অলিম্পিক গেমসের মতো বড় আসর আয়োজনের জন্য এক দশক আগে থেকেই স্বাগতিক দেশ নির্ধারিত হয়ে থাকে। ২০২০ অলিম্পিকের জন্য টোকিও স্বাগতিক হওয়াটা তেমনই। কিন্তু করোনা নামক ভয়াল ভাইরাসের থাবায় পড়ে পুরো এক বছর পিছিয়ে যায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ক্রীড়া আসর। ২০৫ দেশের ১১ হাজারের বেশি অ্যাথলেট অংশ নিচ্ছেন এবারের আসরে।
২৩ জুলাই শুরু হয়ে ৮ আগস্ট শেষ হবে এবারের টোকিও অলিম্পিক গেমস। কিন্তু জাপানের কাছে এই গেমস যেন গলার কাটা! নিরবিচ্ছিন্ন আর করোনা ভাইরাস মুক্ত রাখতে নানা পদক্ষেপ নিলেও সেটি আর রাখতে পারছেনা সূর্যোদয়ের দেশটির রাজধানী। গেমস ভিলেজে প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা আক্রান্ত অ্যাথলেট, কর্মকর্তার সংখ্যা। সাথে বাড়ছে আতঙ্ক আর ক্ষোভ।
টোকিওতে জরুরি অবস্থা চলছে একমাসেরও বেশি সময় ধরে। এরই মধ্যে শেষ মুহুর্তের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যষÍ আয়োজক দেশটি। গ্রীস্মকালীন অলিম্পিকে ৩২তম আসরকে সামনে রেখে প্রস্তুতিতে এতটুকু ঘাটতি রাখতে চাইছেনা জাপান। ৩৩টি ডিসিপ্লিনে ৩৩৯ ইভেন্টের খেলা জাপানের ৪২টি ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত হবে। এখনো প্রতিদিনিই জাপানের কোন না কোন শহরে অলিম্পিক বাতিলের দাবীতে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
মূল ভেন্যু টোকিও ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে উদ্বোধনী ও সমাপনী অনুষ্ঠানের পাশাপাশি অ্যাথলেটিক্স ও ফুটবল ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হবে। গলার কাটাকে সরাতে জোর কদমে চলছে প্রস্তুতি। ৮ আগষ্ট গেলেই যেন হাফ ছেড়ে বাচঁবে জাপানীরা। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসরের আদ্যোপান্ত নিয়েই এবারের প্রতিবেদিনটি সাজানো হয়েছে।
- অলিম্পিকের জন্য প্রস্তুতির সর্বোচ্চ চেষ্টায় টোকিও
অলিম্পিকের জন্য প্রস্তুতিটা স্বাগতিক ঘোষনার পর থেকেই শুরু হয়েছে টোকিওর। তবে করোনাকালীন সময়ে বেশ বিপাকেই পড়েছে বিশ্ব অর্তনীতির অন্যতম শক্তিশালী এই দেশটি। সে কারণে গেমস শুরুর আগেও যেন কাজ শেষ করতে পারছেন না। বিভিন্ন সুত্র থেকে জানা গেছে অলিম্পিকের প্রকৃত বয়স তিন হাজার বছরের কাছাকাছি! ঐতিহাসিক বেশকিছু তর্থের খবরে জানা গেছে ৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে গ্রিসের অলিম্পিয়ায় এই আসরটির সূচনা হয়েছিল।
তারপর থেকে প্রতি চারবছর পর পর অনুষ্ঠিত হতো। অলিম্পিকের হাজার বছরের ইতিহাস নিয়ে কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আকস্মিক করোনা ভাইরাস হানা না দিলেও ২০২০ সালেই জাপানের টোকিওতে ২৩ জুলাই থেকে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের ৩২তম আসর শুরু হয়ে শেষ হতো ৮ আগস্ট। এখন গেমস শুরুর আগেই অলিম্পিক ভিলেজে করোনা প্রবেশ পজিটিভ বানিয়েছে দুই অ্যাথলেটকে।
