আমি অন্তহীনের পথে দেবো পাড়ি

ডাক্তারি পরীক্ষা নিরিক্ষা কিছুই হয়নি। পয়সা কই যে করাবে ওসব। রোগটা ধরা পড়েছিল ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়া সিরিজে। ব্রিসবেনে অসাধারণ একটা হাফ সেঞ্চুরির পর অ্যাডিলেডে যখন গেল তখন আবার শুরু হলো সেই তীব্র বুকের যন্ত্রণা। ডাক্তারি পরীক্ষার পর দেখা গেল একটা বিস্ময়কর জিনিস। যদি নিজের ভাষায় বলি তাহলে বলতে হয়, ‘A Millimetre Hole in the Largest Heart.’ লার্জেস্ট হার্ট? সত্যিই কি তাই?

স্যাবাইনা পার্কের গাছগুলোই একমাত্র সেই যন্ত্রনাটা জানত। আর জানত ক্যারিবিয়ান সাগরের ঢেউগুলো আর রোলিংটন শহরের প্লাস্টিকের বোতলগুলো। হ্যাঁ, ছোটবেলায় তো সে এই বোতলগুলিই চুরি করে বিক্রি করে নিজের খিদে মেটাত।

হৃৎপিন্ডে কিছু মিলিমিটারের একটা ফুঁটো। হঠাৎ করে নয়। সেই ফুঁটোটা তার জন্মগত। কেউ জানত না সেই কষ্টগুলো। কেউ জানত না ছোটবেলায় অভাগা পরিবারের ছয় নম্বর সন্তান কেন খেলতে খেলতে মাঝে মাঝেই বুকে হাত দিয়ে যন্ত্রনা চেপে রেখে মাটিতে বসে পড়ত, আবার কিছুক্ষণ পড়েই উঠে দাঁড়াত।

ডাক্তারি পরীক্ষা নিরিক্ষা কিছুই হয়নি। পয়সা কই যে করাবে ওসব। রোগটা ধরা পড়েছিল ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়া সিরিজে। ব্রিসবেনে অসাধারণ একটা হাফ সেঞ্চুরির পর অ্যাডিলেডে যখন গেল তখন আবার শুরু হলো সেই তীব্র বুকের যন্ত্রণা। ডাক্তারি পরীক্ষার পর দেখা গেল একটা বিস্ময়কর জিনিস। যদি নিজের ভাষায় বলি তাহলে বলতে হয়, ‘A Millimetre Hole in the Largest Heart.’ লার্জেস্ট হার্ট? সত্যিই কি তাই?

সালটা তখন ২০১৩। সৌরভ গাঙ্গুলির পুনে ওয়ারিয়র্সের বিরুদ্ধে বিধ্বংসী ১৭৫ রানের ইনিংস খেলে সবাই প্রেস কনফারেন্সে তাঁর অপেক্ষারত, কিন্তু দেখা নেই তাঁর। খোঁজ নিলে দেখা গেল তিনি গিয়েছেন ব্যাঙ্গালুরুর এক বেসরকারি হাসপাতালে।

ম্যাচ চলাকালীন তাঁর হাঁকানো একটি বিশাল ছয় সোজা আঘাত হেনেছিল এক দশ বছর বয়সী কন্যার নাকে।সে খবর কানে যেতেই ছুঁটতে ছুঁটতে চলে গিয়েছিলেন তিনি, একটিবার সে কন্যার খবরটা পেতে। হ্যাঁ, তিনিই। পৃথিবীর ক্রিকেট ইতিহাসে বোধহয় সবচেয়ে বিতর্কিত মানুষ। বিভিন্ন স্যোশাল সাইটে যে কোনো সময়েই তাঁকে সর্বাধিক কামাতুর বলে ব্যাঙ্গ করা হয়। সেই তিনিই ছুঁটে গিয়েছিলেন হাসপাতালে, সেই বাচ্চা মেয়েটার খবর নিতে।

সালটা তখন ২০১৪। তখন তাঁর একশোতম টেস্ট ম্যাচ। তিনি সেই ম্যাচে আমন্ত্রণ করলেন লুকাস ক্রিকেট স্কুলের তাঁর ছোটবেলার শিক্ষককে। এটা সেই লুকাস স্কুল যেটা না থাকলে বোতল চুরি করে খিদে মেটানো সেই ক্যারিবিয়ান ছেলেটার হয়তো ইউনিভার্স বস হওয়া হতো না।

নিজের একশোতম ম্যাচ শেষে তিনি ছুঁটে গেলেন তাঁর ছোটোবেলার শিক্ষকের কাছে, আর জানতে চাইলেন এই ম্যাচ দেখে তিনি তাকে কত নম্বর দেবেন। এটাই তিনি। এটাই ক্রিস্টোফার হেনরি গেইল। তাই ‘লার্জেস্ট’ কথাটা হয়তো তাঁর হৃৎপেশির আয়তন নয়, এটা তাঁর হৃদয়ের বিশালতা।

