প, ফিরিয়ে আনবেন সোনালী সেই সব ইতিহাস।