তাই একটি নিরাপদ অলিম্পিকের প্রতিশ্রুিিত হাস্যরসে পরিণত হতে যাচ্ছে। যাতে প্রস্তুতিতে বড় রকমের ব্যঘাটত ঘটছে। জানা গেছে গেমসের সঙ্গে সম্পৃক্ত ১৫ জনের মধ্যে গণমাধ্যমের দুজন, ঠিকাদার সাতজন এবং গেমসের পাঁচজন কর্মী রয়েছেন। টোকিও অলিম্পিক প্রায় দর্শকবিহীন মাঠেই শেষ করা হবে। আমন্ত্রিত অতিথিও থাকবে হাজার খানেকের মধ্যে। টোকিওতে গেমস শুরুর দিন পাচেঁক আগেও চার দিন ধরে টানা এক হাজারের বেশি মানুষ কভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন।
আগের সপ্তাহের তুলনায় ৫৫ ভাগ দ্রুত সংক্রমন বাড়ছে। জাপানে মোট জনসংখ্যার মাত্র ২০% টিকার আওতায় এসেছে। ৫০ ভাগ টোকিওবাসী এখন পর্যন্ত অলিম্পিক গেমস স্থগিত চান। সারা দেশের হিসাব ধরলে সংখ্যাটা ৭৮ ভাগে দাড়াবে। তবু অনেকটা বাধ্য হয়ে জনমতের বিরুদ্ধে গিয়েও অলিম্পিক করতে হচ্ছে। সে কারণে প্রস্তুতিও সেভাবে নিতে পারছেনা।
- অলিম্পিকের শুরুটা যেভাবে
হাজার বছরের পুরনো ইতিহাস থাকলেও অলিম্পিক গেমসের শুরুর সময়টা নিয়ে নানারকম কথা শোনা যায়। প্রাচীন গ্রিস দেবতা জিউসের আবাসস্থল অলিম্পিয়ানদের ধর্মীয় রীতি-রেওয়াজের সঙ্গে মিল রেখে অলিম্পিক গেমস হতো। মূলত প্রাচীন গ্রিক নগর রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরাই এখানে অংশ নিতেন। সাধারণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ছাড়াও মল্লযুদ্ধ, ঘোড়দৌড়, রথ প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হতো।
ইতিহাস ঘেটে জানা যায়, বিভিন্ন নগর-রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘাত-যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করলেও প্রতিযোগিতা চলাকালে সেটি স্থগিত রাখা হতো। এ সময় সাময়িক বন্ধ থাকাকে ‘অলিম্পিকের যুদ্ধবিরতির নীতি’ হিসেবে অবিহিত করা হতো। অলিম্পিকের জন্ম আজও মানুষের কাছে একটি অপার রহস্য হয়ে আছে। জনপ্রিয় একটি গল্পকথা থেকে জানা যায়, দেবতা জিউস এবং তার ছেলে হেরাক্লিস বা হারকিউলিস অলিম্পিক গেমসের জনক।
হেরাক্লিসই এ অনুষ্ঠানকে অলিম্পিক নাম দেন এবং প্রত্যেক চার বছর পর পর গেমস আয়োজনের প্রচলন শুরু করা হয়। অলিম্পিকের সূচনা খৃস্টপূর্ব ৭৭৬ সালের দিকে বলেই প্রাচীন লিপি থেকে জানা যায়। এভাবেই অলিম্পিকের শুরু হয়।
- যেভাবে আধুনিক অলিম্পিক
মূলত ১৭০০ শতাব্দীর দিকে শুরু আধুনিক ক্রীড়াযঞ্জ অলিম্পিকের যাত্রা শুরু করা হয়। পরিসংখ্যান বলছে, প্রথম আয়োজন ছিল ইংল্যান্ডে শুরু হওয়া কোটসউল্ড গেমস বা কোটসউল্ড অলিম্পিক গেমস। ১৬১২ থেকে ১৬৪২ সালের মধ্যে এই কোটসউল্ড গেমসের প্রধান আয়োজক ছিলেন রবার্ট ডোভার, যিনি আবার ব্রিটিশ আইনজীবী হিসেবে দেশজুড়ে সমাদৃত ছিলেন।
