নর্দাম্পটনে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেই ম্যাচটা ছাড়া বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসটাই যেন অসম্পূর্ণ। সেই ম্যাচের প্রসঙ্গ আসলে সবার আগে খালেদ মাহমুদ সুজনের প্রসঙ্গ আসে। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস কিংবা শোয়েব আখতারের মত ইতিহাস কাঁপানো ফাস্ট বোলার থাকার পরও সুজনই ছিলেন সেই ম্যাচের সেরা পেসার। ব্যাট হাতেও শেষের দিকে কার্যকর এক ইনিংস খেলেছিলেন সুজন।
সাবেক অধিনায়ক আকরাম খানের কথাও বলেন অনেকে। তাঁর ৪২ রানের ইনিংসটার সুবাদেই তো সেদিন লড়াই করার পুঁজি পেয়েছিল বাংলাদেশ। তবে, সেদিন আড়ালের এক নায়কও ছিলেন বাংলাদেশ দলে। সেদিন সেই ওপেনারই প্রথম সাহসটা যুগিয়ে দিয়েছিলেন। ‘বিদ্যুতে’র ঝলকটা গিয়েছিল তিন পেসার – ওয়াসিম, ওয়াকার ও শোয়েবের ওপর দিয়ে।
শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ সেদিন ৬০ বলে ৩৯ রান করেন। আধুনিক ওয়ানডে ক্রিকেটে এমন ইনিংসের জন্য সমালোচিত হতে হয় অনেককেই। কিন্তু, সেদিনের প্রেক্ষাপটে সেটা ছিল বিরাট পাওয়া, বিরাট এক সাহসের যোগানদাতা ইনিংস। বিশেষ করে যেভাবে তিনি পাকিস্তানের পেসত্রয়ীকে সামলেছেন – তাতে সেদিন কিছু একটা ঘটে যেতে পারে, এমন একটা ইতিবাচক বাতাস দলের ভেতর ছড়িয়ে গিয়েছিল।
বাকি ইতিহাসটা সবারই জানা। বিশ্বকাপের সেই ম্যাচে পাকিস্তানকে ৬২ রানে হারানোর মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হয় বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের দরজা। আড়ালের নায়কের অবদানটা আড়ালেই পড়ে থাকে।
বিদ্যুৎ বরাবরই পার্শ্ব নায়ক ছিলেন। তবে, ওপেনার হিসেবে তিনি বরাবরই ছিলেন সাহসী ও সাবলীল। তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত সেই বিশ্বকাপের বছরই আসে, তবে সেটা সে বছরের মার্চে। ঢাকায় সে বছর ত্রিদেশীয় সিরিজে কেনিার বিপক্ষে ৯৫ রান করেছিলেন বিদ্যুৎ। স্টিভ টিকোলো নামের এক দানবের সেঞ্চুরিতে ম্যাচটায় বাংলাদেশ হারে, যদিও তখন বিদ্যুতের এই ৯৫ রানটাই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ ছিল।
বিদ্যুতের পাঁচ রানের সেই আক্ষেপ না মিটলেও, বাংলাদেশের মিটেছিল তাঁর পাঁচদিন বাদেই। ২০ মার্চ ৯৫ রানের ইনিংস খেলেন বিদ্যুৎ, ২৫ মার্চ একই টুর্নামেন্টেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম সেঞ্চুরি করেন মেহরাব হোসেন অপি।
সেদিনও বরাবরের মত পার্শ্বনায়ক ছিলেন বিদ্যুৎই। তিনি ৬৮ রানের ইনিংস খেলেন। ওপেনিংয়ে দু’জন মিলে যোগ করেছিলেন ১৭০ রান, ওপেনিংয়ে বাংলাদেশের সেরা জুটির রেকর্ড হিসেবে সেটা টিকেছিল পাক্কা ২১ বছর।
১৯৯৯ সালটাই বিদ্যুতের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ভাল সময়য়। বিশ্বকাপের পর দেশে ফিরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অক্টোবরে দু’টো চল্লিশোর্ধ্ব ইনিংস তিনি খেলেছিলেন ওয়ানডেতে। তবে, টেস্টে তিনি কখনোই নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি। তিন টেস্টে ৯৯ রান করেই থামতে হয়েছিল। সর্বোচ্চ ৪৮ রানের ইনিংস খেলেছিলেন সেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, হারারেতে।
ইনজুরির কারণে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের পর সব ফরম্যাট থেকেই বাদ পড়েন। এরপর বাংলাদেশের আরেক ‘শাহরিয়ার’ আল শাহরিয়ার রোকনে ভরসা জন্মায়। ২০০৪ সালে বিদ্যুৎ ফিরেছিলেন। এই দফায় দুই টেস্ট আর দুই ওয়ানডে খেলে আজীবনের জন্য বিদায় ঘটে নারায়নগঞ্জের এই ক্রিকেটারের।
এই সময়টাতেও ইনজুরির বড় একটা ভূমিকা ছিল। আর তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) পুনর্বাসন প্রক্রিয়াও আশানুরূপ ছিল না। আর বিদ্যুৎ বরাবরই দাবী করেছেন, তিনি নোংরা রাজনীতির শিকার হয়েছেন। ঘরোয়া ক্রিকেটও পরে আর সেভাবে খেলেননি বিদ্যুৎ।
ক্ষোভ নিয়ে তিনি বিসিবিকে চিঠি পাঠিয়ে অবসরের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। তাঁর জন্য এমন বিদায় কাম্য ছিল না। ক্রিকেট থেকে তিনি এখন দূরেই আছেন বলা যায়। সাবেকদের প্রীতি ম্যাচ বাদে বিদ্যুতের ঝলক আর দেখা যায় না।
একটা তথ্য দিয়ে শেষ করি। বিদ্যুৎ বাংলাদেশ ক্রিকেটের দু’টো আবেগের জায়গার সাথে জড়িয়ে আছেন। বিশ্বকাপ ক্রিকেট ও টেস্ট ক্রিকেট – বাংলাদেশের কৌলিন্যে নাম লেখানোর দুই মঞ্চেই প্রথম ডেলিভারিটা ব্যাট দিয়ে মোকাবেলা করেন তিনি। এই রেকর্ডটা কখনোই ভাঙার নয়!