ছোটবেলায় খাবারের তাড়নায় যখন তাকে চুরির পথে নামতে হয়েছিল,যখন সামান্য রোজগার করা বাবা তাকে স্কুলের খরচ বইতে না পেরে তাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনল, তখন রোলিংটনের রোড বেয়ে এগিয়ে হয়তো সে এসে দাঁড়িয়েছিল ক্যারিবিয়ান সাগরের তীরে। অনুভব করেছিল ক্যারিবিয়ান সাগরের বিশালতাকে।

কেউ জানেনা না খেতে পাওয়া জন্মগত হৃদরোগে ছটফট করা সেই যন্ত্রণাগুলো। কেউ জানেনা সাবিনা পার্কে স্কুলের ছেলেদের ক্রিকেট খেলা দেখতে দেখতে তার অপ্রকাশিত ইচ্ছের কাতরতা গুলো। নিশিথের কুলহীন সাগরের অন্তহীনতা তখন যেন মিশে গিয়েছিল পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সীমাহীন নিশিথের সাথে। সেই অন্তহীনতাকে একমাত্র ক্রিস্টোফারই পেরেছিল নিজের ভবিষ্যৎ শক্তির মূলধন করতে।

তাঁর অন্তহীন ছয়গুলো যেন তার অন্তহীন সংগ্রামের স্বাক্ষর। ‘Just Stand and give a Hit স্টান্সে তিনি দীর্ঘকুড়ি বছর ধরে ঘুম কেড়ে নিয়েছেন বিশ্বের সমস্ত রকম অগ্নিনিক্ষেপক বোলারদের। ছোট্ট দ্বীপ থেকে শুরু করে তাঁর এ বিশ্বের গ্যাংস্টার হয়ে ওঠা টা যেন ধরা পড়ে তাঁর গ্যাংনাম সেলিব্রেশনেই। গতি সম্রাট স্টেইন থেকে লিকে একমাত্র তিনিই পেরেছিলেন ক্রিজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছক্কা হাঁকাতে।

এ ঔদ্ধত্য তাঁর নিজস্ব। না খেতে পাওয়া বস্তি থেকে টি টোয়েন্টি লিগের দামী তম খেলোয়াড় প্রমাণ করে তাঁর ক্যারিবিয়ান রক্তের তেজকে। অস্ট্রেলিয়ান নারী সাংবাদিককে, ‘Dont blush baby” বলার বিতর্কের পর তাঁর নিজের মেয়ের ‘ব্লাশ’ নাম রাখা প্রমাণ করে তাঁর হৃদয়ের বিশালতাকে।

অভাব থেকে উঠে এসে একাধারে তিনি রোজগার করেছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, একবার একটা সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন – ‘সান্তার কাছ থেকে আমি টাকা চাই শুধু’। আবার সেই ক্রিস্টোফারই দুহাত ভরে খরচ করে গিয়েছেন আমেরিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে বিভিন্ন সেবামুলক কাজে। তাঁর নিজের নামে যে কতগুলো স্কুল, ট্রাস্ট চলে তার ইয়ত্তা নেই।

দারিদ্রতায় স্কুলছুট সেই ছেলেটাই হয়তো বুঝেছিল অন্ধকার সমাজে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাটা। সত্যিই তিনি এই ক্রিকেট জগতের গ্যাংস্টার। ২০০৫ সালে হৃদপিন্ডে অস্ত্রোপ্রচারের পর যখন তাঁর ক্রিকেট জীবন অনিশ্চিত, তারপরেও সেই দৈত্যাকার হাসি হেসে তিনি খেলে গিয়েছেন আরও ১৪ বছর। শতরান থেকে ত্রিশতরান সবই তাঁর দখলে।জীবনের শেষ ম্যাচেও সেঞ্চুরির পরোয়া না করে স্বভাবসিদ্ধ বিধ্বংসীরূপে করা ৪১ বলে ৭২ রানটা যেন প্রমাণ করে ২০ বছর ধরে একই ভঙ্গিতে দর্শকদের আনন্দ দেওয়া তাঁর অলৌকিক শক্তিকে।

আর জীবনের শেষ ম্যাচটা খেলে সেই দৈত্যাকার হাসি হাসতে হাসতে চলে গেলেন,চাপা পড়ে রইল ছোটবেলার অভাবের যন্ত্রণাগুলো,চাপা পড়ে রইল ২০১৮ এ মা হারানোর যন্ত্রণাটা। শেষ মুহুর্তে হেলমেটটাকে তুলে ধরলেন উঁচু করে ব্যাট দিয়ে,যেন প্রমাণ করতে চাইলেন তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। এই ঔদ্ধত্যের জন্যই তো তিনি ইউনিভার্স বস্।

অন্তহীন ছক্কা গুলোর মতোই হয়তো নীরবে বলে গেলেন, ‘ shall not pass this way again’। তিনি ক্রিস্টোফার হেনরী গেইল, সত্যিই অন্তহীন।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...