তখন বয়স বারো কি তেরো! ক্যাম্বিস টুর্নামেন্ট খেলে অল্প স্বল্প নাম হয়েছে। বাড়িতে এসেছে কিছু ম্যান অফ দ্য ম্যাচ, একটা দুটো সিরিজ সেরার মেডেল। সেগুলো সব নিজেই যত্ন করে সাজিয়ে রাখতাম। ছোট্ট কাঠের আলমারিটায়। ওখানেই থাকতো ব্যাট, বল আর স্ট্যাম্পও। সেই আলমারির পাল্লায় লাগানো ছিল দুটো বড় পোস্টার। দুই রোগা ফিনফিনে ভদ্রলোক। একজন ব্যাট করছেন, অন্যজন বল হাতে দৌড়োচ্ছেন। রাহুল দ্রাবিড় আর শন পোলক।
বাড়িতে প্রথমে আসেন দ্রাবিড়ই। স্কুল থেকে ফেরার সময় কেনা। ছেলের কাঁদো কাঁদো গলার আবদার কোন মা আর উপেক্ষা করতে পারে? পোলক প্রীতি শুরু এর বছর দুই পর। তখন ভালো বুঝতাম না। লোকটা দারুণ বল করে, মারের হাতটাও বেশ ভালো। তারপর আমার মতোই রোগা পটকা টাইপ, আর কী চাই! টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কিনেছিলাম।
তাও আবার দোকানদারকে আগে থেকে বলে রাখতে হয়েছিল! ‘পোলক আবার কে?’ দোকানদার নামটা শুনে প্রথমে হকচকিয়ে গিয়েছিল কিছুটা। এখন সেই আলমারিও নেই, নেই সেই পোস্টারও। কিন্তু ভালোবাসাটা রয়ে গিয়েছে একই রকম। হয়তো বা বেড়েছে কিছুটা। বাড়বে নাই বা কেন বলুন, পোলকের মতো ক্রিকেটার কি সহজে আসে?
জন্মেছেন এমন পরিবারে যে ক্রিকেটটা খেলতেই হত!
ক্রিকেট ব্যাটের বদলে যদি অন্য কিছু হাতে তুলে নিতেন, সেটা আমান আলি বা আয়ান আলি বঙ্গাশের সরোদ ছেড়ে, বাঁশি বাজানোর মতোই আশ্চর্যের হত। আমান, আয়ানরা সুর, তাল পেয়েছেন বাবা আমজাদ আলি খানের থেকে। শন পেস বোলিংয়ের ধাঁচ পেয়েছেন বাবা পিটার পোলকের থেকে। আর ব্যাটিং? অনেক ক্রিকেট ঐতিহাসিকই কাকু গ্রাহাম পোলককে সর্বকালের অন্যতম সেরা বাঁ-হাতি ব্যাটসম্যান বলেন।
ঠিক কোন মানের ক্রিকেটার ছিলেন শন? ১০৮ টেস্ট খেলে নিয়েছেন ৪২১ উইকেট, রান ৩৭৮১। একদিনের ম্যাচেও রান ওই সাড়ে তিন হাজার মতো। উইকেট চারশো ছুঁই ছুঁই। না, এক নজরে পরিসংখ্যান চোখ কপালে তোলার মতো নয়।
‘গভীরে যাও! আরও গভীরে যাও!’ পোলোকে চিনতে গেলে, রূপঙ্করের গাওয়া রাস্তায়ই হাঁটতে হবে। ব্যাট হাতে টেস্টে পোলকের গড় ৩২.৩। কপিল দেব, রিচার্ড হ্যাডলিদের থেকে বেশ কিছুটা বেশি, ইয়ান বোথামের প্রায় কাছাকাছি। অথচ কী আশ্চর্য জীবনের বেশিরভাগ সময়ই লোকটা ব্যাট করেছেন নয় নম্বরে।
ব্যাটিংয়ে এত নিচে নেমে টেস্টে দুটো সেঞ্চুরি কোনও ক্রিকেটারের নেই! ক্লুজনার, বাউচাররা ভিড় করে ছিলেন তাই সেভাবে ব্যাট করার সুযোগই হয়নি ছয় বা সাতে। ২০০৭-এ বিশেষজ্ঞ ব্যাট হিসেবে খেলেছিলেন আফ্র-এশিয়ান কাপ। প্রথম ম্যাচেই এসেছিল ১১০ বলে ১৩০। জাহির খান, হরভজন সিং, মোহাম্মদ আসিফদের ছাতু করে।