লন্ডনে ২০১২ সালের অলিম্পিক গেমসের বিদায়ী অনুষ্ঠানে সপ্তদশ শতকের এই ঘটনাকে ব্রিটেনের অলিম্পিকের সূচনার অভ্যূদয় হিসেবে সে সময় থেকেই ঘোষণা করা হয়। ১৮৫০ সালের দিকে ইংল্যান্ডের শ্রপশায়ারের মাক ওয়েনলকে আধুনিক যুগের মতো করে অলিম্পিক গেমসের প্রচলন শুরু করেন ড. উইলিয়াম পেনি ব্রুকস হিলস। তিনি এই গেমসের নাম দেন ওয়েনলক অলিম্পিয়ান গেমস হিসেবে।
এ ক্রীড়াযজ্ঞটিই ধারাবাহিকভাবে আজ পর্যন্ত চলে আসছে। ১৮৯৬ সালে গ্রিসে অনুষ্ঠিত আধুনিক অলিম্পিক ছিল লিভারপুলে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমসের মতোই। ১৬৬৫ সালে জন হুলি এবং ড. ব্রুকস ন্যাশনাল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন গঠন করে পরে এটিকে ব্রিটিশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন গঠনের পথপ্রদর্শকের কাজ করে।
- পুনর্জাগরণ হয়েছে যেভাবে
আধুনিক হওয়ার অনেকভাবেই অলিম্পিকের আধুনিকায়ন করা হয়। সাথে করা হয় পূর্নজাগরণও। অটোমান সাম্রাজ্য থেকে মুক্ত হতে ১৮২১ সালে গ্রিসে যুদ্ধ শুরু হয়। এতে জয়ী হওয়ার পর থেকেই গ্রিকরা অলিম্পিক গেমসকে পুনর্জীবিত করার ভাবনা নিয়ে কাজ করছিল। সে হিসেবে অলিম্পিকের পুনর্জাগরণের স্বপ্নদ্রষ্টা হলেন প্যানাজিওটিস সটসস। যাকে একাধারে কবি ও সংবাদপত্রের সম্পাদক ছিলেন। ১৮৩৩ সালে ‘ডায়ালগ অব দ্য ডেড’ নামে একটি কবিতায় তার এ চিন্তাধারা সমুহ তুলে ধরা হয়।
পরবর্তীতে ইভাঞ্জেলোস জ্যাপ্পাস নামের এক বিত্তশালী এবং লোকহিতৈষী গ্রিসের রাজা অট্টোকে চিঠির মাধ্যমে অলিম্পিক গেমস ফের স্থায়ীভাবে চালুর জন্য একটি তহবিল গঠনে সহায়তা চেয়ে ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়। এরপর ১৮৫৯ সালে ইভাঞ্জেলোস জ্যাপ্পাসের পৃষ্ঠপোষকতাতেই অ্যাথেন্সের সিটি স্কোয়ারে অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হয় এবং যেখানে অটোমান সাম্রাজ্য এবং গ্রিসের ক্রীড়াবিদরা অংশ নেওয়া শুরু করেন। যার ধারাবাহিকতায় নিজের অর্থ দিয়ে একটি স্টেডিয়ামও সংস্কার করেন।
জ্যাপ্পাসের সংস্কারকৃত স্টেডিয়ামে প্রথমবারের মতো ১৮৭০ এবং ১৮৭৫ সালের অলিম্পিক গেমস আয়োজন করা হয়। ১৮৭০ সালের অলিম্পিকে ত্রিশ হাজারেরও বেশি দর্শক উপস্থিত হন। ১৮৯০ সালের ওয়েনলক অলিম্পিয়ান সোসাইটির অলিম্পিয়ান গেমস দেখে ব্যারন পিয়ের দ্য কুবেরত্যাঁ আন্তর্জাতিক অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠার জন্য বড় কাজটি করে যান।
- নানা রকম আর রঙের অলিম্পিক
অলিম্পিক গেমস সাধারনত দুভাগে ভাগ হয়ে অনুষ্টিত হয়ে থাকে। যার একটি গ্রীস্মকালীন অপরটি শীতকালীন। সাধারণভাবে অলিম্পিক গেমস বলতে গ্রীস্মকালীন অলিম্পিক গেমসকে বোঝানো হলেও ১৯২৪ সাল থেকে শীতকালীন অলিম্পিক গেমসের প্রচলন শুরু হয়।
