হারিয়ে যাওয়া ক্যারিবিয়ান সোনালী সময়

উইন্ডিজ ক্রিকেটের এখনকার নাজুক অবস্থা দেখে অনেকের হয়তো বিশ্বাস হতে চাইবে না যে এই দেশটিই একসময় ক্রিকেট বিশ্বে আধিপত্য দেখিয়েছিল। ক্রিকেটবিশ্বে উইন্ডিজদের ছিল গৌরবময় অতীত। আর তার রূপকার ছিলেন- ব্রায়ান লারা, কোর্টনি ওয়ালশ, কার্টলি অ্যামব্রোসদের মতো তারকারা। তার‌ও অতীতে গেলে খোঁজ পাওয়া যাবে লিয়ারি কন্টেস্টাইনের মতো কিংবদন্তিদের।

১৯২৬ সালে আইসিসির পূর্ণ সদস্য দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হ‌ওয়ার পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম টেস্ট খেলে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে- ১৯২৮ সালে। তিন ম্যাচের সেই সিরিজে অবশ্য ইংল্যান্ডের কাছে হোয়াইট ওয়াশ হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। কিন্তু ১৯৮৪ ও ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত দুই সিরিজে সে সময়কার অন্যতম শক্তিধর দল ইংল্যান্ডকে দুবার‌ই ৫-০ ব্যবধানে হোয়াইট‌ওয়াশ করেছিল তাঁরা।

শুধু তাই নয়, ১৯৮০-১৯৯৪ – এ সময়ের মধ্যে টানা ২৯ টি ম্যাচে অপরাজিত থাকার রেকর্ড গড়েছিল তাঁরা, যার মধ্যে ছিল ২০টি জয়। একদিনের ক্রিকেট সংস্করণের আবির্ভাবের পরে সেখানেও আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে তাঁরা। যার প্রমাণ- ১৯৭৫ ও ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়। আর এই উত্থানের পেছনে যাঁদের অবদান, তাঁদের নিয়েই আজকের আলোচনা।

  • লিয়ারি কন্টেস্টাইন

ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই উত্থানের পেছনে যাঁদের অবদান, তাঁদের মধ্যে অন্যতম – লিয়ারি কন্টেস্টাইন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম টেস্ট উইকেট নেওয়া এই ক্রিকেটার ইংলিশদের বিপক্ষে ৮৫ রানে ৫ উইকেট নিয়ে টেস্টে প্রথম জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

সর্বমোট ১৮টি আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচ খেলে ৫৮ উইকেট নেন তিনি। কন্টেস্টাইন ক্রিকেটের ২২ গজে যেমন ছিলেন অনবদ্য, ক্রিকেটের বাইরেও ছিলেন একজন অসাধারণ ব্যক্তি। তিনি ছিলেন একাধারে আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ। ব্যক্তি জীবনে তিনি বরাবরই বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার।

  • ক্লাইভ লয়েড

ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের আরেক কিংবদন্তির নাম – ক্লাইভ লয়েড। ক্রিকেট বিশ্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের উত্থানের ব্যাপারটিকে যদি ধরা হয় সুনিপুণ দক্ষতায় আঁকা ছবির ক্যানভাস, তবে সে ছবির শিল্পী হবেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ টানা ২৫টির‌ও বেশি টেস্ট ম্যাচে অপরাজিত থাকার বিরল রেকর্ড গড়ে। শুধু তাই নয়, ১৯৭৫ সালে তাঁরই নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়।

ব্যক্তিগত রেকর্ডের দিক দিয়েও তিনি ছিলেন সমৃদ্ধ। মোট ১১০টি আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচ খেলে প্রায় ৪৭ গড়ে ৭৫১৫ রান করেন তিনি। তাছাড়াও ৮৭টি ওয়ানডে খেলে তিনি প্রায় ৪০ গড়ে ১৯৭৭ রান করেন।

  • স্যার ভিভ রিচার্ডস

ক্রিকেট সম্পর্কে যারা নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন, তাঁদের কাছে খুবই পরিচিত একটি নাম- স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস। আধুনিক ক্রিকেটের আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের সূচনা হয় মূলত তাঁর হাত ধরেই। অ্যান্টিগায় জন্ম নেওয়া এই মারমুখী ব্যাটসম্যান তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারে পঞ্চাশোর্ধ গড় নিয়ে আট হাজারেরও বেশি রান করেন।

ওয়ানডে সংস্করণেও তিনি ধরে রেখেছিলেন তাঁর প্রতিভার ছাপ। এ ফরম্যাটে ৪৭ গড়ে তাঁর রানসংখ্যা ছিল সাড়ে ছয় হাজারেরও বেশি। মজার ব্যাপার হলো, স্ট্রাইক রেটের দিক দিয়েও এখনকার ধুন্ধুমার ক্রিকেটের অনেক মারমুখী ব্যাটসম্যানের চাইতেও এগিয়ে আছেন তিনি।  তাঁর জন্মস্থান অ্যান্টিগায় তাঁর নামে একটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে।

