জন্টি রোডস নামক আতঙ্কের অনিবার্য প্রতিফলন

ক্রিকেট ছাড়লেও, ক্রিকেট জন্টিকে ছাড়েনি। কোচ কিংবা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের মেন্টর পদ ছাপিয়ে কোথাও যেন তিনি সেই আগের জন্টিই—ফিল্ডিংয়ের কবি, সবুজ মাঠের শিল্পী। আজও কেউ নান্দনিক একটা ডাইভ দিলে, উড়ন্ত কোনো ক্যাচ ধরলে কিংবা তুখোড় এক রান আউট করলে জন্টি রোডসের স্মৃতি হৃদয়ের বুকে উঁকি দেয় বারবার।

ফিল্ডিং মানেই জন্টি রোডস – এটুকু বললেই চলে। সে ফিল্ডিং ছিল ক্রিকেটের চিরকালীন এক অবহেলিত অধ্যায়। কেউ ভাবেনি, বল ধরার শিল্প দিয়েও বিশ্বজয় করা যায়, সামান্য একটা রান আউট দিয়েও হৃদয় কেড়ে নেওয়া যায়। কিন্তু এক জন্টি রোডস নব্বই দশকে এসেই সব হিসাব পাল্টে দেন। ক্রিকেটের বাইশ গজে ফিল্ডিংকে করে তোলেন এক পূর্ণাঙ্গ ভাষা, এক জীবন্ত কবিতা।

ব্যাটে-বলে রেকর্ড গড়ার ভিড়ে, তিনি তুলে এনেছিলেন শারীরিক ক্ষিপ্রতা, চোখের তীক্ষ্ণতা আর মাটির সাথে মিশে যাওয়া নিষ্ঠাকে। রোডস দেখিয়ে দেন, মাঠে বল থামিয়ে, ক্যাচ ধরে কিংবা স্ট্যাম্প ছিঁড়ে দিয়েও বনে যাওয়া যায় ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র।

সবুজ গালিচার বাইশ গজে যুগে যুগে কাব্য রচনা করেছেন ডন ব্র্যাডম্যান, শচীন টেন্ডুলকার, লারা, কোহলি কিংবা উইলিয়ামসনরা। বল হাতে বোলিংয়ের মহীরুহ হয়ে উঠেছেন মার্শাল, লিলি, হোল্ডিং কিংবা মুরালিধরন। কিন্তু, এতোসব ব্যাট-বলের ব্যস্ততার মাঝেও কেউ যদি শুধুমাত্র ফিল্ডিং দিয়ে নিজের নামকে পৌঁছে দিতে পারেন ক্রিকেট-চর্চার কেন্দ্রে, তবে নি:সন্দেহে সে নামটা হল জন্টি রোডস।

তিনি একক হাতে প্রমাণ করে গেছেন, ক্রিকেট কেবল ব্যাট আর বলের খেলা নয়—ফিল্ডিংও হতে পারে এক অনন্য শিল্প, হতে পারে ভালোবাসার প্রতিমূর্তি।ফিল্ডিংকে তিনি রূপ দিয়েছেন শুদ্ধ শিল্পে, যেন ভ্যানগগের তুলির ছোঁয়া কিংবা রবীন্দ্রনাথের কলম।

পয়েন্টে দাঁড়িয়ে এক ডাইভে ক্যাচ তুলে নেওয়া কিংবা স্ট্যাম্প ছিঁড়ে ফেলা তার জন্য ছিল যেন নিছক রুটিনের অংশ। ব্যাটসম্যানদের বুঝেশুনে খেলা, রানের আগে দ্বিতীয়বার ভাবা—এসব ছিল জন্টি নামক আতঙ্কের অনিবার্য প্রতিফলন।

ক্রিকেট ছিল তার ক্যানভাস, আর ফিল্ডিং ছিল তাঁর রঙতুলির ছোঁয়া। একেকটা ডাইভ যেন ছিল ছন্দের মতো, একেকটা থ্রো যেন কবিতার অন্ত্যমিল। এমনকি ফিল্ডিংয়ের সংজ্ঞায়নও বদলে দিলেন তিনি।

শুধু শরীর নয়, একান্ত মনোযোগ, উজাড় করে দেওয়া হৃদয়, আর বিক্ষিপ্ত প্রাণশক্তি মিলিয়ে তৈরি করলেন এক জাদুকরি দৃশ্যাবলি। ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো তার প্রতিটি মুহূর্ত—ডাইভ করা, থ্রো করা, রান আউট—একটি করে কবিতা, একটি করে গল্প।

জন্টি ব্যাটার হিসেবেও কম ছিলেন না। ২৪৫টি একদিনের ম্যাচে রান ছুঁয়েছেন ৬০০০-এর ঘর। টেস্টে ৫২ ম্যাচে ২৫৩২ রান। ১৯৯৯-এ উইজডেনের বর্ষসেরা—একটি স্বীকৃতি, একটি উজ্জ্বল সীলমোহর।

ক্রিকেট ছাড়লেও, ক্রিকেট জন্টিকে ছাড়েনি। কোচ কিংবা ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের মেন্টর পদ ছাপিয়ে কোথাও যেন তিনি সেই আগের জন্টিই—ফিল্ডিংয়ের কবি, সবুজ মাঠের শিল্পী। আজও কেউ নান্দনিক একটা ডাইভ দিলে, উড়ন্ত কোনো ক্যাচ ধরলে কিংবা তুখোড় এক রান আউট করলে জন্টি রোডসের স্মৃতি হৃদয়ের বুকে উঁকি দেয় বারবার।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Share via
Copy link