শীতকালীন এবং গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক একই বছর অনুষ্ঠান শুরু হলেও ১৯৯২ সালে এসে শীত এবং গ্র্রীষ্মকালীন অলিম্পিক দুই বছর পর পর অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। এছাড়া এরপর থেকে প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ অলিম্পিক গেমস বা ‘প্যারা অলিম্পিক গেমস’ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ১৯৬০ সাল থেকে। অলিম্পিক গেমসের আয়োজক শহর গ্র্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমসের পর পরই প্যারা অলিম্পিক গেমসের আয়োজন করার একটা রীতি চালু করা হয়। তরুণদের জন্য ‘ইয়ুথ অলিম্পিক গেমস’ ২০১০ সালে সিঙ্গাপুরে প্রথমবার অনুষ্ঠিত হয়।
- যে মন্ত্রে এগিয়েছে অলিম্পিক
নানা সময় বিভিন্ন শ্লোগান নিয়ে এই গেমসটি শুরু হয়েছে। অলিম্পিকের বিশ্বাস এবং মূলমন্ত্র হলো- ক্ষিপ্রতা, উচ্চতা এবং শক্তি। ১৯২১ সালে পিয়েরে ডি ক্যুবার্তা এই শ্লোগানের প্রচলন শুরু করেন। ১৯০৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকে বিশপ তালবোটের দেওয়া বক্তৃতার অংশ অলিম্পিক গেমসের মূল বিশ্বাস হিসেবে পরিচিত। অলিম্পিকের খেলাগুলো কমবেশি হয়ে থাকে।
৩৫টি খেলা, ৩০টি শাখা ও প্রায় ৪০০টি বিভাগের সমাহার হলো ‘অলিম্পিক ক্রীড়া’ হিসেবে পরিচিত। স্বস্থি হিসেবে যার দুটি শাখা হলো গ্রেকো-রোমান এবং ফ্রি স্টাইল। ওজনের ভিত্তিতে ১৪টি পুরুষদের ও ৪টি মহিলাদের বিভাগও বর্তমানে নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বর্তমানে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ২৬টি খেলা ও শীতকালীন অলিম্পিকে ১৫টি খেলা নিয়ে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আর ২০২০ সালের গেমস ২০২১ সালে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
- পাঁচটি রিংয়ের ইতিবৃত্ত
পাচঁটি রংয়ের পাঁচটি রিং অলিম্পিকের আলাদা একটা ঐতিহ্য বহন করে আসছে বছরের পর বছর থেকে। অলিম্পিক গেমসের পাঁচটি রিংয়ের মাধ্যমে পাঁচটি মহাদেশকে তুলে ধরা হয়। ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা, ওশেনিয়া অঞ্চলের পাশাপাশি দুই আমেরিকাকে তুলে ধরা হয় একটা রিংয়ের মাধ্যমে। প্রথমে ১৯১৪ সালে অলিম্পিক কংগ্রেসে এই অলিম্পিক রিং ’গ্রেটেস্ট শো অন আর্থে’ চালু করার কথা থাকলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য সেটি আর চালু করা যায়নি। অবশেষে সপ্তম অলিম্পিকে বেলজিয়ামে সেটির প্রচলন হয়।
পাঁচটি রিং মানে পাঁচটি মহাদেশকেই শুধু তুলে ধরা নয়, রিংগুলের রঙেরও রয়েছে নানা ইতিহাস। লাল, নিল, হলুদ, সবুজ ও কালো- এমনভাবে পাঁচটি রঙ বেছে নেওয়া হয়েছে, যাতে বিশ্বের যে কোনো দেশের পতাকায় এই পাঁচটি রংয়ের অন্তত একটি রঙ দেখতে পাওয়া যায় সে হিসেবে। যেটি আবার অলিম্পিক ঐতিহ্যের অংশ হয়েও দাড়িয়ে আছে।