  • ব্রায়ান লারা

‘দ্য প্রিন্স’ খ্যাত এই ক্রিকেটার ক্রিকেটাঙ্গনে প্রবেশ করেন ১৯৯০ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচ দিয়ে। তিনি যখন টেস্ট ক্যারিয়ারের ইতি টানেন, তখন তাঁর গড় ছিল পঞ্চাশেরও বেশি, যে গড় ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট ইতিহাসে এখন‌ও পর্যন্ত গুটিকয়েক ব্যাটসম্যানের আছে। টেস্টের পাশাপাশি ওয়ানডে সংস্করণেও তাঁর পরিসংখ্যান সমৃদ্ধ।

তবে ক্রিকেট বিশ্বে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন ২০০৪ সালে টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে করা ৪০০ রানের অবিশ্বাস্য ইনিংসের জন্য, যে রেকর্ড এখনও পর্যন্ত ভাঙতে পারেনি কেউ! এর সাথে আছে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে করা ৫০০ রানের ইনিংসও! এমন অদ্ভুত পরিসংখ্যান দেখার পর আর যাই হোক, অন্তত লারার এই রেকর্ড গুলো ভাঙার সাহস হয়তো থাকবে না অনেকেরই!

  • কোর্টনি ওয়ালশ

ফাস্ট বোলিংকে রীতিমতো শিল্পে পরিণত করে ফেলেছিলেন যাঁরা, তাঁদের অন্যতম কোর্টনি ওয়ালশ। জ্যামাইকান এই বোলার তাঁর সময়ে পেস বোলিংয়ে রীতিমতো রাজত্ব চালিয়েছিলেন। টেস্ট ক্রিকেটে অধিনায়ক হিসেবে কোন ম্যাচে সেরা বোলিং ফিগারের রেকর্ড নিজের ঝুলিতে জমা রাখা তার‌ই প্রমাণ। ১৯৯৫ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পুরো টেস্ট ম্যাচে মাত্র ৫৫ রান খরচ করে ১৩ টি উইকেট শিকার করে এ রেকর্ড গড়েন তিনি। শুধু তাই নয়, টেস্টে দ্রুততম ৫০০ উইকেট শিকারিদের তালিকায়ও তাঁর অবস্থান পাঁচ নম্বরে।

তিনি তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারে ১৩২ ম্যাচ খেলে ৫০০ এরও বেশি উইকেট নিয়েছেন। পাশাপাশি ওয়ানডে সংস্করণে ২০৫ ম্যাচ খেলে ২২৭ উইকেট শিকার করেন তিনি। ১৯৮৭ সালে তিনি উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটার হিসেবে নির্বাচিত হন। আর এর পরের বছরই তাঁকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বর্ষসেরা ক্রিকেটার হিসেবে নির্বাচন করা হয়।

  •  কার্টলি অ্যামব্রোস

কোর্টনি ওয়ালশের ব্যাপারে বলতে গেলেই আরও একটি নাম সামনে চলে আসে- কার্টলি অ্যামব্রোস। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস বোলিং আক্রমণে এই ওয়ালশ-অ্যামব্রোস জুটি সে সময়কার ক্রিকেট বিশ্বে প্রতিপক্ষের শিবিরে ভয় ধরানো বোলিং জুটি গুলোর মধ্যে ছিল অন্যতম।

গতি আর বাউন্সের মিশেলে প্রতিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের রীতিমতো খাবি খাইয়ে ছাড়তেন অ্যামব্রোস। ছোটবেলায় তাঁর সমবয়সীদের প্রিয় খেলা ছিল যেখানে বাস্কেটবল, সেখানে স্রোতের বিপরীতে গিয়ে ক্রিকেটে মনোনিবেশ করেন তিনি।

ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে অবশ্য নিজেকে তেমন মেলে ধরতে পারেননি। তবে সময় যত‌ই গড়িয়েছে, ততোই নিজেকে পরিণত করেছেন তিনি। তিনি তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারে ৯৮ টি ম্যাচ খেলে ৪০৫ উইকেট নেন। টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১ রানে ৭ উইকেট নেয়ার অবিশ্বাস্য রেকর্ড গড়েন তিনি।

ওয়ানডেতে ১৭৬ ম্যাচে ২২৫ উইকেট শিকার করেন তিনি। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তাঁর উইকেট সংখ্যা এক হাজার ছুঁই ছুঁই। ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার পর আরেক উইন্ডিজ ক্রিকেটার রিচি রিচার্ডসনের সঙ্গে ব্যান্ড দলে যোগ দেন আমোদপ্রিয় এই মানুষটি। ১৯৯২ সালে উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটার হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি।

বর্তমানে উইন্ডিজ ক্রিকেটের আগের মতো খুব একটা আধিপত্য নেই। এর জন্য কেউ কেউ দায়ী করছেন ক্রিকেট বোর্ডের অব্যবস্থাপনাকে, আবার কেউ কেউ দায়ী করছেন খেলোয়াড়দের মানসিকতাকে। তবে যাই হোক, বিশ্ব ক্রিকেটে উইন্ডিজদের নতুন ভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে এসব কিংবদন্তি ক্রিকেটারদের অবদান কখনও ভোলা যাবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link