তিনি নিজে আক্ষেপ করেননি কখনও। টিম ম্যান ছিলেন! হা হুতাশ শোনা যেত মূলত কাকা আর বাবার গলায়। বিশেষ করে কাকা! একদিন ডিনারে তো পোলককে বলেই বসলেন, ‘কী করছো বলতো? সেঞ্চুরি কবে আসবে? আর ব্যাট করার সময় একটু আক্রমণাত্মক থাকো।’ কিছুটা চমকেই গেছিলেন পোলক। ভাবেননি, প্রায় ১৯ গড়ে ২০০ টেস্ট উইকেট তোলা অধিনায়ককে কেউ ব্যাটিংয়ে মন দিতে বলতে পারেন। শতরান এল ৫১ নম্বর টেস্টে।
শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ২০৪ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছে দক্ষিণ আফ্রিকা। জমে যাওয়া ম্যাকেঞ্জির সঙ্গে হাল ধরেন পোলক। উইকেটে এসেই শটের ফুলঝুরি। কাট, পুল আর অনবদ্য কিছু কভার ড্রাইভ। মাত্র ৯৫ বলে করা শতরান সাজানো ছিল ১৪ টা মসৃণ চার, তিনটা পেল্লাই ছক্কায়।
আর বোলিং? না, সেটা নিয়ে বোধহয় বিশেষ চর্চার দরকার নেই। চোখ বুজে বলা যায়, সর্বকালের সেরাদের নিয়ে আলোচনা উঠলে তাঁর নাম আসবেই। বলটা রাখতেন গুড লেন্থে, চতুর্থ স্ট্যাম্প বরাবর। সেখান থেকেই কোনটা ভেতরে আসতো, কোনটা বাইরে। সঙ্গে ছিল কাটার।
আগুনে গতি তাঁর কোনওদিনই ছিল না। সেই যে শুরুর দিকে গোড়ালিতে কাটাছেঁড়া করতে হল, গতি তখনই বিদায় জানায়। সাদা বিদ্যুৎ-এর পার্টনারের আর্টিস্টি ছিল বলটা এক জায়গায় রেখে নড়াচড়া করানোয়। তাই ক্যারিয়ারের ৪৪ শতাংশ উইকেট লেগ বিফোর বা কট বিহাইন্ড।
দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, ম্যাচের পর ম্যাচ- গতির অভাব ঢেকে রেখেছিলেন নিখুঁত লাইন লেন্থ দিয়ে। ডেল স্টেন এসে যাওয়ার পর নতুন বলে সেভাবে সুযোগ হত না। পিঠের চোট তো ছিলই। গতি আরও কমলো। ২০০৬-এ শ্রীলংকার বিরুদ্ধে একটা ম্যাচে করলেন অফ স্পিন। ১৪ ওভারে ৩৫ রান দিয়ে একই রকম কৃপণ।
পরিশ্রমও করতে পারতেন অনেকের থেকে ঢের বেশি। ৯০-এর শুরুতে ডারবানে ম্যালকম মার্শালের থেকে জোরে বলের পাঠ নেওয়ার সুযোগ হয়েছিল। ফুসফুসে বাড়তি অক্সিজেন বোধহয় তখন থেকেই। ক্যারিয়ারের সেরা ৮৭ রানে ৭ উইকেট নিতে বল করেছিলেন ৪০ ওভারের বেশি। অ্যাডিলেডের পাটা উইকেট আর গরমকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে।
আশ্চর্যজনক ভাবে এরকম একটা চরিত্রকে ক্রমশ ভুলতে বসেছি আমরা।
সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার নিয়ে কথা উঠলে সোবার্স, বোথাম, কপিল, ইমরান, কালিসদের ভিড়ে কথায় যেন হারিয়ে যান পোলক। জুলাইয়ে জন্মানো সৌরভ, ধোনি বা গাভাস্কারের জন্য যত কালি, নিউজ প্রিন্ট খরচ করা হয়, ছিটেফোঁটাও পান না তিনি। আসলে আমরা যে তারকা খুঁজি শুধু! যিনি ফ্ল্যাশ লাইটের ঝলকানি দিয়ে ভুলিয়ে দেবেন আমাদের সব দু:খ, অভিমান। আর মন খারাপ চলে যাবে বাউন্ডারির বাইরে। কিন্তু যখনই লোয়ার মিডল অর্ডারে নির্ভরতা চাইবে দল, পিচ রাস্তার চেয়েও মসৃণ ২২ গজে যখনই বোলারদের টুঁটি চেপে ধরবেন ব্যাটসম্যান, তখনই দীর্ঘ শ্বাস ফেলবেন অধিনায়ক, ‘আমার যদি একটা পোলক থাকতো!’