মুঘল সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট আকবর এক ফেব্রুয়ারিতে সম্রাটের আসনে বসেছিলেন। এরপর ধীরে ধীরে ভারতীয় উপমহাদেশের সিংহভাগের শাসনকর্তা হয়ে উঠেছেন। আকবরের নামের পাশে বসিয়ে দেয়া হয় ‘আকবর দ্য গ্রেট’ উপাধি। ঠিক আরেকটা ফেব্রুয়ারিতে আরেকজন আকবরকেও ডাকা হয়েছিল একই নামে।
তিনি অবশ্য ভারতের কেউ না, তিনি সম্রাট বংশের কেউইও না। বরং বাংলাদেশের সাদামাটা এক আঠারো বছরের তরুনকে ডাকা হয়েছিল এমন ভারিক্কি নামে। বিশ্বজয় করার উপলক্ষে কিংবদন্তি ইয়ান বিশপ অধিনায়ক আকবর আলীর পরিচয় দিয়েছিলেন ‘আকবর দ্য গ্রেট’ নামে। অবশ্য এমন ভারী নাম মোটেও ভারী ছিল না তার জন্য।
২০২০ সালের সেই ফেব্রুয়ারির কথা ভোলার কথা নয়। বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব ১৯ দল সেবার জিতেছিল বিশ্বকাপ। ফাইনালে প্রতিবেশী ভারতের বিপক্ষে চাপের মুখে থেকেও দলকে তীরে এনে দিয়েছিলেন অধিনায়ক আকবর। আকবর আলী নামের এক দুর্দমনীয় প্রতিভার নেতৃত্বের হাত ধরেই বিশ্ব জয়ের গৌরব অর্জন করেছিল বাংলাদেশ।
‘আকবর দ্য গ্রেট’ পুরো টুর্নামেন্টেই ছিলেন আড়ালে। কখনো পারভেজ ইমন, কখনো মাহমুদুল হাসান জয় কিংবা তামিম, রাকিবুলদের হাত ধরেই এগিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। আড়ালে থেকেই আকবর পুরোটা সময় বুদ্ধিদীপ্ত অধিনায়কত্বে স্বপ্ন পূরনের পথে নিয়ে গিয়েছিলেন লাল-সবুজের প্রতিনিধিদেরকে। আর এরপর ফাইনালে একা হাতে ভারতীয় দম্ভ চুর্ণ করে আনন্দে ভাসিয়েছেন পুরো বাংলাদেশকে।
বিশ্বজয়ের মিশনে প্রায় সময় আড়ালে থাকা আকবর শিরোপা জয়ের পর আবারো আড়ালেই ফিরে এসেছেন। সতীর্থ শরিফুল ইসলাম তো জাতীয় দলের নিয়মিত সদস্য, মাহমুদুল জয়ও টেস্টে দলের ওপেনার। এছাড়া শামীম হোসেনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছে, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপও খেলে ফেলেছেন তিনি। অন্যদিকে আকবর এখনো অনেকটা হিসেবের বাইরে।
লাইমলাইট খোঁজার ইচ্ছে হয়তো নেই আকবরের, বরং তার ইচ্ছে প্রাপ্ত সুযোগগুলোকে ভালভাবে কাজে লাগানোর। ঘরোয়া ক্রিকেটে যখন যে দলের জার্সি গায়ে জড়িয়েছিলেন তাদের জন্য নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছেন। সর্বশেষ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলেছিলেন গাজী গ্রুপ অব ক্রিকেটার্সের হয়ে। দলটির অধিনায়কও ছিলেন তিনি। পুরো আসরে ১৫ ম্যাচে ৪৫৩ রান, ৩৪ এর বেশি গড় আর ১০০ এর উপরে স্ট্রাইক রেট। এই একগাদা সংখ্যা কিছুটা পারলেও আকবরের পারফরম্যান্স পুরোপুরি তুলে ধরতে পারবে না।
সব ম্যাচেই ফিনিশার রোলে ব্যাট করেছেন; কখনো রান পেয়েছেন, কখনো হয়তো পান নি। কিন্তু আকবর আলী কখনোই দলের বোঝা হয়ে ছিলেন না। শেষদিকে হাত খুলেই খেলেছেন পুরো আসরে। অহেতুক ডট বলের চেয়ে স্ট্রাইক রোটেটের দিকেই বেশি নজর ছিল তার।
এছাড়া বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ, বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি লিগগুলোতেও জায়গা পেয়েছিলেন আকবর, সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতেও ভুল হয়নি তার। সম্প্রতি শেষ হওয়া হাইপারফরমেন্স ইউনিট বনাম বাংলা টাইগার্স চারদিনের ম্যাচেও এক ঝাঁক তরুনদের নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন অধিনায়ক আকবর।
দলে নিয়মিত খেলছেন, অধিনায়কত্ব করছেন – এটা পরিষ্কার যে আকবরের পারফরম্যান্সের কারনেই তার উপর ভরসা রাখছে ম্যানেজম্যান্ট। তাছাড়া ঘরোয়া টুর্নামেন্টের খেলাগুলো নিয়মিত অনুসরণ করলে আরো ভালভাবেই ব্যাপারটা বোঝা যায়। কিন্তু পারফরম্যান্সের তুলনায় আসলে আকবরকে নিয়ে ততটা আলোচনা হয় না। বিশ্বকাপ জয়ের কিছু সময় পরেই তিনি চলে গিয়েছিলেন আলোচনার বাইরে।
কিন্তু আকবর পারফর্ম করেছেন আকবরের মতই, আড়ালে থেকে নিজের কাজ করেছেন। প্রয়োজনের সময় তারুন্যের শক্তিতে এগিয়ে এসেছেন। কাঁধে তুলে নিয়েছেন দলকে, পৌঁছে দিয়েছেন নিরাপদ আশ্রয়ে। অনূর্ধ-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে তার ধীরস্থির কার্যকরী ইনিংসটি কোন অঘটন ছিল না, বরং আকবরের সামর্থ্যের প্রতিফলন ছিল সেটি – এমনটা পরবর্তীতে প্রমাণ করতে পেরেছেন তিনি।
ব্যাটিংয়ের বাইরে নেতৃত্বগুন দিয়েও আলাদাভাবে নজর কেড়েছেন বিশ্বজয়ী অধিনায়ক আকবর। স্রষ্টা প্রদত্ত শান্ত এক ক্রিকেট মস্তিষ্কের অধিকারী তিনি, বর্ন-লিডার বলা যায় যাকে।
সতীর্থ শরিফুল, জয়, শামীমদের মত ইমন, মৃত্যুঞ্জয়রা আছেন সবার মুখে মুখেই। অন্যদিকে নীরবে নিভৃতে আকবর নিজেকে শান দিয়ে নিচ্ছেন। তৈরি হয়ে নিচ্ছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের ভরসাযোগ্য একজন হয়ে ওঠার।
জাতীয় দলের আসার অপেক্ষা আরো বাড়ুক আকবরের। বয়সটা মাত্র ২১, আরো কিছু সময় ধরে নিজেকে নিয়ে কাজ করতে থাকুক। দ্রুত দলে এসে অকালে ঝরে পড়ার কি দরকার। বরং তার চেয়ে ভুল ত্রুটি শুধরে পরিপূর্ন একজন হয়েই কিছু সময় পরে না হয় লাল-সবুজের প্রতিনিধিত্ব করবেন আকবর আলী। তার উপর ভরসা তো একটু বেশিই, প্রত্যাশার পারদটাও একটু উপরে।